পশ্চিমবঙ্গেই রয়েছে ছাপবিহীন মানুষ
আপনার হাতের ছাপ আছে তো? প্রশ্নটা শুনে একটু অবাক হচ্ছেন তাই তো? যদিও হওয়াটায় স্বাভাবিক। তবে আর মানে কিন্তু এটা নয় যে এই প্রশ্নটা ভুল। কারন এই রকম কিছু মানুষের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে যাদের হাতের ছাপ নেই। হ্যাঁ ঠিকই শুনছেন। এটি আসলে একটি বিরল রোগ যার কারনে আক্রান্ত ব্যক্তিদের হাতের আঙুল, পায়ের আঙুল, হাতের পাতা এবং পায়ের পাতায় কোনো ছাপ তৈরি হয় না। এই বিরল রোগটি নাম কি? কবে সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল এবং কিভাবে?
রাজশাহী নামক এই স্থানে বসবাস করত অপু সরকার নামের একটি ছেলে। যার দুটি হাত দেখলে মনে হবে না যে তার হাত আর দশজন মানুষের থেকে আলাদা ছিল বলে। তবে এই ছেলেটির হাতের আঙ্গুলকেন্দ্রিক একটি সমস্যা ছিল, শুধু তারই নয় তার পরিবারের মানুষদেরও ছিল যা তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। এই রোগটি ছিল খুবই বিরল জিনগত এক রোগ যার কারনে দুই হাতের আঙুলের কোনো প্রিন্ট বা ছাপ ছিল না অপুর। শুধু তারই নয় এই সমস্যায় ভুগছিলেন তার পরিবারের সর্বমোট ছয়জন সদস্য।
সর্বপ্রথম ২০০৭ সালে সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল এই বিরলতম রোগটির। পিটার ইটিন যিনি ছিলেন সুইজারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি হসপিটাল বাসেলের একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি সন্ধান পেয়েছিলেন এক সুইস মহিলার, যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারছিলেন না তার আঙুলের ছাপ না থাকার জন্য। তার থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ আঙুলের ছাপ চাচ্ছিল কিন্তু তার জন্মগতভাবেই কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট ছিল না!
এরপর এই অদ্ভুত রোগ নিয়ে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ পিটার ইটিন কাজ শুরু করলেন। তিনি দেখেন যে শুধু ওই মহিলাটিই নয় একইভাবে জন্মগতভাবেই ছাপবিহীন ছিল তার পরিবারের আরো নয় জন সদস্য। তার এই কাজে প্রফেসর ইটিন যুক্ত করেছিলেন ইসরায়েলের চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ এলি স্প্রিচার এবং অন্যান্য সহকর্মীদেরও এবং তারা এই কাজ করতে গিয়ে খুঁজে পেয়েছিলেন এই একই সমস্যাই আক্রন্ত আরো তিনটি পরিবারকে। এরপর এই রোগটিকে ‘অ্যাডার্মাটোগ্লিফিয়া’ নামে নামকরণ করেছিলেন। ‘অ্যাডার্মাটোগ্লিফিয়া’ হল এমন এক বিরলতম শারীরিক অবস্থা যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তিদের হাতের আঙুল, পায়ের আঙুল, হাতের পাতা এবং পায়ের পাতায় কোনো ছাপ তৈরি হয় না। এছাড়াও ‘ইমিগ্রেশন ডিলে ডিজিজ’ নামেও অভিহিত করা হয় এই রোগটিকে। কারন এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের অন্য দেশে যেতে গেলে ইমিগ্রেশনে প্রচুর ঝামেলা ভোগ করতে হয়।
প্রফেসর ইটিন, তেল আবিব সোরাস্কি মেডিকেল সেন্টারের চর্মরোগবিদ এলি স্প্রিচার এবং তাদের সহকর্মীবৃন্দ মিলে সন্দেহ করেছিলেন যে এই রোগটি জিনগত হতে পারে। এই কারনে তারা ওই পরিবারের ১৬ জন সদস্যের ডিএনএ সংগ্রহ করে সিকোয়েন্স করলেন। এই ১৬ জন সদস্যের মধ্যে অ্যাডার্মাটোগ্লিফিয়ার রোগে আক্রান্ত ছিল নয়জন এবং বাকি সাতজন ব্যক্তি সুস্থ ছিল। সুতরাং তাদের করার ধারনা অবশেষে সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল। ওই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে অ্যাডার্মাটোগ্লিফিয়া রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিদের প্রত্যেকের ডিএনএ-র বিশেষ অঞ্চলে পরিবর্তন ঘটেছে, আর এটির জন্য দায়ী ছিল SMARCAD1 নামের এই প্রোটিনটি। আর এটা ঠিকমতোই কাজ করছিল ওই পরিবারের সুস্থ সাতজন সদস্যের।
“SMARCAD1” এই জিনটি “SMARCAD1” নামের এই প্রোটিনটি তৈরি করতে সাহায্য করে। দুটি ধরনের হয় এই প্রোটিনটি। একটি Full length isoform বলা হয় এবং অপরটিকে বলা হয় Skin specific isoform। আর এই Skin specific isoform-ই ত্বকের কোষে প্রকাশিত হয়। তবে এটির সম্পর্কে বেশি কিছু জানা সম্ভব হয় নি। কিন্তু এটা সুনিশ্চিত হওয়া গেছে যে ‘ডার্মাটোগ্লিফস’ তথা হাতের রেখা তৈরিতে এর ভূমিকা রয়েছে যা প্রতিটি মানুষের আলাদা আলাদা ছাপ তৈরি করতে সাহায্য করে। তবে ছাপ তৈরি করতে যে শুধুমাত্র SMARCAD1 প্রোটিনই ভূমিকা রাখে তা কিন্তু নয়, এই প্রোটিনটি হল ছাপ তৈরিতে ভূমিকা রাখা প্রোটিনগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি।
মাতৃগর্ভে থাকাকালীন অবস্থায় প্রতিটি মানুষের ভিন্ন ভিন্ন ছাপ তৈরির ব্যাপারটি ঘটে। তবে এই প্রোটিনগুলো কীভাবে দায়ী সেই ব্যাপারে তেমন কিছু জানা সম্ভব হয়নি। গবেষকগণ সিকোয়েন্স করার পর নিশ্চিত হয়েছিলেন যে ওই পরিবারের আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাঝে এই জিনই মিউটেটেড/পরিবর্তিত হয়ে গেছে। ২০১১ সালে ‘অ্যাডার্মাটোগ্লিফিয়া’ বিষয়ে পিটার ইটিন, এলি স্প্রিচার এবং তাদের সহকর্মীবৃন্দ জার্নাল অব দ্য আমেরিকান একাডেমি অব ডার্মাটোলজিতে তাদের গবেষণাপত্র প্রকাশিত করেছিলেন।
এমনিতে এই বিরলতম রোগের আক্রান্ত ব্যাক্তিরা স্বাস্থ্যবানই থাকেন, তবে এদের ঘাটতি থাকে কিছু ঘর্মগ্রন্থির। যার কারনে এদের ত্বক সাধারণ মানুষের তুলনায় অনেক বেশি শুষ্ক হয়ে থাকে। এছাড়াও ফিঙ্গারপ্রিন্ট NFJS (Naegeli Franceschetti Jadassohn Syndrome) এবং ডার্মাটোপ্যাথিয়া পিগমেন্টোসা রেটিকুলারিস রোগেও তৈরি হয় না। তবে এই রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট না তৈরি হওয়ার পাশাপাশি কিছু গুরুতর শারীরিক সমস্যাও তৈরি হয়। যেমন- পাতলা ও ভঙ্গুর চুল, দাঁত, চামড়া, ঘর্মগ্রন্থিতে সমস্যা ইত্যাদি।
লেখার শুরুটা হয়েছিল অপু সরকার নামের এই ছেলেটি একটি সমস্যা তুলে ধরার মাধ্যমে। শুধু সেই নয় এই একই সমস্যা ছিল তার তার বাবা অমল সরকারেরও। এছাড়াও এই একই সমস্যাই আক্রান্ত ছিল তার দাদা এবং ভাইরাও। তার দাদা আগের যুগের মানুষ হওয়ার জন্য সেরকম কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি তবে প্রতিনিয়ত অপুদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে এই সমস্যার সাথে। হাতে ছাপ না থাকার কারণে পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, সিমকার্ড তোলার ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় যত বিড়ম্বনা। সেই কারণে অপু সরকাররা সিমকার্ড কিনতে তাদের মায়ের হাতের ছাপ ব্যবহার করে থাকেন।
তাদের এই রোগকে মেডিকেল বোর্ড ‘কনজেনিটাল পালমোপ্লান্টার কেরাটোডার্মা’ নামে অভিহিত করেছে এবং সার্টিফিকেটও ইস্যু করেছে। পিটার ইটিনের মতে, পরিবারটির বংশগত কেরাটোডার্মাই ‘সেকেন্ডারি অ্যাডার্মাটোগ্লিফিয়ায়’ রূপ নিচ্ছে। তারা যেহেতু হাতের ছাপ দিতে অক্ষম সেই জন্য নির্বাচন কমিশন থেকে জানানো হয়েছে যে চোখের রেটিনা স্ক্যান বা ফেসিয়াল রিকগনিশনের মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র, সিমকার্ড বা ড্রাইভিং লাইসেন্সের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এই রোগটি খুবই বিরল হওয়ার জন্যে এর তেমন কোনো চিকিৎসাও নেই। তবে যদি এই রোগের থেকে শারীরিক অন্য কোনো সমস্যা দেখা দেয় যেমন- ত্বক অধিক শুষ্ক থাকা, সেক্ষেত্রে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে গবেষকগণ মনে করেন যে বর্তমানে জেনেটিক্সের অগ্রগতির কারণে সামনের দিনগুলোতে জিন থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা করে সুস্থ হওয়া সম্ভব।