অফবিট

২১ বছর পর এক শত্রুকে হত্যা করেছিল দুবাইয়ে ইসরায়েলের গোয়েন্দারা। মোসাদের এক অসাধারন অপারেশান

বিশ্বে যত ইনটেলিজেন্স সংস্থা রয়েছে তাদের মধ্যে ইসরায়েলের মোসাদকে সবসময় প্রথম সারিতে রাখা হয়। মধ্যপ্রাচ্যে চারদিকে শত্রু দ্বারা বেষ্টিত থাকা ইসরায়েল দেশটির ১৯৪৮ সালে তৈরি হওয়ার পর থেকে একের পর এক যুদ্ধ জিতে মধ্যপ্রাচ্যে সুপার পাওয়ারে পরিনত হওয়ার পেছনে মোসাদের অবদান রয়েছে সর্বাধিক। বলা হয় মোসাদ তার শত্রুদের কখনও জীবিত রাখেনা। যদি কোনও ব্যক্তি ইসরায়েলের ক্ষতি করে তাহলে সেই ব্যক্তি বিশ্বের যে প্রান্তেই লুকিয়ে থাকুক না কেন মোসাদ তাকে খুঁজে বের করে হত্যা করবেই তা সে কুড়ি বছর পর হলেও। মোসাদের হিট লিস্টে একবার কারও নাম উঠে গেলে তার বেঁচে থাকা অসম্ভব। মোসাদ এমন ভাবেই অপারেশন করে যাতে মিশন শেষে তাদের বিরুদ্ধে কোনও প্রমান না থাকে। এমনই এক দীর্ঘমেয়াদি অপারেশন করে মোসাদ দুবাইয়ে। ১৯৮৯ সাল থেকে মোসাদ হামাস কম্যান্ডার মহম্মদ আল মাভুকে খুঁজছিল অবশেষে ২০১০ সালে ২১ বছর পর দুবাইয়ে তাকে হত্যা করে মোসাদ। 

১৯৬০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী গাজা পট্টির জাবালিয়া ক্যাম্পে জন্ম হয় মহম্মদ আল মাভুর। ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও গাজা পট্টি এই দুই এলাকা নিয়েই প্যালেস্টাইন দেশ গঠিত। গাজা পট্টিতে ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের নিয়ন্ত্রন রয়েছে। গাজা পট্টি থেকেই হামাস বারবার ইসরায়েলে গোরিলা আক্রমন করে, রকেট হামলা করে। গত ৭ অক্টোবর এই গাজা পট্টি থেকে ইসরায়েল লক্ষ্য করে কুড়ি মিনিটে প্রায় পাঁচ হাজার রকেট ফায়ার করেছিল। এরপরেই হামাস ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হয়। এই গাজা পট্টিতে সবচেয়ে বড় শরনার্থী শিবির জাবালিয়া ক্যাম্প, যেখানে জন্ম হয় আল মাভুর। 

১৯৭০ সালে আল মাভু মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড সংগঠনের সদস্য হয়। ১৯৮৬ সালে অবৈধ অস্ত্রের কারনে তাকে গ্রেফতার করে ইসরায়েল পুলিশ। ছাড়া পেয়েই সে হামাসে যোগদান করে। আল মাভু হামাসের লজিস্টিক অফিসার হিসাবে কাজ করা শুরু করে। তার কাজ ছিল মোসাদকে অস্ত্র সরবরাহ করা। আল মাভু ইরান থেকে অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মিসাইল, গাইডেড মিসাইল, রকেট গাজা পট্টিতে হামাসের আস্তানায় নিয়ে আসতো যা দিয়ে হামাস ইসরায়েলে গোরিলা আক্রমন চালাতো। ১৯৮৯ সালে আল মাভু ও তার এক বন্ধু ইসরায়েল সেনাবাহিনীর দুজন সেনা সদস্য আভি সাসপোর্টাস এবং ইলান সাদনকে হত্যা করে। ইসরায়েল এই ঘটনার তদন্ত করে জানতে পারে এই ঘটনার পেছনে রয়েছে হামাসের কম্যান্ডার মহম্মদ আল মাভু। এরপরই মোসাদ আল মাভুর অনুসন্ধান শুরু করে। আল মাভুও জানতো ইসরায়েল তার শত্রুকে খুঁজে বের করবেই সেকারনে আল মাভু গাজা পট্টি থেকে ইরান পালিয়ে যায় সেখান থেকে চীন, কখনও সিরিয়া আবার কখনও ইউএই যাতায়াত শুরু করে আল মাভু, কোনও দেশেই দীর্ঘদিন থাকতোনা সে। বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করতে থাকলেও আল মাভু হামাসের হয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। হামসের আল কাসেম বিগ্রেডের জন্য অস্ত্র সরবরাহের কাজ বিদেশ থেকেও করছিলো সে। 

২০১০ সালে সংবাদিক ইওসি মেলম্যান ও ড্যান রাভিভ দাবি করে হামসের সাথে ইরানের রেভ্যুলেশনারী গার্ড ক্রপসের গোপন যোগাযোগের মাধ্যম ছিল এই আল মাভুই। 

২০০৩ সালের বেশীরভাগ সময় আল মাভু মিশরের জেলেই ছিল। আল মাভুকে দুবাইয়ে হত্যা করবার আগে আরও দুইবার হত্যার চেষ্টা করেছিলো মোসাদ। একবার গাড়ি বোমা বিস্ফোরনে এবং আর একবার ২০০৯ সালে লেবাননের বেইরুটে তেজস্ক্রিয় বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে যাতে সে ত্রিশ ঘন্টার মধ্যেই মারা যেত কিন্তু দুইবারই বেঁচে যায় সে। এরপর মোসাদ আবারও তার অনুসন্ধান শুরু করে এবং মোসাদ জানতে পারে আল মাভু বেইরুট থেকে দুবাইয়ে বারবার যাতায়াত করে। 

২০০৯ সালেই মোসাদ ছয় জন এজেন্টকে দুবাই পাঠায় আল মাভুর ব্যাপারে ভালোভাবে অনুসন্ধান করার জন্য। মোসাদের ওই দল চার মাস ধরে দুবাইয়ে অনুসন্ধানের পর ইসরায়েলের রাজধানী তেল আভিবে মোসাদের মুখ্য কার্যালয়ে তথ্য পাঠায় যে আল মাভু বেশীরভাগ সময় দুবাইয়েই থাকে। তখনই ঠিক হয় আল মাভুকে দুবাইয়েই হত্যা করা হবে। মোসাদ মোট ২৭ জন সদস্য বিশিষ্ট দল গঠন করে এই মিশনের জন্য। শুরু হয় অপারেশনের পরিকল্পনা, আল মাভুকে এমন ভাবে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয় যাতে পুরো ঘটনা স্বাভাবিক মনে হয় কারন দুবাই পুলিশের সন্দেহ করার আগেই মোসাদের এজেন্টদের দেশে ফিরে আসা দরকার ছিল। তাছাড়া ইসরায়েল চাইছিল না এই ঘটনার পেছনে তাদের হাত আছে কেউ জানুক তাহলে আন্তর্জাতিক স্তরে কুটনৈতিক চাপ আসতে পারে। সেজন্য আল মাভুকে হত্যা করবার জন্য ২০১০ সালের জানুয়ারি মাস বেছে নেওয়া হয়। কারন দুবাইয়ে সবচেয়ে বেশী বিদেশী পর্যটক আসতো শীতকালে, বিশেষ করে জানুয়ারি মাসে সেসময় প্রতিদিন গড়ে এক লাখ করে বিদেশী পর্যটক আসতো দুবাইয়ে যার কারনে মোসাদের এজেন্টরা খুব সহজেই ভিড়ের মধ্যে মিশে যেতে পাড়তো। 

২০১০ সালে আল মাভু তার মৃত্যুর দুই সপ্তাহ আগে আল জাজিরাকে এক গোপন সাক্ষাৎকারে ১৯৮৯ সালে দুই ইসরায়েলি সেনাকে হত্যার দায় স্বীকার করে। ২০০৯ সাল থেকেই দুবাইয়ে ছয়জন মোসাদ এজেন্ট ছিল, আল মাভুকে হত্যার জন্য আরও ২৭ জনের দলকে দুবাই পাঠানো হয়। তবে এদের কাউকেই ইসরায়েলি পাসপোর্টে পাঠানো হয়নি, নকল পাসপোর্ট তৈরি করা হয়। ১২ টি ব্রিটিশ, ছয়টি আইরিশ, চারটি ফ্রান্স ও চারটি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকের নকল পাসপোর্ট তৈরি করা হয় এবং একটি জার্মান পাসপোর্ট তৈরি করা হয়। একমাত্র জার্মান পাসপোর্টটি আসল ছিল। ১৯ জানুয়ারি ২৭ জন মোসাদের এজেন্ট দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে উপস্থিত হয়। তবে সব এজেন্ট একসাথে আসেনি, দুই জন করে একটি দলে বিভিন্ন বিমানে তারা দুবাই এসে পৌঁছায়। মোসাদের কাছে খবর ছিল আল মাভু সিরিয়ার দামেস্কাস থেকে সেইদিনই দুবাই আসবে। নির্দিষ্ট সময়ে দামেস্কাস থেকে এমিরেটসের বিমানে দুবাই এসে পৌঁছায় আল মাভু। দুবাই বিমানবন্দর থেকে আলু মাভু যখন হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় তখন তাকে অনুসরন করা শুরু করে দুইজন মোসাদ এজেন্ট যাদের হাতে টেনিস ব্যাট ও কাঁধে টাওয়েল ছিল, দেখে মনে হচ্ছিল টেনিস খেলোয়াড়। যাতে কেউ সন্দেহ না করে তার জন্যই এমন বেশ ধারন করেছিল মোসাদ এজেন্টর। আল মাভু দুবাইয়ের আল বুস্টান রোটানা হোটেলের ২৩০ নং ঘরে গিয়ে ওঠে। ২৩০ নং ঘরের ঠিক উল্টো দিকেই ২৩৭ নং ঘর ভাড়া নেয় মোসাদের কিছু এজেন্ট। আল মাভু সন্ধ্যাবেলায় হোটেল থেকে বের হয় ঘুরতে। ততক্ষনে মোসাদের এজেন্টরা অপারেশনের প্রস্তুতি শুরু করে। কিছু এজেন্ট হোটেলের কর্মচারীর পোষাক ধারন করে যাতে অপারেশনের সময় কেউ আসতে না পারে, কিছু এজেন্ট আল মাভুর ঘরে ঢুকে সমস্ত ইলেকট্রনিক কমিউনিকেশন সিস্টেম জ্যাম করে দেয়। 

৮:২৫ নাগাদ নিজের ঘরে ফিরে আসে আল মাভু। ২৩০ নং ঘরের লক সিস্টেমও আগে থেকেই খুলে রেখেছিল মোসাদ এজেন্টরা। আল মাভু ঘরে প্রবেশ করার পরেই আগে থেকেই প্রস্তত কিছু মোসাদ এজেন্ট তার ঘরে ঢুকে তাকে হত্যা করে হোটেল থেকে বেড়িয়ে যায় বিমানবন্দরের দিকে। একে একে ২৭ জন এজেন্টই দুবাই বিমানবন্দরে গিয়ে বিমান ধরে চলে যায়। এভাবে ২১ বছর আগে ইসরায়েল তাদের দুই সেনার মৃত্যুরাই প্রতিশোধ নেয়। এই দীর্ঘ সময়ে কেউ জানতেও পারেনি আলা মাভু মারা গেছে। কয়েক ঘন্টা পর আল মাভু দীর্ঘক্ষন তার স্ত্রীর ফোনের উত্তর না দেওয়ায় হোটেলের এক কর্মচারী ২৩০ নং ঘরের সামনে গিয়ে ডোরবেল বাজায় কোনও উত্তর না আসায় হোটেলের ম্যানেজার এসে মাস্টার কী দিয়ে দরজা খোলে, দেখা যায় হোটেলের বিছানায় মৃতদেহ পড়ে রয়েছে আল মাভুর। দুবাই পুলিশ ময়নাতদন্তে জানতে পারে আল মাভুর মৃত্যু হয়েছে হ্যামারেজে যার কারনে এটা স্বাভাবিক মৃত্যু বলেই মনে হয় প্রথমে। কিন্ত ২৫ জানুয়ারি অর্থাৎ আল মাভুর মৃত্যুর পাঁচদিন পর আবারও আল মাভুর দেহে ময়নাতদন্ত হয় এবার দেখা যায় মৃতদেহের পায়ে সাকসিনাইলকোলাইন নামে একটি রাসায়নিক প্রবেশ করানো হয়েছে। এই রাসায়নিক মানুষের শরীরকে তাৎক্ষনিক প্যারালাইজড করে দেয় এবং তারপর মুখে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করা হয় আল মাভুকে। এই ঘটনা এমনভাবে সাজানো হয় যাতে পুরো ঘটনা স্বাভাবিক মৃত্যু মাথার হ্যামারেজ বলে মনে হয়। দুবাই পুলিশ ও ইন্টারপোল যৌথভাবে এই তদন্ত শুরু করে। দুবাই পুলিশের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল তামিম ১৮ ফেব্রুয়ারী জানায় তারা একশো শতাংশ ভাবে নিশ্চিত এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে মোসাদ রয়েছে কিন্তু মোসাদের বিরুদ্ধে কোনও স্পষ্ট প্রমান পাওয়া যায়নি। 

ইসরায়েলি পত্রকার উজি মাহনাইমির কথা অনুযায়ী ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসের শুরুতেই মোসাদ প্রধান মীর দোগানের কথায় আল মাভুকে হত্যার মিশনে সবুজ সংকেত দেয় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতেনইয়াহু। আল মাভুর কাছে পাঁচটি দেশের পাসপোর্ট ছিল। ২০১০ সালে আল মাভুকে ইসরায়েল ছাড়াও, মিশর ও জর্ডান সরকারও খুঁজছিল। আল মাভুর ভাইপো আহমেদও হামাসে যোগ দেয়। আহমেদ হামাসের অন্তর্ঘাত বিভাগের সদস্য ছিল। ২০১৪ সালের ইসরায়েল গাজা সংঘর্ষের সময় আহমেদের মৃত্যু হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *