অফবিট

পৃথিবীর ইতিহাসে সবথেকে ছোটো যুদ্ধ কোন কোন দেশের মধ্যে হয়েছিল জানেন? যুদ্ধের সময় ছিল মাত্র ৩৮ মিনিট

এখনো পর্যন্ত যে কটা যুদ্ধ হয়েছে সেই সকল যুদ্ধের বয়স দেখা গিয়েছে ১০০ দিন কিংবা কয়েক মাস অথবা কয়েক বছর। কিন্তু গোটা পৃথিবীতে এবং ইতিহাসে সবচেয়ে কনিষ্ঠতম যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত অ্যাংলো — জানজিবার যুদ্ধ। ১৮৯৬ সালে ইংরেজদের সঙ্গে ঘটা সেই সময়কার আফ্রিকার অধিপতি খালিদ বিন বারঘাশের ৩৮ মিনিটের যুদ্ধ জায়গা দখল করে নিয়েছিল ইতিহাসে। কেন হয়েছিল এই যুদ্ধ এবং কে জিতেছিল এই যুদ্ধে?

সময়কালটা ছিল উনবিংশ শতাব্দীর একদম শেষ অর্থাৎ ১৮৯৬ সাল। সেই সময় আফ্রিকার শাসনতন্ত্র মজবুত না হওয়ার কারনে আফ্রিকাকে নিয়ন্ত্রণ করত একাধিক দেশ অর্থাৎ তার অভিভাবকের ভূমিকা পালন করত ফ্রান্স,‌ ব্রিটেন এবং জার্মানের মতো দেশগুলি। সুতরাং ,আফ্রিকা সবুজ প্রাকৃতিতে সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে সেখানে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল ইউরোপের শক্তিশালী দেশগুলি। সেই ঔপনিবেশকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছিল ‌অ্যাংলো-জানজিবার যুদ্ধটি। যদিও ৩৮ মিনিটের ওই সংঘর্ষকে অনেকেই যুদ্ধ বলে মানতে নারাজ। যাই হোক, ১৮৯৬ সালে আফ্রিকার সুলতান জানজিবারের ব্রিটিশবান্ধব ছিলেন সুলতান হামাদ বিন থুয়াইনি। সিংহাসনে বসার মাত্র তিন বছরের মধ্যেই ১৮৯৬ সালের ২৫শে আগস্ট মৃত্যু হয়েছিল তার। সুলতানের আচমকা মৃত্যু হওয়াতে সিংহাসনে বসেছিলেন তারই কাকাতো ভাই খালিদ বিন বারঘাশ। হঠাৎ করেই সুলতানের বদল ঘটা অনেকই মেনে নিতে পারেননি। আফ্রিকার একাংশ মানুষ মনে করেছিলেন যে সুলতান কে বিষ খাইয়ে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেছেন নতুন সুলতান। নতুন সুলতান খালিদ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পক্ষপাতি ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন আফ্রিকা যেন সার্বভৌমত্ব ফিরে পায়। তার বড় কারন ছিল যে তৎকালীন আফ্রিকায় প্রচলিত দাস বাণিজ্যের মাধ্যমে বড় অংকের লাভ করতে পারা। কিন্তু ব্রিটিশরা ক্ষমতা অধিগ্রহণের পর দাস বাণিজ্য পুরোপুরি বিলুপ্ত করে দিয়েছিল। আর সেই বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই ব্রিটিশদের উপর মনে মনে খুশী ছিলেন না খালিদ। অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকারেরও ইচ্ছা ছিল ওই দেশের শাসনভার সামলাবে হামোদ বিন মুহাম্মাদ। সে কারণেই একই বছরে ২৭শে আগস্ট সকাল ৯ঃ০০ টা পর্যন্ত খালিদের জন্য সময় বেঁধে দিয়েছিল ইংরেজ। যাতে এই সময়ের মধ্যে সিংহাসন ত্যাগ করে তার দায়িত্ব তুলে দেয় অন্যের হাতে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের কোনরকম নির্দেশই মানেননি‌ সুলতান খালিদ।

সুলতান খালিক মনে করেছিলেন যে সরকার তাকে ঠকিয়ে গোটা রাজত্ব হাতানোর চেষ্টা করছে। সেই কারণে নিজেই গোটা প্রাসাদ সাজিয়ে ফেলেছিলেন সৈনিকে এবং প্রস্তুত রেখেছিলেন যুদ্ধের কামানাস্ত্র। যথা সময় হতেই অর্থাৎ সকাল ৯টা বাজতেই সিংহাসন ত্যাগ না করার কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন খালিদ। এরপর পুরো ঘটনার কমান্ড অফিসার রিয়্যার অ্যাডমিরাল হ্যারি রওসনের আদেশে প্রাসাদের রাখা বিশ্বের অন্যতম সেরা পাঁচটি রয়্যাল নেভি জাহাজের মধ্য থেকে সুলতানের মহলে ছোড়া শুরু হয়েছিল গোলা বারুদ।

ব্রিটিশ সরকারের কাছে উপস্থিত ছিল বিশ্বের পাঁচটি সেরা জাহাজ। সুলতানের কাছে ছিল রানী ভিক্টোরিয়ার দেওয়া উপহার গ্লাসগো। যুদ্ধ শুরু হতেই ব্রিটিশ সরকারের সামনে বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি খালেদের সেনাবাহিনী। সুলতানের প্রায় ৩০০০ সেনাবাহিনীর মধ্যে ব্রিটিশ সরকারের হাতে মৃত্যু হয়েছিল ৫০০ জনের, বাকিরা যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ছেড়ে পালিয়ে যান ময়দান থেকে। অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে মৃত্যু হয়েছিল মাত্র একজন সৈনিকের। সুতরাং এখানে বলা যেতেই পারে যে সুলতানের কাছে লোকবল থাকলেও ব্রিটিশদের কাছে ছিল যুদ্ধের অধিক সরঞ্জাম। সে কারণে যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র ৩৮ মিনিটের মধ্যেই প্রতিপক্ষের সিংহভাগ সৈন্য ময়দান ছেড়ে দেওয়ায় সমাপ্তি ঘটেছিল সেই যুদ্ধের। এরপর অবশ্য সিংহাসন ত্যাগ করার সম্মতি জানিয়েছিলেন সুলতান খালিদ।

ব্রিটিশরা যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেয়ার কিছুকাল পরই, দেশটির ক্ষমতা তাদের পছন্দসই ব্যক্তির হাতে তুলে দেয়। এর এক বছর পর জানজিবারে দাসপ্রথা আইন করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। যদিও প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত দেশের রাজনৈতিক শাসনভার সামলেছিল ব্রিটেন সরকার। ১৯৬৩ সালে অর্থাৎ ৬৭ বছরের এই অভিভাকত্ব ত্যাগ করতে হয়েছিল ব্রিটেনকে। যার কারণে আফ্রিকার এই দায়িত্ব হাতে নিয়েছিল তাঙ্গানিকা। এরপর তাঙ্গানিকার‌ তান এবং জানজিবারের জান শব্দের সমন্বয়ে দেশটির নতুন নাম রাখা হয়েছে তানজানিয়া। এই মুহূর্তে জানজিবার তানজানিয়ার একটি আধা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে পরিচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *