অর্থ থাকলেই রাশিয়ার সংসদে জায়গা পাওয়া সম্ভব। কতোটা দুর্নীতি রয়েছে রাশিয়াতে জানেন?
ভ্লাদিমির পুতিন প্রেসিডেন্ট হয়েই এক নতুন রাশিয়ার গঠন শুরু করেন। তিনি যখন দায়িত্ব নিয়েছিলেন সেইসময় রাশিয়া অত্যন্ত গরীব ও দুর্নীতিতে ভর্তি ছিল কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি পুনর্গঠন শুরু করেন। দেখুন ভ্লাদিমির পুতিন কেজিবি এজেন্ট ছিল, সুতরাং তার ট্রেনিং অত্যন্ত বিশেষ ছিল। সেইজন্য তিনি খুব সহজেই রাশিয়ার কন্ট্রোল নিজের হাতে নেন। বলা হয় রাশিয়াতে নামে গনতন্ত্র থাকলেও আদতে পুতিন পুরো একজন একনায়ক। তার বিরুদ্ধে পলিটিক্যাল মার্ডারের অভিযোগ আছে অনেক যদিও এসবের সত্যতা কোনওদিন প্রমান হয় নি। তিনি এক শক্তিশালী রাশিয়া তৈরি করে যদিও এখনও দারিদ্র্যতা পুরোপুরি যায়নি তবুও ২০০০ সালের থেকে ভাল জায়গায় নিয়ে এসেছেন তিনি এমনটাই মত বিশেষজ্ঞদের। রাশিয়ার ভালোর জন্য পুতিন অনেক প্রকল্প শুরু করে তিনি গ্যাস পাইপ লাইন প্রজেক্ট শুরু করেন যেমন নর্ড স্ট্রিম ১ ও নর্ড স্ট্রিম ২ গ্যাস লাইন যা বাল্টিক সাগর হয়ে জার্মানি পর্যন্ত গেছে। রাশিয়াতে প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডার আছে যা থেকে বছরে বিলিয়ন ডলার আয় হয় রাশিয়ার। রাশিয়াতে পুরো শিল্পাঞ্চলের চেন তৈরি করে পুতিন। অপরাধ কমানোর জন্য তিনি নতুন ক্রিমিনাল আইন আনেন এবং ট্যাক্স ফাঁকি বন্ধ করার জন্য নতুন আইন আনেন। পরিবেশের ক্ষেত্রেও তিনি বিশেষ গুরুত্ব দেন। সর্বোপরি তিনি রাশিয়ার যথেষ্ট উন্নয়ন করেন।
সামরিক ক্ষমতায় তিনি রাশিয়াকে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শক্তিতে পরিনত করেন, রাশিয়ার মত পরমানু অস্ত্রের ভান্ডার কারও নেই। অস্ত্র বিক্রিতে রাশিয়া বিশ্বে দ্বিতীয়। সব ঠিক আছে কিন্তু এখনও রাশিয়াতে ভয়ানক দুর্নীতি হয়। বলা হয় রাশিয়ার সংসদে জায়গা পেতে গেলেও প্রচুর পয়সা লাগে, কোনও প্রজেক্ট পেতে গেলেও প্রেসিডেন্টকে প্রচুর উপহার দিতে হয়। ২০০০ সালে রাষ্ট্রপতি হবার আগেও পুতিনের অর্থনৈতিক অবস্থা অতটা ভাল ছিলনা কিন্তু এখন পুতিনের পয়সা বিল গেটসের থেকেও বেশী কিন্তু পুতিন কিছু প্রকাশ করে না। ততকালীন রাশিয়ার সবচেয়ে বড়লোক ব্যাক্তি ছিলেন মিখাইল খোদোরস্কি তার ইউকোস অয়েল নামে বিশাল তেল ও গ্যাস কোম্পানি ছিল, তার বিরুদ্ধে ট্যাক্স ফাঁকি দেবার মামলা শুরু হয় তার কোম্পানি দেওলিয়া হয়ে যায় এবং এই কোম্পানি কিনে নেয় রোসনেফ্ট নামে একটি কোম্পানি যার ৯১ শতাংশ শেয়ার ভ্লাদিমির পুতিনের, তাহলেই ভাবুন রাশিয়াতে পুতিনের ক্ষমতা কতটা!! তার কথাই শেষ কথা, আসলে চীন ও রাশিয়া দুটোই ডিক্টেটরশিপের আওতায় থাকা দেশ যেখানে প্রেসিডেন্টের কথাই শেষ কথা।
