ফিচার আর্টিকেল

মাত্র ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে ইসরায়েল ইরান ও লেবাননে হামলা করেছে। তবে কী মধ্যপ্রাচ্যে বড় কোনও যুদ্ধের প্রস্তুতি!

মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত ইসরায়েল দেশটির জনসংখ্যা সবমিলিয়ে এক কোটিরও কম। এত কম জনসংখ্যা বিশিষ্ট ছোট এই দেশটি বিগত ৭০ বছর ধরে সগর্বে মধ্যপ্রাচ্যে রাজত্ব করে চলেছে। আশেপাশের আরব দেশগুলোর বারংবার আক্রমন সত্বেও ইসরায়েলকে পরাজিত করার ক্ষমতা হয়নি কারও। শত্রুকে অন্যদেশে গিয়ে হত্যা করতে ইসরায়েলের মতো পারদর্শী কেউ নেই। ইসরায়েলের ইনটেলিজেন্স সংস্থা মোসাদকে এই কারনে বিশ্বের সবচেয়ে ঘাতক গুপ্তচর সংস্থা বলা হয়। সম্প্রতি একইভাবে মোসাদ ইরানে থাকা হামাস নেতাকে হত্যা করেছে। হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে গত অক্টোবর মাস থেকে যুদ্ধ চলছে যার কারনে মধ্যপ্রাচ্য রীতিমতো অশান্ত রয়েছে। ফিলিস্তিনের গাজাস্ট্রিপে একটি সংগঠন রয়েছে হামাস যাকে অনেক দেশ সন্ত্রাসী সংগঠন তকমা দিয়েছে। এই হামাসের সদস্যদের বেছে বেছে হত্যা করছে ইসরায়েল। এই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে গাজায় যারা আছে তারা হামাসের সাধারন সদস্য, হামাসের সর্বোচ্চ নেতারা কাতার ও ইরানে আশ্রয় নিয়েছে। সম্প্রতি হামাসের শীর্ষনেতা ইসমাইল হানিয়াহ যে ইরানে ছিল তাকে হত্যা করেছে মোসাদ। ইরানে রাষ্ট্রপতি নিয়োগকে কেন্দ্র করে সোখানে উপস্থিত ছিল ইসমাইল হানিয়াহ। কিছু মাস আগেই হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ইরানের রাষ্ট্রপতি রাইসি সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তির। তারপরে ইরানের আভ্যন্তরীন নির্বাচনে ঠিক করা হয় মাসাউ পেজেশকিয়ান ইরানের নতুন রাষ্ট্রপতি হবে। রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের প্রধানদের আমন্ত্রন করেছিল ইরান৷ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বিদেশমন্ত্রী এস জয়শংকরকে আমন্ত্রন করেছিল ইরান কিন্তু ইরানে রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহন অনুষ্ঠানে যায় নীতিন গড়করি। ইরানের সংসদে আমেরিকা ও ইসরায়েল বিরোধী স্লোগানও দেওয়া হয় শপথগ্রহন অনুষ্ঠানে। এই জন্য নরেন্দ্র মোদী ও এস জয়শংকর যাননি ইরানে। কিন্তু ইরান একটি গুরুত্বপূর্ন মিত্রদেশ ভারতের জন্য, চাবাহার বন্দর ভারতের জন্য স্ট্রাটেজিক ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। এজন্য নীতিন গড়করিকে পাঠানো হয়েছিল প্রতিনিধি হিসাবে। এই শপথ গ্রহন অনুষ্ঠানে ইসরায়েল হামাসের নেতা ইসমাইল হানিয়াহকেও আমন্ত্রন করেছিল। কিন্তু ইরান ভাবতেও পারেনি ইসরায়েল এরকম সময়েও আক্রমন করবে। শপথ গ্রহন অনুষ্ঠানের পর ইসমাইল হানিয়াহ যখন তার গেস্ট হাউসে বিশ্রাম নিচ্ছিল তখন মিসাইল স্ট্রাইকে তাকে হত্যা করে ইসরায়েল। ইরানের রেভ্যুলেশনারী গার্ড ও হামাস ইসমাইল হানিয়াহর মৃত্যুকে নিশ্চিত করেছে। যদিও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এখনও পর্যন্ত এই মিসাইল স্ট্রাইকের ব্যাপারে কীছু জানায়নি। 

ইসরায়েল জানিয়েছে তারা ৭ অক্টোবরের বদল নিয়েছে। গত ৭ অক্টোবর হামাসের সদস্যরা ইসরায়েলে ঢুকে অতর্কিতে আক্রমনে প্রায় ১,৩০০ ইসরায়েলি নাগরিককে হত্যা করেছিল এবং কয়েকশো ইসরায়েলিকে বন্দী করেছিল। এই অপারেশনের পুরো পরিকল্পনাতে যুক্ত ছিল এই ইসমাইল হানিয়াহ। তবে এফ ৩৫ যুদ্ধবিমান থেকে নাকী ইসরায়েলের ভূমি থেকে সরাসরি, কীভাবে মিসাইল হামলা করেছে ইসরায়েল তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে এটা প্রমান হয়ে গেছে যে ইসরায়েলের শত্রু কোনও দেশেই নিরাপদ নয়। ইসমাইল হানিয়াহ কাতারে আশ্রয় নিয়েছিল, ইরানের রাষ্ট্রপতি পদে শপথ গ্রহনকে কেন্দ্র করেই ইরানে এসেছিল সে, এই খবর আগেই ছিল মোসােদের কাছে তাই ইরানে আসার সাথে সাথে তাকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় হামাস জানিয়েছে ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধ নতুন মোড় নিল। এই হত্যাকাণ্ডে সবচেয়ে বেশী লজ্জায় পড়েছে ইরান। কারন বিশ্বের সামনে এটা প্রমান হয়ে গেছে যে তাদের রাজধানী শহরই নিরাপদ নয়। 

তুরস্কের ইস্তাম্বুলে কয়েকহজার লোক ইসরায়েলের এই আক্রমনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ দেখায়। কিছু দিন আগেই তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইপে এরদোগান ইসরায়েলে সরাসরি আক্রমনের হুমকী দেয়, তারপরেই তুরস্কে ইসরায়েল বিরোধীতা আরও বেড়ে যায়।

ইরান এই ঘটনার কারনে তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোকদিবস ঘোষনা করেছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি এই ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়ার কথা জানিয়েছে। এতদিন ইরান হিজবুল্লাহ, হামাসের মতোন সংগঠনের আড়ালে ছায়াযুদ্ধ করতো ইসরায়েলের সাথে, এবার ইরান সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে চলেছে ইসরায়েলের সাথে। 

শুধু ইরানেই নয় ইসরায়েল লেবাননের রাজধানীতেও এয়ারস্ট্রাইক করেছে। ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে ইসরায়েল লেবানন ও ইরানে হামলা চালিয়েছে। লেবাননের রাজধানী বেইরুটে ব্যাপক এয়ারস্ট্রাইক চালিয়েছে ইসরায়েলি বায়ুসেনা। আমেরিকা ইসরায়েলকে জানিয়েছিলো কোনওভাবেই লেবাননে বিশেষ করে লেবাননের রাজধানী বেইরুটে আক্রমন না করতে কিন্তু ইসরায়েল আমেরিকার কথা না শুনেই লেবাননে এয়ারস্ট্রাইক করেছে। এর আগেও ইসরায়েল আমেরিকার দেওয়া হামাসের সাথে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবকেও শোনেনি ইসরায়েল। বেইরুটে একটি নির্দিষ্ট বাড়িতে এয়ারস্ট্রাইক করেছে ইসরায়েল, এই এয়ারস্ট্রাইকে লেবানন ভিত্তিক সংগঠন হিজবুল্লাহের দ্বিতীয় নেতা ফুয়াদ শুকর মারা গেছে। ফুয়াদ শুকর সেই ব্যক্তি যে ১৯৮৩ সালে ২৪১ জন আমেরিকান মেরিন সদস্যদের মৃত্যুর জন্য দায়ী এবং সম্প্রতি ইসরায়েলের মাজদাল শামসে ১২ জন ইসরায়েলি বাচ্চাকেও হত্যা করেছে এই ফুয়াদ শুকর। ইসরায়েল ও সিরিয়ার সীমান্তে একটি অঞ্চল রয়েছে যার নাম গোলান হাইটস। সিরিয়া অভিযোগ করে এই অঞ্চল তাদের যা ইসরায়েল জোরপূর্বক ধরে রেখেছে। এই গোলান হাইটসের একটি জায়গা হচ্ছে মাজদাল শামসে। এখানে একটি ফুটবল মাঠে বাচ্চারা খেলছিলো সেখানই হিজবুল্লাহ রকেট হামলা করে যাতে ১২ জন বাচ্চার মৃত্যু হয়। এরই ফলস্বরূপ লেবাননে এয়ারস্ট্রাইক করে ইসরায়েল। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ঘটনার বিরোধীতা করে বর্তমান আমেরিকান রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন ও উপ রাষ্ট্রপতি কমলা হ্যারিসের দুর্বল সরকারের বিরোধীতা করেছে। ইসরায়েলের অভিযোগ এই মাজদাল শামসেতে আক্রমনের মাস্টার মাইন্ডও ফুয়াদ শুকর। 

প্রথমে হিজবুল্লাহ জানিয়েছিল এই আক্রমনের জন্য তারা দায়ী নয় কিন্তু তদন্তে দেখা যায় হিজবুল্লাহর ছোঁড়া ফালাক ১ ২৪০ মিলিমিটার আর্টিলারি শেলের আঘাতেই ওই বাচ্চাদের মৃত্যু হয়েছে। গত ত্রিশ বছর ধরে ইসরায়েলে হওয়া একের পর এক হিজবুল্লাহের আক্রমনের জন্য দায়ী ছিল এই ব্যক্তিই। আমেরিকা ফুয়াদ শুকরের সন্ধানের জন্য ৫ মিলিয়ন ডলারের অর্থ পুরস্কারও ঘোষনা করেছিল। ইসরায়েলের এয়ারস্ট্রাইকে ফুয়াদ শুকর ছাড়াও আরও বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে এবং অনেক মানুষই আহত হয়েছে। কিন্তু ইসরায়েল এত কিছু ভাবেনা, ইসরায়েলের কাজ করার ধরনই এমন। গাজাতে হামাসকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে ইসরায়েলের কারনে অন্তত ৪০,০০০ সাধারন মানুষের মৃত্যু হয়েছে কিন্তু ইসরায়েল তবুও যুদ্ধ বন্ধ করেনি। বেইরুটে ইসরায়েলের এয়ারস্ট্রাইকের সরাসরি বিরোধীতা করেছে রাশিয়া। রাশিয়া জানিয়েছে এটা আন্তর্জাতিক আইনের বিরোধীতা। ইরানের পাশাপাশি রাশিয়াও হিজবুল্লাহকে সমর্থন করে। 

২০২৩ সালে জাতিসংঘ রাশিয়ার বেসরকারি সেনা ওয়েগনারের বিরুদ্ধে হিজবুল্লাহকে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিক্রির অভিযোগ এনেছিল। রাশিয়া হিজবুল্লাহকে অস্ত্র সরবরাহ করে। ইসরায়েলের এই আক্রমনের প্রতিশোধ নিতে এবার হিজবুল্লাহও ইসরায়েলে আক্রমন করবে। বিগত কয়েক সপ্তাহে ইসরায়েল পাঁচটি দেশ ইরান, লেবানন, ফিলিস্তিন, সিরিয়া এবং ইয়ামেনে আক্রমন করেছে। তাছাড়া কাতার, তুরস্ক ও রাশিয়াও ইসরায়েল বিরোধী। স্বাভাবিকভাবেই মধ্যপ্রাচ্যে বিগত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ইরানের নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্যে একটি বড় যুদ্ধের সংকট তৈরি হয়েছে। লেবাননে একবার এয়ারস্ট্রাইক করেই ইসরায়েল থেমে থাকবেনা। ইসরায়েল আরও আক্রমন চালাবে লেবাননে। লেবাননের জনসংখ্যা মাত্র ৫০ লাখ, স্বাভাবিকভাবেই লেবানন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পারবেনা। গাজায় হমাসের মতোই, লেবাননের হিজবুল্লাহকে নিয়ে ইসরায়েলের সমস্যা রয়েছে। তাই এই সুযোগে ইসরায়েল লেবাননেও হিজবুল্লাহকে ধ্বংসের চেষ্টা করবে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক জানিয়েওছে তারা লেবাননের বিরুদ্ধে পূর্ন সামরিক অভিযান করবে। এই কারনে আমেরিকা সহ পশ্চিমা দেশগুলো এবং ভারতও লেবাননে আপাতত না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে তার নাগরিকদের। পশ্চিমা দেশগুলো দ্রুত তার নাগরিকদের ইসরায়েল ছাড়ার কথা জানিয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *