ফিচার আর্টিকেল

চীনের স্ট্রিং অফ পার্লস নীতিকে বড় ঝটকা দিল ভারতবর্ষ

ইরানের চাবাহার বন্দরের পর বাংলাদেশের মোংলা বন্দরেরও নিয়ন্ত্রনাধিকার পাওয়ার চেষ্টা করছে ভারত। ইতিমধ্যেই এই ব্যাপারে ভারত ও বাংলাদেশের সরকারের মধ্যে কথা চলছে। গত দুবারের মোদী সরকারের মতো এবারেও মোদী ৩.০ সরকারে নেবারহুড ফাস্ট পলিসি অগ্রাধিকার পাচ্ছে। চীনের স্ট্রিং অফ পার্লস নীতিকে প্রতিরোধ করার জন্য মোংলা বন্দর ভারতের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। চীন বিগত কয়েক বছর ধরেই ভারতকে চতুর্দিক দিয়ে ঘিরে ফেলতে চাইছে। 

পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মায়নামার, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ সহ ভারতের সমস্ত প্রতিবেশী দেশেই চীন তার প্রভাব বাড়িয়েছে। ভারতের আরেক প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশেও চীন ২০১৮-১৯ সাল থেকেই তার উপস্থিতি বাড়িয়েছিল। ২০২১ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুঝতে পারে চীন তার বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার চেষ্টা করছে যাতে বাংলাদেশে তার আধিপত্য বিস্তার করতে পারে তখন থেকে শেখ হাসিনা চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে সমর্থন করা শুরু করে। বাংলাদেশের চিটাগং বন্দর ও মোংলা বন্দরের দিকে বহুদিন ধরেই নজর রয়েছে চীনের। স্ট্রাটেজিক ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন এই মোংলা বন্দরের নিয়নন্ত্রনাধিকারের জন্যই ভারত এবার চেষ্টা শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই ভারত সরকার তাদের একটি প্রতিনিধি দলকে বাংলাদেশ পাঠিয়েছে বাংলাদেশ সরকারের সাথে আলোচনার জন্য। বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত মোংলা বন্দরের কিছু দূরেই রয়েছে চিটাগং বা চট্টগ্রাম বন্দর। মোংলা বন্দরের স্ট্রাটেজিক অবস্থানের জন্যই ভারত এই বন্দরের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে। মোংলা বন্দর থেকে পূর্ব ভারত মহাসাগর ও পশ্চিম ভারত মহাসাগরে চীনকে সহজেই প্রতিরোধ করা যাবে। শুধু মোংলা বন্দরই নয় ভারত এরকম অনেক আন্তজার্তিক বন্দরের নিয়ন্ত্রনাধিকারের চেষ্টা করছে। যেমন ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ন প্রজেক্ট কালাদান মাল্টিমোডাল প্রজেক্ট চলছে মায়ানমারের সাথে। উত্তর পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্য ভারতের মূল ভূভাগের সাথে শিলিগুড়ি করিডরের মাধ্যমে যুক্ত। শিলিগুড়ি করিডর অত্যন্ত সংকীর্ন একটি জায়গা যার জন্য একে চিকেন নেক বলা হয়। উত্তর পূর্ব ভারতে বর্তমানে পৌঁছাতে গেলে দুইভাবে পৌঁছানো যায় প্রথমত শিলিগুড়ি করিডর হয়ে এবং দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু ভূ-রাজনীতিতে কোনও দেশের উপরেই অতিরিক্ত নির্ভরতা উচিৎ নয়। তাছাড়া শিলিগুড়ি করিডরের উপর চীনেরও নজর রয়েছে, চীন জানে চিকেন নেকে আক্রমন করলে উত্তর পূর্ব ভারত ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তাই কালাদান মাল্টিমোডাল প্রজেক্টের মাধ্যমে কলকাতা বন্দর থেকে ৫৩৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মায়নামারের সিটওয়ে বন্দর পৌঁছে সেখান থেকে স্থলপথে সরাসরি উত্তর পূর্ব ভারতে পৌঁছানো সম্ভব। ইতিমধ্যেই সিটওয়ে বন্দরের নিয়ন্ত্রনাধিকার পেয়ে গেছে ভারত। এবার ভারত মোংলা বন্দরের নিয়ন্ত্রনাধিকার পেয়ে গেলে বঙ্গোপসাগর সহ ভারত মহাসাগরে ভারতীয় নৌবাহিনী আরও শক্তিশালী হয়ে যাবে। ভারত মোংলা বন্দরের দায়িত্ব পেলে চাবাহার, সিটওয়ে বন্দরের পর মোংলা বন্দর তৃতীয় আন্তর্জাতিক বন্দর হতে চলেছে যেখানে ভারতের নিয়ন্ত্রন থাকবে। তাছাড়া ভারতের এই পদক্ষেপ চীনের স্ট্রিং অফ পার্লস নীতির জন্য একটি বড় ধাক্কা। 