১৪ মার্চ, ২০০৪ সালে পুতিন ৭১ শতাংশ ভোটে জিতে দ্বিতীয় বারের মতন রাশিয়ান প্রসিডেন্ট হন। রাজনৈতিক হত্যার অভিযোগ পুতিনের বিরুদ্ধে অনেক আছে যেমন অ্যানা পোলিতকোভাসকায়া নামে এক সাংবাদিক পুতিনের চেচেনিয়া তে গন হত্যার বিরুদ্ধে অনেক প্রমান সংগ্রহ করেছিল কিন্তু ২০০৬ সালের ৭ অক্টোবর পুতিনের জন্মদিনের দিন অ্যানাকে তারই বাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয়। যা আন্তর্জাতিক স্তরে অনেক সমালোচনা করে রাশিয়াকে কিন্তু পুতিনের কিছু যায় আসে নি। ২০১১ সালে পুতিনের বিরুদ্ধে থাকা এমনই এক ব্যাক্তি ব্রিজের উপর গুলি করে হত্যা করা হয় তার প্রেমিকার সামনেই। ২০০৭ সালে পুতিনের বিরুদ্ধে তারই দেশের দাদ চ্যাম্পিয়ন গ্যারি কেসপারোভ আন্দোলন করেছিলেন কিন্তু কোন লাভ হয় নি, পুলিশ প্রায় ১৫০ জনকে গ্রেফতার করেছিল। প্রথমে রাশিয়ায় কেউ দুবারের বেশী প্রেসিডেন্ট হতে পারত না ২০০৮ এ পুতিন ইতিমধ্যে দুবার রাষ্ট্রপতি হয়ে গেছেন সুতরাং তাকে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে সরতে হয় তার জায়গা নেন দিমিত্রি মেদভেদেভ। কিন্তু পুতিন দিমিত্রি ক্ষমতা পাবার একদিন পরেই রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হন এবং সমস্ত ক্ষমতা নিজের দিকে আনেন এতটাই ক্ষমতা ওনার। এখানে আরও একটি ব্যাপার আসে তা হচ্ছে আরব বসন্ত। ২০১০ সালের ১৭ ই ডিসেম্বর এটা শুরু হয় তিউনিশিয়া থেকে। আরব বসন্ত হচ্ছে অ্যান্টি গভমেন্ট বিরোধিতা যা তিউনিসিয়া থেকে শুরু হয়ে লিবিয়া, জর্ডান, মিশর, বাহরিন পর্যন্ত যায়। ভ্লাদিমির পুতিন এই একটা জিনিসকে ভিষন ভয় খায় তা হল এই জন আন্দোলন।
২০১১ সালে রাশিয়া তে ছিল জন ভোট, তার আগে রাশিয়া জুড়ে পুতিনের বিরোধীতা শুরু হয়, রক ব্যান্ডের মাধ্যমে লোক প্রতিবাদ শুরু করে কিন্তু ৪ ডিসেম্বর, ২০১১ এর এই ভোট পুতিনই জেতে ৬৩ শতাংশ ভোটে। বলা হয় ভয়ানক চুরি হয়েছিল এই ভোটে যার জন্য প্রায় কুড়ি হাজার রাশিয়ান বিক্ষোভ করেছিল তার বিরুদ্ধে কিন্তু ক্ষমতার জোরে এই বিক্ষোভ দমন করেন তিনি। ৫৭০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। বলা হয় পুতিন নিজের সুরক্ষার জন্য একটি বিশেষ প্যারামিলিটারি ফোর্স রাখেন। ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখল করে রাশিয়া যাতে গোটা বিশ্বে সাড়া পড়ে যায় কিন্তু পুতিনের কোন যায় আসে না। ক্রিমিয়ার সেবাস্তিপোল বন্দর গরম জলের সারাবছর এখানে বানিজ্য হয় কিন্তু রাশিয়ান সমস্ত বন্দর শীতকালে প্রায় পাচ মাস বরফে ঢেকে যায় বানিজ্য হয় না সেই জন্য রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নেয়। ২০১৫ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে রাশিয়া অংশ নেয়, রাশিয়া এখানে সিরিয়ান প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ কে সমর্থন করে যাকে আবার আমেরিকা অপচ্ছন্দ করে সুতরাং এই নিয়ে আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে ঝামেলা আছে। বলা হয় ২০১৭ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জেতানোর পেছনে ও হিলারি ক্লিন্টনকে হারানোর পেছনে ভ্লাদিমির পুতিনের বড় হাত আছে। আসলে ২০১১ সালে রাশিয়ান বিক্ষোভের পেছনে হিলারি ক্লিন্টন কে দায়ী করেছিল পুতিন এবার তার প্রতিশোধ নিতে ২০১৭ সালে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিলারি ক্লিন্টনকে হারায় পুতিন। ২০১৮ সালে ৭৬ শতাংশ ভোট সহ আবার ভোটে বিজয়ী হন পুতিন। পুতিন রাশিয়ায় নতুন আাইন তৈরি করেন, নতুন আইন অনুসারে তিনি ২০৩৫ পর্যন্ত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট থাকবেন অর্থাৎ সমস্ত ক্ষমতা নিজের দখলে রইল।
ভ্লাদিমির পুতিনের পাবলিক ইমেজ ব্যাপক। সোশ্যাল মিডিয়ায় তার ছবি দেখলে দেখবেন কখনও ঘোড়ায় রাইডিং করছেন, সিংহের সাথে ছবি, মাছ ধরছেন, স্পোর্টস গাড়ি চালাচ্ছেন অর্থাত পুতিনের পাবলিক ইমেজ অসাধারণ। পুতিনের ব্যাক্তিগত জীবন বেশ রঙ্গিন। ছোট বেলায় কেজিবিতে ভর্তি হবার আগে তিনি যে বিদ্যালয়ে পড়তেন সেখানে তার একটি নিজস্ব গ্যাং ছিল। ১৯৮৩ সালে ইয়ুডমিলা স্ক্রেবিভাকে বিয়ে করেন পুতিন। তাঁদের দুই কন্যা সন্তান রয়েছে। মারিয়া এবং ইয়েকাততেরিনা। বিয়ের আগে ইয়ুডমিলার সঙ্গে সম্পর্কে ছিলেন পুতিন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত তারা দুজন পূর্ব জার্মানি তে ছিলেন সে সময় পুতিন কেজিবির গুপ্তচর হিসাবে জার্মানি তে ছিল। তবে ইয়ুডমিলা কে বিয়ে করার আগে তার পরীক্ষা নেয় পুতিন। পুতিন তার এক বন্ধু কে ইয়ুডমিলার কাছে পাঠায়। সেই বন্ধুটি ইয়ুডমিলাকে প্রোপোজ করে কিন্তু ইয়ুডমিলা না করে দেয় এরপরই পুতিন বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৩ সালে আচমকাই বিবাহের ৩০ বছর পূর্ণ হবার আগেই তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়, ২০১৪ সালে ক্রেমলিন নিশ্চয় করে পুতিনের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের পর পুতিনের নানা সম্পর্কের কথা জনসমক্ষে উঠে আসতে থাকে। এদের মধ্যে অন্যতম সেভেতলানা। অলিম্পিকে স্বর্ণপদক জয়ী প্রাক্তন খেলোয়াড় এলিনা কাবাইভা।
