ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের ৯৩ হাজার বন্দীদেরকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন?
নিজস্ব সংবাদদাতা:১৯৭২-এর ২ অগাস্ট দিনটি ভারতের ইতিহাসে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আট মাস আগে ১৩ দিনের ভারত-পাক যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এই দিনই দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় সিমলা চুক্তি। ৭১-এর যুদ্ধ চলাকালীন বন্দী করা ৯৩০০০ পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিকে এদিন চুক্তি অনুযায়ী ভারত ফিরিয়ে দিতে রাজি হয়। বিতর্কিত এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সেই সময় যথেষ্ট জল ঘোলাও হয়। বন্দীদের তুরুপের তাস করে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কেন পাকিস্তানের সাথে কাশ্মীর নিয়ে দরাদরি করেনি তা নিয়েও উঠেছিল প্রশ্ন। ঠিক কি কারনে ইন্দিরা গান্ধী পাক বন্দীদের ছেড়ে দিতে রাজি হয়ে যান? বা এর পেছনে আসল গল্পই বা বাকি ছিল? তা নিয়ে হাজার বিতর্ক দেখা দিলেও দীর্ঘ 40 বছর ধরে আসল কাহিনী রয়ে গিয়েছিল গোপনেই। কোনদিনই তা আসেনি প্রকাশ্যে। কিন্তু, যুদ্ধের দীর্ঘ বহু বছর পর এতদিনে এই রহস্যের উদঘাটন করেছেন অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিবিদ শশাঙ্ক বন্দ্যোপাধ্যায়।
THE WIRE পত্রিকায় ফুটে উঠেছে এই ঘটনার যাবতীয় ইতিহাস। কূটনীতিবিদ শশাঙ্ক বন্দ্যোপাধ্যায় পত্রিকায় লিখেছেন ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পাক সেনাবাহিনী ভারতীয় সেনা ও বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে তা ভারত ও বাংলাদেশের জন্য এক স্মরণীয় মুহূর্ত হয়ে উঠেছিল ঠিকই কিন্তু ভারতের তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধী সম্মুখীন হয়েছিলেন এক অন্য বিপদের। একদিকে যুদ্ধে এমনিতেই ভারতের বিপুল অর্থ খরচ হয়ে গেছিল। তার ওপর পাক সেনার অত্যাচারের সীমান্ত পার করে আসা এক কোটি শরণার্থী সেই চাপ বাড়িয়েছিল অনেকটাই। এছাড়া ৯৩০০০ যুদ্ধবন্দীকে দেখভালের আলাদা খরচ তো ছিলোই।
তাছাড়া, সেই সময় ইন্দিরা গান্ধীর মূল লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল, শেখ মুজিবর রহমানকে নিরাপদে দেশে ফেরানো। বাংলাদেশের এই স্বাধীনতা সংগ্রামীকে পাকিস্তান ফাঁসি দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল। ইন্দিরা গান্ধী হৃদয় থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিলেন আর তাই এই খবর তার কাছে হয়ে উঠেছিল এক বিশাল বড় দুঃস্বপ্ন। বাংলাদেশকে অনাথ দেখতে চাননি তিনি। চাননি বাংলাদেশের স্বপ্ন ভেঙ্গে ফেলতে। তাই যেনো তেনো প্রকারে মুজিবর রহমানকে বাংলাদেশের ফিরিয়ে আনার জন্য যে কোন মূল্য দিতে রাজি ছিলেন তিনি। এই সমস্ত কথা জানতেন কেবল একজনই, তৎকালীন RAW প্রধান রাম নাথ রাও।
অপরদিকে পরাজয়ের অপমান সহ্য না করতে পেরে আমেরিকায় থাকা জুলফিকর আলি ভুট্টোকে ফোন করে পদত্যাগ করেন তৎকালীন পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহা খান। এতো বড়ো ঘটনা শুনে তড়িঘড়ি রাওয়ালপিন্ডির বিমান ধরেন ভুট্টো।সেই সময় ভুট্টোর ফেরার খবর পেয়েই তড়িঘড়ি বিদেশমন্ত্রকের উপদেষ্টা দূর্গা প্রসাদ ধর, RAW প্রধান রাম নাথ কাও, প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি পিএন হাসকার, বিদেশ সচিব টিএন কাউলকে নিয়ে এক জরুরি মিটিং ডেকেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী।বিমান রিফুয়েলিং-এর জন্য ভুট্টোর থামার কথা ছিল হিথরো বিমানবন্দরে। মুজিবর রহমানকে নিয়ে ঠিক কি পরিকল্পনা করা হচ্ছে তা জানার জন্য ইন্দিরা গান্ধী চেয়েছিলেন সেইসময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকুক কোনও ভারতীয় প্রতিনিধি।
পূর্ব পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারি মুজফ্ফর হোসেন ওই সময় যুদ্ধবন্দী হিসাবে ডিপি ধরের বাড়িতে অতিথির মর্যাদায় ছিলেন। অপরদিকে তাঁর স্ত্রী লায়লা লন্ডনে থাকায় স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যোগাযোগ হতো কূটনীতিকদের মাধ্যমেই। অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিবিদ শশাঙ্ক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থায় তিনিই দুজনের মধ্যে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠায় মিয়া বিবি দুজনের সাথেই বেশ ভালো সম্পর্কে স্থাপন হয়ে গেছিলো তার। এই লায়লা ছিলেন আবার ভুট্টোর একসময়ের বান্ধবী। ঠিক এই জিনিসটাকেই কাজে লাগান ইন্দিরা। ভুট্টোর সঙ্গে কথা বলতে পাঠান তিনি লায়লাকে। উদ্দেশ্য ছিল একটাই। মুজিবরকে নিয়ে পাকিস্তান ঠিক কি ভাবছে তা জানতে পারা। শশাঙ্ক বন্দ্যোপাধ্যায়ই লায়লাকে অনুরোধ করেন যাতে তিনি হিথরো বিমানবন্দরে গিয়ে একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভুট্টোকে বলেন, তাঁর যুদ্ধবন্দী স্বামীকে ভারত থেকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করতে। সেইমত এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে লায়লা দেখা করেন ভুট্টোর সাথে। কথা শেষ হলে লায়লাকে অবাক করে দিয়ে কানে কানে একটি বার্তা দেন তিনি। জানান” আমি জানি তুমি আসলে ঠিক কি জানতে এসেছিলে। ইন্দিরা গান্ধীকে আমার তরফ থেকে একটা মেসেজ দিও।বোলো, আমি মুজিবর রহমানকে মুক্তি দেব। কিন্তু তার বদলে আমার কি চাই সেটা পরে জানাবো’।
কথা মতো সেই বার্তা জানিয়েছিলেন লায়লা। তবু সন্দেহ একটা ছিলোই। ভারতকে ভুল পথে চালিত করছেন না তো ভুট্টো? কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই সেই সন্দেহের অবসান ঘটে। খবরটা ছিল সত্যিই। মুজিবর রহমানের মুক্তির বদলে পাকিস্তান ফেরত চেয়েছিল তাদের ৯৩০০০ যুদ্ধবন্দিকে। কথা মতো ১৯৭২-এর ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান ছেড়ে দিয়েছিল মুজিবর রহমানকে। ফিরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি এবং এই ঘটনার ঠিক আট মাস পরেই ভারত থেকেও ছেড়ে দেওয়া হয় সমস্ত পাক যুদ্ধবন্দিদের।