ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মত উত্থান হয়েছিল ইউরোপের। জানুন বিস্তারিত
সময়টা ১৯৪৫, বিগত ছয় বছর ধরে চলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। কিন্তু চারিদিকে তখন ধ্বংসস্তূপ ও সারি সারি মৃতদেহের স্তম্ভ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপকে পুরো অর্থনৈতিক ভাবে ধ্বংস করে দিয়েছিল। হ্যা কিছু দেশ যুদ্ধে জয়লাভ করেছিল ঠিকই কিন্তু তাদেরও সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা একদম খারাপ হয়ে গিয়েছিল। শিল্প বিপ্লবের ফলে বড়লোক হওয়া ইংল্যান্ডের মত দেশেরও অর্ধেকের বেশী সম্পদ যুদ্ধেই খরচ হয়ে গেছিল। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে খাদ্য সংকট সহ হাজার হাজার উদবাস্তু সমস্যা দেখা যায়। ইউরোপের বহু দেশ আমেরিকার কাছ থেকে প্রচুর লোন নিয়েছিল যুদ্ধের জন্য কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের যা অবস্থা হয় তাতে মনে হচ্ছিল এই লোন শোধ করা কোনওদিন সম্ভব নয় কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী আছে ইউরোপ আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছিল এবং বিশ্বের প্রধান একটি অর্থনৈতিক জোনে পরিনত হয়। কিন্তু কী করে এমন খারাপ অবস্থা থেকে ইউরোপ এই ভাবে শক্তিশালী অর্থনৈতিক কেন্দ্রে পরিনত হল? ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মত ইউরোপের এই উত্থান সম্পর্কেই আজ বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
আগেই বলা হয়েছে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর ইউরোপের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেছিল। ইউরোপের শক্তিশালী দেশ জার্মানি সহ, এশিয়ায় জাপান এই যুদ্ধে হেরে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুটি নতুন সুপার পাওয়ারের জন্ম হয় আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত ইউনিয়ন লিথুয়ানিয়া, রোমনিয়া, পোল্যান্ড ও আলবেনিয়ার মতন দেশ দখল করে সেখানে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠা করে। অন্যদিকে পশ্চিম ইউরোপে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয় এবং দেশ গুলো আমেরিকার প্রভাবে আসে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল নলেন ইউরোপ সেসময় দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। এইসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে স্নায়ু যুদ্ধ শুরু হয়। এই সময় পশ্চিম ইউরোপের পুনর্গঠন আলাদা ভাবে শুরু হয় এবং পূর্ব ইউরোপের গঠন আলাদা ভাবে শুরু হয়। পশ্চিম ইউরোপকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে আমেরিকা। আমেরিকা বিশেষ একটি মার্শাল প্ল্যান তৈরি করে। আমেরিকা এটা করেছিল নিজের স্বার্থে। কারন আমেরিকা চাই ছিলনা পূর্ব ইউরোপেের মতন পশ্চিম ইউরোপেও কমিউনিস্ট শাসন শুরু হোক। এই মার্শাল প্ল্যানই পশ্চিম ইউরোপকে নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছিল। এব্যাপারে একটু জানা যাক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গরীবি এবং বেকারত্বের ফলে পশ্চিম ইউরোপ কমিউনিস্ট ভাবধারায় আকৃষ্ট হতে পারে এই ভয়ে আমেরিকার সেক্রেটারি অফ স্টেট জর্জ মার্শাল ১৯৪৭ সালের ৫ জুন একটি বিশেষ প্ল্যান তৈরি করে যাকে মার্শাল প্ল্যান বলা হচ্ছে। এই প্ল্যানে আমেরিকা ইউরোপের দেশগুলোকে ১৩.৩ বিলিয়ন ডলার লোন দেয়। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত এটা চলে। প্রথমে সমস্ত ইউরোপীয়ান দেশ এমনকী সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্যও আমেরিকা এই প্ল্যান তৈরি করে। কিন্তু আমেরিকার সাথে শত্রুতার জন্য স্ট্যালিন এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় এবং পূর্ব ইউরোপীয়ান দেশ গুলোও ফিরিয়ে দেয়। যার ফলে শেষ পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপের ১৬ টি দেশের জন্যই এই প্ল্যান ছিল শেষ পর্যন্ত। এই প্ল্যানের লক্ষ্য ছিল ইউরোপের শিল্প ও বানিজ্য পুনরায় গঠন করা। ইউরোপকে অর্থ গ্রান্টের মাধ্যমে দেওয়া হত মানে ইউরোপের যাবতীয় জরুরী পন্যের দাম আমেরিকা দিত। আমেরিকা ইউরোপকে কারগরি সহায়তাও প্রদান করে। ইউরোপকে স্টুডেন্টদের আমেরিকাতে এনে শিক্ষা দেবার জন্য একটি বিশেষ ফান্ড গঠন করা হয়। প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলারের এই ফান্ডিং এ প্রায় ৫০০০ ইউরোপীয়ান ছাত্রকে আমেরিকাতে কারিগরি ও ম্যানেজমেন্টের শিক্ষা দেওয়া হয় যাতে ইউরোপে উতপাদন বাড়ে। মার্শাল প্ল্যানকে সঠিক ভাবে পরিচালনার জন্য দুটি সংস্থা গঠন করা হয়েছিল। একটি হচ্ছে আমেরিকা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ইকোনমিক কোঅপারেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা ইসিএ এবং আরেকটি ইউরোপীয়ানদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অরগানাইজেশান ফর ইউরোপীয়ান ইকোনমিক কোঅপারেশন বা ওইইসি। ইসিএ এর কাজ ছিল শিল্প উতপাদন, মার্কেটিং, কৃষিকাজ, যোগ্য লোক নির্বাচন, ভ্রমন ও ট্রান্সপোর্টেশন সেক্টর গুলো দেখা। ইসিএ এর কাজ ছিল ইউরোপকে ফুয়েল, খাদ্য ও মেশিনারি কেনবার জন্য অর্থ সাহায্য করা এবং ইউরোপে গুরুত্বপূর্ণ ইনফ্রাস্ট্রাকচারের জন্যও অর্থ সাহায্য করা। মার্শাল প্ল্যানে ইউরোপ দ্রুত গতিতে উন্নত হতে শুরু করে। ইউরোপের কৃষিকাজ, শিল্প ও বানিজ্যে ব্যাপক উন্নতি হয়। মার্শাল প্ল্যানের লক্ষ ছিল ১৯৩৮ এর তুলনায় ইউরোপের শিল্পকে ৩৫ শতাংশ এবং কৃষিকাজকে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা। কিন্তু ১৯৫১ সালে ইউরোপের শিল্প ৩৫ শতাংশ বাড়ে যা অনেক বেশী। ১৯৪৭ সালের তুলনায় ইউরোপের শিল্প ৫৫ শতাংশ এবং কৃষিকাজ ৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ইউরোপের সমস্ত সেক্টরে ৩৩ শতাংশ উন্নতি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সেভিংস বলতে কীছু ছিলনা, আমেরিকার জন্যই এই উন্নতি সম্ভব হয়েছিল। এটাতো গেল পশ্চিম ইউরোপের ঘটনা, এবার দেখা যাক পূর্ব ইউরোপে কী হয়েছিল।