২০০৪ সাল থেকে এলিনার সঙ্গে সম্পর্কে রয়েছে পুতিন। বয়সে ৩০ বছরের ছোট এলিনার জন্যই নাকি ইয়ুডমিলার সঙ্গে বিচ্ছেদ হয় পুতিনের। ২০১৫ সালে এলিনার গর্ভে জন্মানো কন্যাসন্তানটি পুতিনেরই। ২০১৯ সালে এলিনা দুই যমজ পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। তাঁদের বাবাও নাকি পুতিন। এলিনার পাশাপাশি সেভেতলানা ক্রিভনগিখের সঙ্গে পুতিনের নাম জড়ায়। তিনি ছিলেন পুতিনের পরিচারিকা। সেভেতলানার গর্ভে জন্মানো কন্যাসন্তান লুইয়া লোজভার বাবাও স্বয়ং পুতিন। এমনই লোকমুখে প্রচার হয়। একাধিক মহিলার সঙ্গে একাধিকবার নাম জড়িয়েছে রুশ প্রেসিডেন্টের। বারবার জনসমক্ষে চলে এসেছে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন। অত্যন্ত বড়লোক পুতিনের নিজস্ব একটি সুপার জাহাজ ও আছে যার দাম প্রায় ৭৩ মিলিয়ন ডলার কিন্তু পুতিন অস্বীকার করেছে এই তথ্য। কিন্তু পুতিন না বললে কেই বা তদন্ত করে বার করবে কারন রাশিয়ার দোর্দন্ডপ্রতাপ সম্রাট বলা হয় ভ্লাদিমির পুতিন কে, তাকে রাশিয়ার মর্ডান জার ও বলা হয়। শোনা গেছে ভ্লাদিমির পুতিন নাকী পার্কিনসিন্স রোগে আক্রান্ত, যারা জানেন না তাদের বলি এই রোগ সাধারণত বয়স্কদের হয় এবং এটা খুবই কমন রোগ কিন্তু লোকে চিকিৎসা করায় না ভাবে বয়সের দোষ। এই রোগ খুব ধীরে ধীরে আক্রান্ত হয়। এই রোগে হয় কী মানুষের গতি কমে যায় সে একটু ধীরে ধীরে সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটে। মুখের মধ্যে কোন আবেগ থাকে না ধরুন কোন ব্যক্তি খুব হাসি খুশি থাকত সে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায়। ব্যাক্তিটির হাত পা কাঁপতে থাকে। কোন এক জায়গায় বসে থাকলে উঠতে ভাল লাগবে না। ঘন্টার পর ঘন্টা বসেই থাকবে। তবে আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে ওষুধ খেয়ে এই রোগ সারিয়ে তোলা সম্ভব।
সম্প্রতি ইউক্রেনে রাশিয়াট অ্যাটাকের মাধ্যমে পুতিন শিরোনামে এসেছে। আসলে পুতিন চায় না ইউক্রেন ন্যাটোতে যাক তাহলে ন্যাটো রাশিয়ার ঘাড়ের কাছে চলে আসবে এবং আমেরিকা ও ন্যাটোর মিসাইলের রেঞ্জে চলে আসবে রাশিয়া। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়ার উপর চলা বিভিন্ন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার জন্য রাশিয়া বাধ্য হয়েছে আক্রমণ করতে। ভারতের সাথে সম্পর্ক খুবই ভাল রাশিয়ার। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী স্বর্গীয় অটল বিহারি বাজপেয়ী থেকে শুরু করে মনমোহন সিং এবং এখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথেও খুব ভাল সম্পর্ক ভ্লাদিমির পুতিনের। আসলে সেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় থেকে ভারত ও রাশিয়ার সম্পর্ক, অনেক দিনের পুরোনো বন্ধুত্ব। রাশিয়ার অস্ত্রর একটা বড় ক্রেতা ভারত। কাশ্মীর ইস্যু, আর্টিকেল ৩৭০ তুলে নেওয়া থেকে শুরু করে এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জাতি সংঘে ভোট অনেক ব্যাপারে বরাবরই ভারতের পাশে আছে ভ্লাদিমির পুতিন।