মধ্যপ্রাচ্যের তেলের বিকল্প উৎস পেয়ে গেছে ভারতবর্ষ!
ভাগ্য কাকে কখন কোথায় নিয়ে যায় তা কেউই জানে না। আজ থেকে কয়েক দশক আগে সিঙ্গাপুর, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতো দেশের অর্থনীতি খুবই খারাপ ছিল কিন্ত বর্তমানে এই দেশগুলো অর্থনৈতিক ভাবে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ। অন্যদিকে ১৯৭০-৮০ এর দশকে ভেনিজুয়েলা দক্ষিন আমেরিকার সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী দেশ ছিল, সেসময় ভেনিজুয়েলা বিশ্বের প্রথম কুড়িটি অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যে একটি ছিল। কিন্ত বর্তমানে এই দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে গরীব দেশগুলোর মধ্যে একটি। কিন্ত মজার ব্যাপার হল এই দেশটির মানুষদের কাছে প্রচুর অর্থ রয়েছে কিন্ত সেগুলো কাগজের টুকরো ছাড়া কিছুই নয়। তবে ২০২৩ সাল থেকে দেশটির অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা হলেও উন্নত হতে শুরু করেছে। দক্ষিন আমেরিকার ভেনিজুয়েলা নামক এই দেশটি আগামীতে ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন হতে চলেছে।
৫ জুলাই ১৮১১ সালে ভেনিজুয়েলা স্পেন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। ভৌগোলিক ভাবে ভেনিজুয়েলা দেশটি দক্ষিন আমেরিকার একদম উত্তর প্রান্তে অবস্থিত। দেশটির জনসংখ্যার বেশীরভাগই স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে, যা দেশটির সরকারি ভাষাও কারন দীর্ঘকাল ভেনিজুয়েলা স্পেনের উপনিবেশ ছিল। ১৯৭০-৮০ এর দশকে বিশ্বের বহু দেশকে তেল বিক্রি করে ভেনিজুয়েলা প্রচুর অর্থ সঞ্চয় করেছিল। দেশটির জিডিপি ৫০০ বিলিয়ন ডলারের বেশী হয়ে গিয়েছিল। এত বিপুল অর্থের কারনে ভেনিজুয়েলা সরকার দেশের মানুষকে বিনামূল্যে বাড়ি তৈরি করে দিতে শুরু করে, নামমাত্র মূল্য পেট্রোল, খাদ্য, ঔষধ সরবরাহ করা শুরু হয় দেশের মানুষকে, এছাড়াও অন্যান্য অনেক কর ছাড় দেওয়া হতে থাকে।
১৯৯১ সালের পর বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমতে থাকে যার সরাসরি প্রভাব পড়ে ভেনিজুয়েলার অর্থনীতিতে, কারন দেশটির জিডিপি নির্ভর ছিল তেলের উপরে।
১৯৯৫-৯৬ সালে ভেনিজুয়েলার মূল্যবৃদ্ধি ১০০ শতাংশ বেড়ে যায় এবং দারিদ্র্যতা ৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এরপরেও শিক্ষা হয়নি দেশটির রাজনৈতিক ব্যাক্তিদের। ১৯৯৯ সাল থেকে বিশ্ববাজারে আবার তেলের দাম বাড়তে শুরু করে ফলে আবারও জিডিপি বাড়তে শুরু করে ভেনিজুয়েলার। আবারও আগের মতোন দেশটির সরকার নাগরিকদের প্রায় বিনামূল্যে জিনিস দেওয়া শুরু করে। এর ফলে একে একে বেশীরভাগ ব্যাবসায়িক সংস্থা ভেনিজুয়েলা ছেড়ে চলে যায় কারন তাদের কোন লাভই হচ্ছিলনা। এরকম অবস্থায় দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ, ব্যবসার দায়িত্ব নিজের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নেয়। একটা সময় সাবান থেকে শুরু করে রুটি পর্যন্ত দেশের সরকারই তৈরি করছিলো। উপরন্তু তেল বিক্রি থেকে আগত অর্থ সরকার কোথাও বিনিয়োগ না করেই দুর্নীতি করে এবং নাগরিকদের বিনামূল্যে পরিষেবা দেয়। যার কারনে ২০১৩ সালের পর বিশ্ব বাজারে যখন তেলের দাম আবারও কমতে শুরু করে তখন আবারও ভেনিজুয়েলার জিডিপি কমতে শুরু করে। বাধ্য হয়ে দেশটির প্রশাসন বিদেশ থেকে ঋন নিয়েও বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ শুরু করে জনগনকে। ভেনিজুয়েলার মানুষদের বিনামূল্যে জিনিস পাওয়ার স্বভাব এতটা হয়ে গিয়েছিল যে সরকার ভোটের জন্য বাধ্য হয়ে ঋন নিয়েও জনগনকে প্রয়োজনীয় জিনিস দিত। একটা সময় দেশটি ঋনের দায়ে এতটাই জর্জরিত হয়ে যায় যে সরকার বাধ্য হয় অতিরিক্ত নোট ছাপাতে। জিডিপির অতিরিক্ত নোট ছাপানো দেশটির ভঙ্গুর অর্থনীতির কফিনে শেষ পেড়েকের কাজ করে। ২০১৬ সালে দেশটির মূল্যবৃদ্ধি ৮০০ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়, ২০১৮ সালে তিন লাখ হয় এবং ২০২০ সালে মূল্যবৃদ্ধি কয়েক মিলিয়নে পৌঁছে যায়, ফলত চরম অর্থনৈতিক দুর্দশায় পৌঁছে যায় ভেনিজুয়েলা।
২০১৯ এর দিকে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞায় ভেনিজুয়েলার তেল রপ্তানিও বন্ধ হয়ে যায় যার ফলে দেশটির অর্থনৈতিক পরিকাঠামো পুরো ভেঙে পড়ে। এমন একটি অর্থনৈতিক ভাবে বিপর্যস্ত দেশই ভারতের জন্য প্রয়োজনীয় তেলের কারনে।
গত কয়েক বছর ধরেই ভারত ক্রুড অয়েল কিনছে মধ্য প্রাচ্য থেকে বিশেষ করে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, কাতার, ইরাক, ওমান, ইরানের মতো দেশগুলোর থেকে। মধ্যপ্রাচ্য তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডার আছে। তবে বিগত দুই বছরে রাশিয়া থেকে বেশী তেল কিনছে ভারত। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে রাশিয়ার উপর বিশ্বব্যাপী আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, এই অবস্থায় রাশিয়া কম মূল্যে ভারতকে ক্রুড অয়েল সরবরাহ করছে। গত জুন মাসের হিসাব অনুযায়ী ভারত রাশিয়া থেকে প্রতিদিন ২.২ মিলিয়ন ব্যারেল তেল কিনছে যা সৌদি আরব, ইরাক থেকে কেনা মোট তেলের থেকেও বেশী। কিন্ত যুদ্ধের কারনে রাশিয়ার নিজেরও তেলের প্রয়োজন, যার কারনে ভারতের প্রয়োজন রাশিয়ার বিকল্প হিসাবে এমন কোন দেশ যার থেকে ক্রুড অয়েল পাওয়া যাবে।
ভূরাজনীতিতে বলা হয় কোন একটি দেশের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল না হতে। এরকম অবস্থায় ভারতের ক্রুড অয়েলের জন্য দক্ষিন আমেরিকার ভেনিজুয়েলা উপযুক্ত বলে ধারনা করছে বিশ্লেষকরা। ভেনিজুয়েলা উপযুক্ত কারন কিছুদিন আগেই আমেরিকা ভেনিজুয়েলার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে যার কারনে বর্তমানে ভেনিজুয়েলার সাথে বানিজ্যে কোন সমস্যা হবেনা। ভারতের পেট্রোলিয়াম এবং প্রাকৃতিক গ্যাস মন্ত্রী হারদীপ সিং পুরীও জানিয়েছেন কম মূল্যে ভেনিজুয়েলা থেকে ভারতীয় তেলশোধক সংস্থাগুলি তেল কিনতে পারে। ভেনিজুয়েলা থেকে গত কয়েক বছর ভারত তেল ক্রয় করত না, কারন আমেরিকার সাথে ভেনিজুয়েলার কুটনৈতিক সম্পর্ক খুবই খারাপ ছিল।
বর্তমানে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের সরকারের সাথে ভেনিজুয়েলার কুটনৈতিক সম্পর্ক কিছুটা উন্নত হয়েছে যার কারনে আমেরিকা ভেনিজুয়েলার তেলের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। আমেরিকা ও চীনের পর ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারক দেশ সুতরাং দক্ষিন আমেরিকার এই দেশটি ভারতের ক্রুড অয়েল আমদানির নতুন কেন্দ্র হতে পারে। ভারতের সাথে ভেনিজুয়েলার নিরপেক্ষ কুটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। এস এন্ড পি গ্লোবালের তথ্য অনুযায়ী যদি ভেনিজুয়েলা থেকে ভারতীয় সংস্থাগুলি ক্রুড অয়েল কিনতে বিশেষ ছাড় পায় তাহলে প্রচুর পরিমানে তেল কিনবে ভারত। ভেনিজুয়েলা থেকে এর আগেও তেল কিনতো ভারত।
২০১৭ থেকে ২০১৯ এর মধ্যে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার আগে ভারত প্রতিদিন ভেনিজুয়েলা থেকে ৩ লাখ ব্যারেল তেল কিনত। ভারত সেসময় তার মোট তেল আমদানির ৫ থেকে ৭ শতাংশই ভেনিজুয়েলা থেকে কিনত। তবে ভেনিজুয়েলা থেকে তেল কেনায় কিছু সমস্যা আছে৷ ভেনিজুয়েলার ক্রুড অয়েল উচ্চ অ্যাসিড যুক্ত যাকে ম্যারে ১৬ গ্রেড তেল বলা হয়। ম্যারে ১৬ গ্রেডের তেলে অ্যাসিডের ভাগ বেশী থাকে যার কারনে একে তেল শোধনাগারে শোধন করা বেশ জটিল। ভারত অন্যান্য যেসব দেশ থেকে তেল কেনে সেসব দেশের তেলে অ্যাসিডের পরিমান তুলনামূলক কম থাকে। তাছাড়া ভেনিজুয়েলা সরকার থেকে তেল কেনা এবং ভারতে আনা এই পুরো প্রক্রিয়া যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ। কিন্তু তবুও ভারত ভেনিজুয়েলা থেকে তেল কিনতে চায় কারন ভারত শুধুমাত্র তেলের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের উপর নির্ভরশীল থাকতে চায়না, যদি কখনও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তেল উৎপাদন কমিয়ে দেয় তাহলে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাবে, এর প্রভাব পড়বে ভারতের অর্থনীতিতেও। এছাড়া ভূরাজনৈতিক কারনে তেলের সরবরাহে সমস্যা হলে তা ভারতের মতো বিশাল দেশের জন্য সমস্যা। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ এবং সম্প্রতি শুরু হওয়া ইসরায়েল হামাস যুদ্ধের কারনে মধ্যপ্রাচ্য অশান্ত হয়ে উঠেছে, এরকম পরিস্থিতিতে যদি তেল সরবরাহ ব্যাহত হয় তাহলে ভারতের জন্য খুবই সমস্যার ব্যাপার এটি। সেজন্য ভারত এমন একটি বিকল্প দেশের সন্ধান করছে যেখান থেকে সহজে তেল পাওয়া যাবে। ওপেক বা দি অর্গানাইজেশন অফ পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিস সংস্থাটি চাইলে তেল উৎপাদন কমিয়ে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কৃত্রিম ভাবে বাড়াতে পারে। একরম পরিস্থিতিতে যদি ভেনিজুয়েলা তেল উৎপাদন করে তাহলে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম নিয়ন্ত্রিত থাকবে।
ভেনিজুয়েলাতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল রিজার্ভ রয়েছে, অনুমান করা হয়েছে ভেনিজুয়েলাতে ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল তেল রয়েছে যা ইরাকের মোট তেল ভান্ডারের দ্বিগুন এবং আমেরিকার তেল ভান্ডারের সাত গুন।
এই কারনে ভেনিজুয়েলা ভারতের তেল কেনার জন্য আদর্শ বিকল্প।