পূর্ব ইউরোপের উন্নতিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন এগিয়ে আসে। আমেরিকার মার্শাল প্ল্যানের বিপরীতে সোভিয়েত বিদেশমন্ত্রী মলোটোভ একটি প্ল্যান তৈরি করে যাকো মোলোটোভ প্ল্যান বলা হয়। এর লক্ষ্য ছিল পূর্ব ইউরোপের আর্থিক বৃদ্ধি। ১৯৪৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিকন বা কাউন্সিল ফর মিউচুয়াল ইকোনমিক অ্যাসিস্ট্যান্স তৈরি করে। যার লক্ষ্য ছিল প্রত্যেকটি দেশের অর্থনীতি প্ল্যান করা। মলোটোভ প্ল্যানে সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ পূর্ব ইউরোপের দেশ গুলোর সমস্ত শিল্প সংস্থানকে সরকারি করে দেওয়া হয় এবং কৃষিকাজকে নিয়ন্ত্রন করত রাষ্ট্রের কীছু নির্দিষ্ট ফার্ম। এভাবে কীছুদিন পূর্ব ইউরোপের উন্নতি হয় কিন্তু ধীরে ধীরে পশ্চিম ইউরোপের তুলনায় পিছিয়ে পড়তে শুরু করে পূর্ব ইউরোপ তাদের জিডিপিও অনেক কমে যায়। আলবেনিয়াকে পূর্ব ইউরোপের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ দেশ বলা হয়। ১৯৮০ আসতে আসতে পূর্ব ইউরোপে জরুরি জিনিসের অভাব, মুদ্রাস্ফীতি দেখা যায় যারা জন্য ১৯৯১ আসতে আসতে পূর্ব ইউরোপীয়ান দেশ গুলো একে একে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আলাদা হয়ে যায়। ১৯৯১ সালে বার্লিন দেয়াল ভেঙে যাবার সাথে সাথে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। কিন্তু দীর্ঘদিন সোভিয়েত ব্লকে থাকার ফলে পূর্ব ইউরোে আরও পিছিয়ে পশ্চিম ইউরোপের থেকে।
পশ্চিম ইউরোপের উন্নতি শুধু মার্শাল প্ল্যানে হয় নি বরং পশ্চিম ইউরোপ নিজেও বিশেষ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল। পশ্চিম ইউরোপ বুঝতে পেরছিল তাদের অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী হতে হবে নাহলে তারা শক্তিহীন হয়ে পড়বে। সেসময় বিশ্বে সবচেয়ে বড় দুটি সুপার পাওয়ার হচ্ছে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। পশ্চিম ইউরোপ বুঝতে পারে তাদের উন্নতি দরকার নাহলে তারা সুপার পাওয়ারদের হাতের পুতুল হয়ে যাবে। পূর্ব ইউরোপে তখন সোভিয়েত আধিপত্য ফলে তারা কোন পদক্ষেপ নিতে পারে নি কিন্তু পশ্চিম ইউরোপীয়ান দেশ গুলো নিজেদের মধ্যে জোট গঠনের পরিকল্পনা করতে থাকে কারন একমাত্র এভাবেই তারা শক্তিশালী হতে পারবে৷ ইউরোপীয়ান দেশগুলো আয়তনে ছোট এবং তাদের অর্থনীতি এতটা বড় নয় যে একা উন্নতি করতে পারবে। তাছাড়া একসাথে থাকলে কমিউনিজমের প্রচার হবে না এবং ভবিষ্যতে নিজেদের মধ্যে কোন যুদ্ধ হবে না। জার্মানি ছিল এই ঐক্য জোটের প্রধান উদক্তা। কারন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লিগ অফ নেশেনসে যোগ দিতে জার্মানিকে ৮ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল সেজন্য জার্মানি এবার প্রথম থেকেই জোট গঠনে লক্ষ দেয়। এর জন্য ১৯৪৬ সাল দশটি ইউরোপীয়ান দেশের প্রতিনিধি ফ্রান্সের স্ট্রাসবাগ শহরে মিটিং করে ইউরোপীয়ান