চীনের আপত্তি সত্বেও ইতিমধ্যেই ভারতকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের স্থায়ী প্রবেশাধিকার দিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তকে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম সীমান্ত বলা হয়। বঙ্গোপসাগরে কলকাতা বন্দরের কাছেই রয়েছে বাংলাদেশের মোংলা বন্দর, মোংলা বন্দর থেকে দক্ষিন পূর্ব দিকে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। ভারতকে বানিজ্যিক জাহাজ ও কার্গো পরিবহনের জন্য এই দুই বন্দরে প্রবেশাধিকার দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। যার জন্য কলকাতা বন্দর থেকে মোংলা বন্দর ও চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে উত্তর পূর্ব ভারতে পন্য পৌঁছানোয় আরও সুবিধা হবে। 

বাংলাদেশের ন্যাশনাল বোর্ড অফ রেভেনিউ জানিয়েছে ২০১৮ সালে দুই দেশের চুক্তি অনুযায়ী ভারতকে এই দুই বন্দরে স্থায়ী প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালেই ভারত ও বাংলাদেশ মোংলা বন্দর ও চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পন্য পরিবহনের জন্য চুক্তি করে। চুক্তিতে বলা হয়েছিল আগামী এক বছরের মধ্যেই পন্য পরিবহন শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন সরকারি জটিলতায় ও করোনা মহামারীর কারনে এই চুক্তি কার্যকর হতে একটু সময় লেগে যায়। 

২০২০ সালের জুলাই মাসে ভারত হলদিয়া বন্দর থেকে লোহার রড চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠায় পরীক্ষামূলক উদ্দেশ্যে, তারপর ওই লোহার রড ত্রিপুরা পাঠানো হয়। চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের প্রধান সামুদ্রিক বন্দর যা কর্নফুলী নদীর পাশে অবস্থিত। বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ আমদানি রপ্তানি এই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই হয়। মোংলা বন্দর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সামুদ্রিক বন্দর। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর হয়ে ভারতীয় পন্য আটটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব :—

**  বাংলাদেশের আখাউরা হয়ে ত্রিপুরার আগরতলা পর্যন্ত। 

** সিলেটের টামাবিল হয়ে মেঘালয়ের ডাওকি পর্যন্ত। 

** সিওলা হয়ে আসামের সুতারকান্ডি পর্যন্ত। 

** বিবির বাজার হয়ে ত্রিপুরার শ্রীমান্তপুর পর্যন্ত। 

একইভাবে উত্তর পূর্ব ভারত থেকেও পন্য বাংলাদেশে পাঠানো সম্ভব। 

চুক্তিতে আরও বলা হয়েছে যে ভারতীয় সংস্থা চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের মাধ্যমে পন্য পরিবহন করবে তাকে পাঁচ বছরের লাইসেন্স দেওয়া হবে এবং বন্দরে ভারতীয় পন্য পৌঁছানোর পর একস সপ্তাহের মধ্যে পন্য বন্দর থেকে নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের মাধ্যমে পন্য পরিবহনের জন্য ভারতকে প্রতিটন পন্য পীছু ৩০ টাকা, নিরাপত্তা শুল্ক ১০০ টাকা প্রতি টন, প্রশাসনিক খরচ ১০০ টাকা প্রতি টন এবং বাংলাদেশের সড়কের নির্দিষ্ট টোল দিতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে। তবে ভারতকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের প্রবেশাধিকার দেওয়ার পেছনে বাংলাদেশেরও তিনটি বড় উদ্দেশ্য আছে। প্রথমত বাংলাদেশ ও মায়ানমারের মধ্যে বিরোধীতা রয়েছে, ভারত যেহেতু কালাদান প্রজেক্টে মায়ানমারের সাথে যুক্ত তার জন্য বাংলাদেশ ভারতকেও তাদের পক্ষে রাখতে চাইছে। দ্বিতীয়ত এই চুক্তির মাধ্যমে ভারতের সাহায্যে বাংলাদেশেরও পরিকাঠামো উন্নয়ন হবে। তৃতীয়ত বাংলাদেশের বিশেষ পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে আমেরিকার দেওয়া নিষেধাজ্ঞা ওঠাতে ভারতের সহায়তার উদ্দেশ্যে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *