জানেন কি বরফ দিয়ে যুদ্ধজাহাজ তৈরি করতে চেয়েছিল। কতোটা সম্ভব হয়েছিল?
মানব ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ানক যুদ্ধ বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে। ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর অবধি ছয় বছর চলা এই যুদ্ধে প্রায় দেড় কোটি সেনা এবং তিন কোটি আশি লাখ সাধারন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল অর্থাৎ সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। বিশ্বের ইতিহাসে এত বড় নর সংহার আর কোনও যুদ্ধে হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অ্যালায়েড ফোর্স এবং অ্যাক্সিস ফোর্স উভয় তরফেরই বেশ কিছু অসাধারন প্রযুক্তির ব্যবহার হয়েছিল বিশেষ করে জার্মান সমরাস্ত্র প্রযুক্তি ছিল সবচেয়ে আধুনিক, তবে অ্যালায়েড ফোর্সও পিছিয়ে ছিলনা৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন চরমে ছিল সেসময় অ্যালায়েড ফোর্সের কাছে যুদ্ধজাহাজ তৈরির কাঁচামাল কমে আসে, সেসময় এক ব্রিটিশ ব্যক্তির বরফ দিয়ে যুদ্ধজাহাজ তৈরির পরিকল্পনা করে। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও এটাই সত্যি, বাস্তবেও সেসময় এমনই কাজ করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অ্যালায়েড ফোর্সে ছিল আমেরিকা,ব্রিটেন,সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্সের মতোন শক্তিশালী দেশ, অন্যদিকে অ্যাক্সিস ফোর্সে ছিল জার্মানি, জাপান ও ইটালির মতোন দেশ। এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ ছিল আটলান্টিকের যুদ্ধ যা আটলান্টিক মহাসাগরে হচ্ছিল। এই যুদ্ধে সবচেয়ে বেশী সমস্যায় ছিল ব্রিটেন। কারন ব্রিটেন ইউরোপের মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। সেকারনে ব্রিটেনকে প্রয়োজনীয় জিনিস বাইরের দেশ থেকে সমুদ্রপথে আনাতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার ব্রিটনকে পরাজিত করবার জন্য জার্মান নৌবাহিনীকে নির্দেশ দেয় আটলান্টিক মহাসাগরে আমেরিকা থেকে ব্রিটেনের জন্য আসা জাহাজে আক্রমন করতে। ১৯৪১ সাল আসতে আসতে জার্মান সাবমেরিন বা ইউবোট আমেরিকা ব্রিটেনের উদ্দেশ্যে আসা যুদ্ধজাহাজকে এতটা আক্রমন শুরু করে যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল পর্যন্ত চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। অবস্থা এমন হয় যে আমেরিকা থেকে একশো জাহাজ ব্রিটেনের উদ্দেশ্যে রওনা হলে ষাটটি জাহাজ ব্রিটেনে পৌঁছাতো বাকী চল্লিশটি জাহাজ ডুবিয়ে দিত জার্মান নৌবাহিনী। জার্মান ইউবোট থেকে জাহাজকে রক্ষা করতে আমেরিকা ও ব্রিটেন জাহাজের সাথে যুদ্ধবিমান পাঠাতে শুরু করে। যুদ্ধবিমান জাহাজের আগে আগে আটলান্টিক মহাসাগরে জার্মান ইউবোটের উপর নজর রাখতো। কিন্তু এখানে একটা বড় সমস্যা ছিল। যুদ্ধবিমান দুই ধরনের হয় একটি হয় ল্যান্ড বেসড যুদ্ধবিমান এবং আরেকটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার থেকে আক্রমন যোগ্য। ল্যান্ড বেসড (ভূমি নির্ভর) যুদ্ধবিমান বেশী অস্ত্র বহন করতে পারে ক্যারিয়ার বেসড যুদ্ধবিমানের থেকে। কিন্তু ল্যান্ড বেসড যুদ্ধবিমানের রেঞ্জ নির্দিষ্ট ছিল। আমেরিকা থেকে উড়ান নিয়ে পুরো আটলান্টিক মহাসাগরে জাহাজকে নিরাপত্তা দিয়ে ব্রিটেন অবধি পৌঁছে দেওয়ার রেঞ্জ ছিলনা ল্যান্ড বেসড যুদ্ধবিমানের। ফলে যুদ্ধবিমান গুলি আটলান্টিক মহাসাগরের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল অবধি গিয়ে ফিরে আসতো। ঠিক এর পরেই আক্রমন করতো জার্মান ইউবোট গুলো। সুতরাং জার্মান ইউবোট থেকে বাঁচতে আমেরিকা ও ব্রিটেনের কাছে একমাত্র উপায় ছিল এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার পাঠানো জাহাজ গুলোর সাথে। কিন্তু সেসময় আমেরিকা ও ব্রিটেনের কাছে যা এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ছিল তা সবই পাঠানো হয়েছিল প্রশান্ত মহাসাগরে যুদ্ধের জন্য এবং উত্তর আফ্রিকায় সেনা পৌঁছানোর জন্য। ফলে আটলান্টিক মহাসাগরে জাহাজ গুলোকে নিরাপত্তা দেবার মতোন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার আর ছিলনা। ব্রিটেন ও আমেরিকার জাহাজ নির্মান সংস্থাগুলোও দ্রুত গতিতে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার তৈরি করতে পারছিল না, কারন একটি এয়ারক্রাফট তৈরির প্রধান উপাদান অ্যালুমিনিয়াম ও স্টিল। সেসময় বন্দুক, সাঁজোয়া গাড়ি, ট্যাঙ্ক, যুদ্ধ বিমান, যুদ্ধ জাহাজ, বোম্ব তৈরিতে এত বেশী স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের প্রয়োজন ছিল যে আলাদা করে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার তৈরির জন্য যোগান দেওয়া সম্ভব ছিলনা। এরকম পরিস্থিতিতেই এক ব্রিটিশ ব্যক্তি পরিকল্পনা করে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার তৈরিতে স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের বদলে বরফের ব্যবহার করার।
জফ্রি পাইক নামে ওই ব্রিটিশ ব্যক্তি লক্ষ্য করেছিলেন বরফের ঘনত্ব জলের থেকেও কম যার কারনে বরফ জলে ডোবেনা। তাছাড়া জলে ভেসে থাকা বড় বড় আইসবার্গে গুলি করলেও সেগুলো সহজে ভাঙেনা। যার কারনে তিনি ২০০০ ফুট লম্বা ও তিনশো ফুট চওড়া বিশাল এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার নির্মানের প্রস্তাব দেন যার দেওয়াল হবে ৪০ ফুট চওড়া। তিনি এই প্রজেক্টের নাম দেন প্রজেক্ট হাবক্কুক। জফ্রি পাইক তার এই পরিকল্পনা শোনান ব্রিটিশ মিলিটারির শীর্ষ অফিসার লুই মাউন্টব্যাটেনকে।
১৯৪২ সালে মাউন্টব্যাটেন এই পরিকল্পনা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে জানান। চার্চিল এই প্রজেক্ট শুরুর নির্দেশ দেয়। জফ্রি পাইক ও তার গোটা দল প্রজেক্ট কাজ শুরু করে। তারা প্রথমে আইসবার্গ থেকে বরফ সংগ্রহ করে কিন্তু আইসবার্গের বরফ ততটা মোটা ছিলনা। এরপর জফ্রি পাইক কৃত্রিম ভাবে বরফ তৈরি করে পরীক্ষা করেন কিন্তু এখানেও বরফ কখনও ভঙ্গুর বা কখনও শক্ত হত যা এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার তৈরির জন্য যথেষ্ট ছিলনা। ফলে জফ্রি পাইক ও তার দল বুঝতে পারে এই পরিকল্পনা সফল হবেনা। কিন্তু এই সময় আমেরিকার দুই রসায়নবিদ হার্মান মার্ক এবং ওটের হোয়েনস্টেইন এই সমস্যার সমাধান করেন।