কাউন্সিল গঠন করে কিন্তু এটি তেমন সফল হয় নি। কিন্তু ইউরোপীয়ান ঐক্য জোটের স্বপ্ন এখান থেকেই শুরু হয়। ১৯৫০ সালে ফ্রান্সের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জো মোনেট ও ফ্রান্সের বিদেশমন্ত্রী রবার্ট সুম্যান একটি নতুন পরিকল্পনা তৈরি করে যাকে বলা হয় সুম্যান প্ল্যান। এর লক্ষ ছিল যৌথ ভাবে স্টিল ও কয়লা উৎপাদন, এর জন্য গঠন হয় ইউরোপীয়ান স্টিল এন্ড কোল কমিউনিটি যার প্রথম প্রেসিডেন্ট হন জো মোনেট। এর সদস্য ছিল ছয়টি দেশ নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, ইটালি, জার্মানি ও লুক্সেমবার্গ। এই সংস্থাকে পরিচালনার জন্য আরও একটি ইন্সটিটিউট গঠন করা হয় যার মুখ্য কার্যালয় লুক্সেমবার্গে হয়। ১৯৫৭ এ এই ছয়টি দেশ ট্রিটি অফ রোম সাইন করে, যার লক্ষ ছিল নিজেদের ভিতর কোন ট্যাক্স না রাখা এবং বাইরে থাকা আসা জিনিসে একটি মিলিত ট্যাক্স রাখা। আরও স্বচ্ছ সম্পর্কের জন্য চরটি নতুন ইন্সটিটিউট তৈরি করা হয় কাউন্সিল অফ মিনিস্টারস, ইউরোপীয়ান কোর্ট অফ জাস্টিস, ইউরোপীয়ান পার্লামেন্ট ও ইউরোপীয়ান কমিশন। এর ফলে ছয়টি দেশের সম্পর্ক অত্যন্ত মজবুত হয়, বিশেষ করে ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি ও ইটালির মজবুত বন্ধুত্ব তৈরি হয়। এই জোটের দেশ গুলো বাকী ইউরোপীয়ান দেশ গুলোর তুলনায় দ্বিগুণ উন্নয়ন শুরু করে।
১৯৫৩ সালের পর ফ্রান্সেী উৎপাদন ক্ষমতা ৭৫ শতাংশ বেড়ে যায় এবং জার্মানির ৯০ শতাংশ বেড়ে যায়। ধীরে ধীরে বাকী ইউরোপীয়ান দেশ গুলো এর প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করে। প্রথমে ব্রিটেন এই জোটে যোগ দিতে চায়নি কিন্তু এই জোটের সাফল্য দেখে ১৯৬০ সালে দুবার এই জোটে যোগ দেবার জন্য আবেদন করে ব্রিটেন কিন্তু ফ্রান্স ভেটো দিয়ে আটকে দেয় কারন ফ্রান্স ব্রিটেন ও আমেরিকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে পচ্ছন্দ করত না কারন ফ্রান্স মনে করত ব্রিটেন ইউরোপকে নিয়ন্ত্রন করতে চায়। অবশেষে ১৯৭৩ সালে তৃতীয় বারের চেষ্টায় ব্রিটেন যোগ দেয় এই জোটে, আয়ারল্যান্ড ও ডেনমার্কও যোগ দেয়। ১৯৮০ সালে পর্তুগাল, গ্রীস ও স্পেন যোগ দেয়। এভাবে সদস্য সংখ্যা বেড়ে ছয় থেকে বারো হয়। ১৯৯১ সালে নেদারল্যান্ডসের ম্যাসট্রেট শহরে এক বৈঠকে ইউরোপীয় কমিশনের নাম বদলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন করে দেওয়া হয়। নতুন একটি চুক্তি হয় যাকে বলা হয় ম্যাসস্ট্রেট চুক্তি। যাতে সব দেশে একই কারেন্সি, কমন নাগরিকত্ব, ফ্রী ট্রেড সহ একাধিক প্রস্তাব রাখা হয়। ধীরে ধীরে পূর্ব ইউরোপীয়ান অনেক দেশও এতে যোগদান করে। এভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ানক দুঃস্বপ্ন থেকে বেড়িয়ে এসে একটি অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ার তৈরি হয় ইউরোপ। এই ঘটনা প্রমান করে ঐক্য থাকলে উন্নতি সম্ভব। আজও ইউরোপীয় ইউনিয়নই ইউরোপকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছে।