উত্তর কোরিয়া কেন এত পরিমানে পরমানু অস্ত্র তৈরি করছে?
রাজেশ রায়:– বর্তমানে বিশ্বে বেশীরভাগ দেশ গনতান্ত্রিক তবে বেশ কিছু দেশে এখনও সেনা শাসন চলে কিংবা কমিউনিজমের একনায়কতন্ত্র চলে। তবে পৃথিবীতে এমনও একটি দেশ আছে যাকে বলা হয় গনতান্ত্রিক রাজতান্ত্রিক দেশ। এটা শুনে অনেকেই হয়ত ভাববেন এটা কেমন অদ্ভুত কথা! কোন দেশ একসাথে গনতান্ত্রিক আবার রাজতান্ত্রিক দুটো একই সাথে, এমন আবার হয় নাকী!! কিন্তু হ্যাঁ এমনও হয় যার সবচেয়ে বড় উদাহারন উত্তর কোরিয়া। এই দেশটার নাম শুনলেই মনে হয় পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন এমন এক দেশ যেখানে স্বৈরাচারী শাসক রয়েছে। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার আসল নাম জানেন কী! উত্তর কোরিয়ার আসল নাম হচ্ছে ডিপিআরকে বা ডেমোক্রেটিক পিপলস রিপাবলিক অফ কোরিয়া। উত্তর কোরিয়া নিজেকে গনতান্ত্রিক দেশ হিসাবেই পরিচয় দেয় অনেকটা সোনার পাথর বাটির মতন। উত্তর কোরিয়ার বর্তমান রাষ্ট্রপতি হচ্ছে কিম জং উন, যাকে আধুনিক যুগের হিটলার বলা হয়। অত্যন্ত গরীব ও ছোট দেশ হওয়া সত্বেও উত্তর কোরিয়ার কাছে প্রচুর পরমানু হাতিয়ার আছে। উত্তর কোরিয়ার পরমানু বোমাবাহী ক্ষেপণাস্ত্র আমেরিকাতেও আঘাত হানতে সক্ষম। পশ্চিমা কোন দেশের সাথে ঝামেলা হলেই পরনানু হামলার হুমকী দেয় উত্তর কোরিয়া। সম্প্রতি দেশটিতে এমন একটি আইন পাশ করানো হয়েছে তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এই বিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। সাথে এটাও আলোচনা করা হবে উত্তর কোরিয়া কেন এত পরমানু অস্ত্র তৈরি করছে?
উত্তর কোরিয়ার সংসদে একটি আইন পাশ করানো হয়েছে যদি দেশটির রাষ্ট্রপতি কিম জং উনের উপর কোন আক্রমন হয় তাহলে পরমানু মিসাইল হামলাকে অটোমেটিক মোডে রাখা হবে। প্রথমেই বলা দরকার উত্তর কোরিয়ার মতন দেশে সংসদ থাকার ব্যাপারটা সত্যিই হাস্যকর, দেশটিতে তাদের সংসদ ভবনকে বলা হয় সুপ্রিম পিপলস পার্লামেন্ট। এই আইনের মাধ্যমে উত্তর কোরিয়া যেকোন যুদ্ধে প্রথমেই যে পরমানু হাতিয়ার ব্যাবহার করনে তা জানিয়ে রাখল। বলা হচ্ছে উত্তর কোরিয়া আবার তাদের পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা শুরু করবে। ২০১৭ সালে তৎকালীন আমেরিকান রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি কিম জং উনের মধ্যে একটি ঐতিহাসিক বৈঠক হয়েছিল পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা বন্ধ করতে কিন্তু ২০১৮ সালে তা ব্যার্থ হয়ে যায়। তারপর আবারও নতুন করে পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা শুরু করার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে দেশটিতে। ২০১৩ সালেও উত্তর কোরিয়াতে পরমানু অস্ত্র লঞ্চ নিয়ে আইন এসেছিল তবে তখন অটোমেটিক শব্দটা ছিলনা। ২০২২ সালের নতুন আইন ২০১৩ সালের আইনকে পরিবর্তন করবে। নতুন আইনে পাঁচ ধরনের পরিস্থিতিতে অটোমেটিক পরমানু মিসাইল লঞ্চের কথা বলা হয়েছে। যদি উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি কিংবা তার ঘনিষ্ঠ কারও উপর আক্রমন হয়, যদি দেশটির জননগনের উপর আক্রমন হয় কিংবা যদি কোন যুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার হেরে যাবার সম্ভবনা থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়া অটোমেটিক পরমানু হামলা করবে।