ওনারা দেখলেন বরফে কাঠের গুঁড়ো মেশালে বরফ অনেক শক্ত হয়। জফ্রি পাইকের সম্মানে কাঠের গুঁড়ো মিশিয়ে যে শক্ত বরফ তৈরি হয় তার নাম রাখা হয় পাইকরেট। প্রকৃত বরফের মতোই হালকা কিন্তু আইসবার্গের মতোই শক্তিশালী ছিল এই পাইকরেট, এমনকী এতে গুলি মারলে একটি গুলি সিমেন্টের স্থাপত্যের মধ্যে যতটা যায় ততটাই যাচ্ছিল। অর্থাৎ পাইকরেট সিমেন্টের মতো শক্ত ছিল। ১৯৪৩ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল উইনস্টন চার্চিল এবং আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টের এক বৈঠকে মাউন্টব্যাটেন তাদের সামনে পাইকরেটে গুলি চালায় গুলি পাইকরেটে লেগে অন্যদিকে চলে যায় যা দেখে সাথে সাথে উইনস্টন চার্চিল ও রুজভেল্ট এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার তৈরির নির্দেশ দেয়। নির্দেশ পাওয়ার পরই ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ কাজে লেগে যায়।
ব্রিটিশরা জানত তারা এই ক্যারিয়ার ব্রিটেন ও আমেরিকা কোথাও তৈরি করতে পারবেনা কারন জার্মানির গুপ্তচর সব জায়গায় রয়েছে। সেকারনে এমন জায়গার দরকার হয় যে এলাকা খুব ঠান্ডাও হবে আবার জার্মানদের থেকে দূরেও হবে। শেষপর্যন্ত এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার তৈরির জন্য কানাডাকে বেছে নেওয়া হয়। প্রথমে জফ্রি পদইকের দল একটি ছোট প্রোটটাইপ যুদ্ধজাহাজ তৈরি করে যা ৬০ ফুট লম্বা এবং ৩০ ফুট চওড়া ছিল। এই প্রোটোটাইপ খুব ভালো ভাবেই কাজ করছিলো কিন্ত পরীক্ষা করে দেখা যায় যে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার তৈরি করা হবে তার জন্য ৪০ ফুট লম্বা হাল দরকার। হাল জাহাজের নীচের কাঠামো যা জলের উপরে থাকে, এখানেই টর্পেডোর আঘাত লাগে। এই ৪০ ফুট হাল তৈরি করতে ১৭ লাখ টন পাইকরেটের প্রয়োজন ছিল! এই সম্পূর্ন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার তৈরি করতে ভ্যাটিকান সিটির সমতুল্য এলাকার প্রয়োজন ছিল। হিসাব করে দেখা যায় এই পুরো প্রজেক্টে যা খরচ হত তা দিয়ে একটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের পুরো ফ্লীট তৈরি করা সম্ভব। যার কারনে এই প্রজেক্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়। কখনও আর বরফ দিয়ে জাহাজ তৈরি করা হয়নি।
এদিকে ১৯৪২ থেকেই জার্মান ইউবোটকে কাউন্টার করবার জন্য অ্যালায়েড ফোর্স একটি নতুন উপায় বের করে ফেলেছিল। আমেরিকা থেকে যখন ব্রিটেনের উদ্দেশ্যে বানিজ্যিক জাহাজ রওনা হত তখন সেই বানিজ্যিক জাহাজকে রক্ষা করবার জন্য সাথে বেশ কিছু ডেস্ট্রয়ার পাঠানো হত, ডেস্ট্রয়ার জার্মান ইউবোটকে খুঁজে ধ্বংস করতো। আবার ততদিনে ব্রিটিশ ও পোলিশ গোয়েন্দারা নাজি জার্মানির গোপন যোগাযোগ ব্যবস্থা অ্যানিগমা সিস্টেমকে ডিকোড করে ফেলে, ফলে জার্মান ইউবোটের অবস্থান আগে থেকেই জেনে যেত অ্যালায়েড ফোর্স। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এমন অদ্ভুত সব প্রযুক্তির উপর কাজ হয়েছিল যা শুনলে আশ্চর্য জাগে কিন্ত বাস্তবে এমনটা ঘটেছিল।
২০০৯ সালে ডিসকভারি মিথবাস্টার নামে একটি টিভিশোতে কাগজ ও বরফ মিশিয়ে একটি ছোট বোট তৈরি করে পরীক্ষা করে আদবেও বরফ দিয়ে জাহাজ বাননাে সম্ভব কীনা। তাদের তৈরি এই বোট খুব ভালো ভাবেই কাজ করে, সাথে সাথে এটা বুলেটপ্রুফও ছিল। আসলে পাইকরেটের সাহায্যে জাহাজ তৈরি করা গেলেও তা তৈরিতে জনবল এবং অর্থ এতটাই বেশী লাগে যে যার কারনে এধরনের কোনও জাহাজ কোনওদিন তৈরি করাই হবেনা।