ফিচার আর্টিকেল

গোটা ইউরোপ জুরে হিটলার কিভাবে ইহুদিদের বাকী ইউরোপীয়ানদের থেকে আলাদা করেছিল?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অ্যাডলফ হিটলারের নাজি জার্মান সেনা ছয় মিলিয়ন বা ষাট লাখ ইহুদিকে হত্যা করে। ইতিহাসে এই মর্মান্তিক ঘটনা হলোকাস্ট নামে কুখ্যাত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সমগ্র ইউরোপ জুড়ে ইহুদিদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করা শুরু করে নাজি সেনা। সেসময় পোল্যান্ডেই প্রায় তিন মিলিয়ন ইহুদিকে হত্যা করে নাজিসেনা। অ্যডলফ হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ ইহুদি জনগোষ্ঠীকে হত্যা করেছিল। ইহুদি ধর্ম বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ধর্ম, ইহুদি ধর্মের ইতিহাসে ইহুদিদের বেশীরভাগ যুদ্ধ হয়েছিল খ্রিস্টানদের সাথে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে অ্যাডলফ হিটলার যখন জার্মানির ক্ষমতায় আসে তখন হিটলার সিদ্ধান্ত নেয় গোটা বিশ্ব থেকে ইহুদি জনগোষ্ঠীর নাম মুছে দেবে। জার্মানির ভিতরে থাকা ইহুদিদের খুঁজে বের করা খুব সহজ ছিল কারন তাদের ব্যপাারে যাবতীয় নথিপত্র ছিল জার্মান সরকারের কাছে কিন্তু হিটলারের পক্ষে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল জার্মানির বাইরে ইউরোপের বাকী থাকা ইহুদিদের খুঁজে বের করা কারন ইউরোপীয়ানদের ও ইহুদিদের প্রায় একইরকম দেখতে। কিন্তু তবুও নাজিসেনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় খুঁজে খুঁজে ইহুদিদের ঠিকই বের করে।

সময়টা ১৯৩৩ সাল, জার্মানিতে নির্বাচন জিতে চ্যান্সেলর হয় অ্যাডলফ হিটলার। হিটলার ক্ষমতায় আসার দুই মাসের মধ্যে জার্মানিতে একটি আইন পাশ হয় যাতে একটি বিশেষ অংশ ছিল দি আরিয়ান প্যারাগ্রাফ। এখানে বলা ছিল জার্মানিতে শুদ্ধ আর্য ভাষার লোকেদের থাকার অধিকার আছে এবং ইহুদিদের জার্মান সমাজ থেকে সম্পূর্ন আলাদা করা হবে। হিটলার প্রথমে জার্মানির সরকারি চাকরি থেকে যত ইহুদি আছে তাদের বের করে দেয়, কারও বাবা মা, দাদু কিংবা পূর্ব পুরুষদের কেউ ইহুদি হলেও তাকেও চাকরিচ্যুত করা হয়। তবে ১৯৩৩ সালে হিটলার শুধুমাত্র সেই সমস্ত ইহুদিদেরই চাকরিতে রেখেছিল যারা জার্মানির হয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল অথবা তাদের পরিবারের কেউ অংশ নিয়েছিল তবে ১৯৩৫ সালে এই নিয়মও বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং সমস্ত ইহুদিদেরই চাকরিচ্যুত করা হয়। সেসময় জার্মানিতে নিয়ম হয়ে যায় ইহুদি হলে কোনও ব্যক্তি সরকারি চাকরি পাবেনা। 

১৯৩৮ সালের আগস্ট মাসে হিটলার জার্মানিতে একটি নতুন নিয়ম চালু করে, নাজি সরকার জানায় সমস্ত ইহুদি পুরুষদের নামের মাঝের শব্দ ইসরায়েল হতে হবে এবং ইহুদি মহিলাদের নামের মাঝের শব্দ সারা হতে হবে। এভাবে নামের ভিত্তিতে ইহুদিদের চেনার নতুন নিয়ম তৈরি করে হিটলার। নাজি সরকার সেসময় ইহুদিদের সমস্ত পাসপোর্টে জে অক্ষর লিখে দেয় যাতে পাসপোর্ট দেখেও ইহুদিদের সহজে চেনা যায়। কিন্তু পরিচয়পত্র না দেখে সামনাসামনি দেখে ইহুদিদের চিহ্নিত করা সমস্যা ছিল তখনও। যার জন্য ১৯৪১ সালে হিটলার আরও একটি আইন তৈরি করে, নতুন আইন অনুযায়ী প্রত্যেক ইহুদি ব্যক্তিকে যাদের বয়স ছয় বছরের উপরে তাদের পোষাকে একটি স্টার লাগাতে হবে। যদি কোনও ইহুদি স্টার না লাগায় তাহলে তাকে গ্রেফতার করা হবে। তাছাড়া ইহুদিদের বাড়ির সামনেও স্টার চিহ্ন আঁকারও নিয়ম তৈরি করা হয় যাতে ইহুদিদের বাড়িও চিহ্নত করা যায়। এভাবে জার্মানিতে ইহুদিদের চিহ্নিত করনের জন্য একাধিক আইন তৈরি করে হিটলার। কিন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার যে ষাট লক্ষ ইহুদি হত্যা করেছিল তার ৭৫ শতাংশই ছিল জার্মানির বাইরে যাদের মধ্যে বেশীরভাগই ছিল লাটাভিয়া, এস্তোনিয়া, লুথানিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ডের বাসিন্দা। 