গত এপ্রিল মাসে কিম জং উন এই ধরনের আইন আনার আভাস দিয়েছিল। সংসদে কিম জং উন জানিয়েছে যদি তাদের উপর একশো বছরের আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আসে তাও তারা পরমানু অস্ত্র তৈরি বন্ধ করবেনা। সোজা কথায় এর মাধ্যমে উত্তর কোরিয়া তার শত্রু দেশ দক্ষিন কোরিয়া, জাপান ও আমেরিকাকে হুমকী দিয়ে রাখল। এখানে উত্তর কোরিয়ার বলা অটোমেটিক শব্দটার অর্থ সঠিক ভাবে বলা সম্ভবনা কারন এটা একমাত্র উত্তর কোরিয়াই জানে। হতে পারে উত্তর কোরিয়া বিশেষভাবে কোন সফটওয়্যার তৈরি করেছে যাতে এমনভাবে কোডিং করা হয়েছে যে জরুরী পরিস্থিতিতে নিজের থেকেই পরমানু অস্ত্র লঞ্চ হয়ে যাবে। উত্তর কোরিয়ার পরমানু অস্ত্র নিয়ন্ত্রন করে দেশটির সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন সুতরাং তিনিই বিশেষ ভাবে কোন কোড ইনস্টল করেছেন হয়ত। উত্তর কোরিয়া এটাও জানিয়েছে নন নিউক্লিয়ার দেশ অর্থাৎ যাদের কাছে পরমানু অস্ত্র নেই তাদের উপর তারা পরমানু হামলা করবেনা কিন্তু সেইসব দেশ গুলো যদি উত্তর কোরিয়াকে আক্রমন করে কিংবা কোন পরমানু শক্তিধর দেশকে সহায়তা করে তাহলে এই নিয়ম মানা হবেনা।
সম্প্রতি দক্ষিন কোরিয়া তাদের একটি স্ট্রাটেজি প্রকাশ করেছে যার নাম দেওয়া হয়েছে কিল চেন নীতি। যদি দক্ষিন কোরিয়া বুঝতে পারে উত্তর কোরিয়া হামলা করবে তাহলে আগে থেকেই উত্তর কোরিয়ার যেসব জায়গায় পরমানু অস্ত্র থাকতে পারে সেখানে দক্ষিন কোরিয়া আক্রমন করবে, একেই বলে কিল চেন নীতি। এরপরই উত্তর কোরিয়া তাদের নতুন আইন প্রকাশ করে। এব্যাপারে আমেরিকা জানিয়েছে তারা উত্তর কোরিয়ার সাথে কোনরূপ ঝামেলা চায়না, কুটনৈতিক ভাবে তারা এই সমস্যা সমাধানে আগ্রহী। রাশিয়া ও চীন বিশ্বের এই দুটি মাত্র দেশের সাথে উত্তর কোরিয়ার ভালো সম্পর্ক আছে। বলা হয় চীনই উত্তর কোরিয়াকে পরমানু বোম্ব বানানোর প্রযুক্তি দিয়েছে। এটাও শোনা যাচ্ছে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র কিনছে। আমেরিকা, দক্ষিন কোরিয়া সহ অনেক দেশই বারবার উত্তর কোরিয়াকে অনুরোধ করেছে তাদের পরমানু অস্ত্র নিরস্ত্রীকরন চুক্তিতে সই করতে, এর বদলে তারা উত্তর কোরিয়াকে মোটা অর্থ দেবে কিন্তু উত্তর কোরিয়া এখনও রাজি হয়নি।
আমেরিকার থেকেও দক্ষিন কোরিয়া সবচেয়ে বেশী ভয়ে থাকে উত্তর কোরিয়াকে নিয়ে। কারন দক্ষিন কোরিয়ার কাছে পরমানু অস্ত্র নেই এবং উত্তর কোরিয়ার সাথে সীমানা রয়েছে দক্ষিন কোরিয়ার। যদিও আমেরিকা দক্ষিন কোরিয়াকে নিরাপত্তা দেয় তবুও কিম জং উনের মত স্বৈরাচারী শাসকের উপর কোন বিশ্বাস রাখা সম্ভব নয়। উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিন কোরিয়ার এই ঝামেলা আজকের নয় সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এর শুরু। জাপান আত্মসমর্পন করবার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। বিশ্বে উদয় হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকা নামে দুই সুপার পাওয়ারের। কমিউনিজম নাকী ক্যাপিটালিজম কোনটা ঠিক, কার অর্থনীতি ব্যাবস্থা বেশী মজবুত এসব নিয়ে এই দুই শক্তিশালী দেশের মধ্যে শুরু হয় ঠান্ডা লড়াই যা বিশ্বকে দুই মেরুতে ভাগ করে দেয়। কোরিয়ান দ্বীপে কার অধিকার থাকবে সেই নিয়ে চারটি দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয় আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও ইংল্যান্ড। আজকের যেটা উত্তর কোরিয়া সেই অংশ সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে ছিল।
কোরিয়ান দ্বীপের ঝামেলা মেটানোর জন্য জাতিসংঘ পুরো দ্বীপে নির্বাচনের প্রস্তাব দেয়। জাতিসংঘে আমেরিকার প্রভাব রয়েছে এই অভিযোগে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার অংশে কোন ভোট করায়নি কিন্তু আমেরিকা তার অংশে ভোট করিয়েছিল। ১৯৪৮ সালে কোরিয়া ভাগ হয়ে তৈরি হয় উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিন কোরিয়া। কিন্তু দুই দেশের সীমানা নিয়ে ঝামেলার জোড়ে ১৯৫০ সালের ২৫ জুন উত্তর কোরিয়া আক্রমন করে দক্ষিন কোরিয়াকে। যার জন্য দুই দেশের সাথে অনেক দেশের আলোচনা হয় যুদ্ধ থামানোর জন্য, ভারতও এর মধ্যে ছিল। ঠান্ডা যুদ্ধের সম ভারত সহ বেশ কিছু দেশ আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন কোন পক্ষেই যোগ না দিয়ে জোট নিরপেক্ষ ছিল। সেজন্য ভারত দুই কোরিয়ার সাথেই আলোচনা করছিল। ১৯৫৩ সালে দুই কোরিয়ার মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী ৩৮ তম প্যারালাল লাইনের মাধ্যমে দুই দেশের সীমানা নির্ধারন হয় এবং দুুই দেশের সীমানার মাঝে কিছু অংশ বাফার জোন হিসাবে ঘোষনা করা হয় অর্থাৎ এখানে কোন পক্ষই সেনা রাখতে পারবেনা। এরই মধ্যে আমেরিকা জানায় যদি ভাবিষ্যতে দরকার পড়ে তাহলে আমেরিকা জাপান ও দক্ষিন কোরিয়াকে পরমানু সহায়তা করবে। আমেরিকার এই বক্তব্য শুনে বাধ্য হয়ে উত্তর কোরিয়া ২০০৩ সালে পরমানু নিরস্ত্রীকরন চুক্তি থেকে বেড়িয়ে যায় এবং ২০০৬ সালে ভূগর্ভে প্রথম পরমানু বোম্ব পরীক্ষা করে। ২০১৭ সালের মার্চে দক্ষিন কোরিয়াতে ব্যালিস্টিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম থাড ইনস্টল করে আমেরিকা যার ফলে এই এলাকায় আরও উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। ২০২২ এর জানুয়ারিতে উত্তর কোরিয়া সাতটি পরমানু মিসাইল পরীক্ষা করে যার পর দেশটির উপর আরও কোঠর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চাপানো হয়। কিন্তু নিজের ভূখন্ডকে রক্ষা করতে উত্তর কোরিয়া পরমানু অস্ত্র তৈরির কাজ চালিয়েই যাবে এমনটাই ঘোষনা করেছে দেশটির রাষ্ট্রনায়ক কিম জং উন।