জার্মানির বাইরে ইহুদিদের চিহ্নিত করার জন্য জার্মানি একটি বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি যে দেশই দখল করতো সেখানে জার্মানির আধাসামরিক বাহিনী এসএস যেত। এসএসের মধ্যে একটি বিশেষ বাহিনী ছিল যার নাম গেস্টাপো। গেস্টাপোর কাজ ছিল জার্মান অধিকৃত দেশে ইহুদিদের চিহ্নিত কর। গেস্টাপো দেশগুলির সরকারি দপ্তর দখল করে নেয় এবং সেখানে গিয়ে সরকারি নথী থেকে জানতে পারতো সেইসব দেশে ইহুদি কারা রয়েছে। আয়কর বিভাগ, জাতীয় পরিচয় পত্র, বিবাহ নথী থেকে সহজেই ইহুদিদের পরিচয় জানতে পারে গেস্টাপো। তবে সমস্ত ইহুদি জনগোষ্ঠীই শহরে থাকতো না অনেক মানুষ শহর থেকে অনেক দূরে গ্রামে বসবাস করতো। গেস্টাপো কর্মকর্তারা গ্রামে গ্রামে গিয়ে স্থানীয় মানুষদের ইহুদিদের সম্পর্কে খোঁজ নিত, অর্থের লোভ দেখিয়ে অথবা ভয় দেখিয়েও ইহুদিদের ব্যাপারে তথ্য যোগাড় করতো গেস্টাপো। তাছাড়া স্থানীয় গীর্জা থেকেও ইহুদিদের ব্যাপারে তথ্য যোগাড় করতো গেস্টাপো। এভাবে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে ইহুদিদের চিহ্নিতকরন ও তাদের হত্যা শুরু করে জার্মান নাজিসেনা। রাউল হিলবার্গের লেখা দি ডেস্ট্রাকশন অফ দি ইউরোপীয়ান জিউশ বইয়ে হিটলারের ইহুদি গনহত্যার ব্যাপারে যাবতীয় বিবরন লেখা রয়েছে। তবে নাজি সেনার এত চেষ্টা সত্ত্বেও অনেক ইহুদি তাদের নকল পরিচয়পত্র তৈরি করে বসবাস করতো, আবার অনেক ইহুদি গেস্টাপোকে ফাঁকি দিয়ে অন্য দেশে পালিয়ে গিয়েছিল। যেমন বেলারুশের এক ইহুদি ব্যক্তি টুভিয়া বিলেস্কিকে যখন গেস্টাপো বাহিনী ধরতে আসে তখন সে বেলারুশের জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে টুভিয়া বিলেস্কির ভাই সহ আরও অনেক ইহুদি জঙ্গলে চলে যায়। জঙ্গলে রীতিমতো ইহুদি শরনার্থী শিবির তৈরি হয়। গেস্টাপো যখন এই শিবিরের খবর পায় তখন জঙ্গলে ইহুদিদের ধরতে গিয়ে গেস্টাপো বাহিনী কাউকেই পায়নি তার আগেই ইহুদিরা চলে গিয়েছিল সেখান থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় টুভিয়া বিলেস্কি সহ তার ভাইরা বারংবার জঙ্গলের বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে থেকে গেস্টাপোকে ফাঁকি দিত, তাছাড়া গেস্টাপোর উপর গেরিলা আক্রমনও করতো। টুভিয়া বিলেস্কি ও তার ভাইদের এসব ঘটনার উপরে ডিফাইয়েন্স নামে একটি বিখ্যাত সিনেমাও তৈরি করা হয়েছে। সেসময় জার্মানিতে এমন অনেক মানুষ ছিল যারা হিটলারের ইহুদি গনহত্যা সমর্থন করতো না। তারা লুকিয়ে ইহুদিদের সাহায্য করতো। জার্মানির এমনই এক ব্যাবসায়ী ছিল ওস্কার শিন্ডলার। ওস্কার নিজে নাজি দলের সদস্য ছিল কিন্তু সে হিটলারের ইহুদি গনহত্যাকে সমর্থন করতো না। শিন্ডলার জার্মানিতে তার ফ্যাক্টরিতে ইহুদিদের চাকরি দেয়, তার ফ্যাক্টরিতে কাজ করা ইহুদিদের পরিচয় নাজিসেনা কোনওদিন জানতে পারেনি। এভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কয়েক হাজার ইহুদিদের রক্ষা করে ওস্কার শিন্ডলার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *