বহু সাম্রাজ্যের কবরস্থান। দিল্লির অজানা ইতিহাস
বিখ্যাত কবি মির্জা গালিব বলেছেন এই বিশ্বের প্রান হচ্ছে দিল্লি। ভারতের রাজধানী, ভারতের প্রানকেন্দ্র ও রাজনৈতিক কেন্দ্র হচ্ছে দিল্লি। যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত এই শহরের ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের পুরোনো। বহু সাম্রাজ্যের উত্থান পতনের সাক্ষী এই শহর। যেমন রোমান সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল রোম শহর, ঠিক তেমনি সুপ্রাচীনকাল থেকেই ভারতে আক্রমনকারী বৈদেশিক শক্তিগুলোর কাছে ভারত দখলের প্রথম পদক্ষেপই ছিল দিল্লির সিংহাসন দখল।
১১৯২ সালে মহম্মদ ঘোরী কয়েকবার পরাজিত হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত পৃথ্বীরাজ চৌহানকে ষড়যন্ত্র করে হারিয়ে দিল্লির সিংহাসন দখল করেছিলেন, এরপরে একে একে অনেক সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল দিল্লি। রাজপুত, পান্ডবাস থেকে মুঘল, আফগান, মোঙ্গল সবাই দিল্লিতে শাসন করেছে। সপ্তম থেকে বারো শতক পর্যন্ত দিল্লির সিংহাসনে প্রায় পঞ্চাশ জনের বেশী রাজা শাসন করেছেন। এজন্য ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু বলেছিলেন দিল্লি অনেক সাম্রাজ্যের কবরস্থান। দিল্লি এতটা গুরুত্বপূর্ণ কেন ছিল যার কারনে এই শহর দখলের জন্য কোনও ছেলে তার নিজের পিতাকেই হত্যা করেছিল কিংবা নিজের আত্মীয়র রক্ত বইয়েছিল! কেনই বা দিল্লি সব সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল এবং দিল্লির ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
প্রাচীন গ্রন্থে বলা হয়েছে যে দিল্লিতে শাসন করবে সেই ভারতে শাসন করবে। ভারতীয় ইতিহাসে দিল্লির উল্লেখ পাওয়া যায় মহাভারতে। তখন দিল্লি সহ আশেপাশের অঞ্চলকে বলা হত খাণ্ডবপ্রস্থ বা পাথরের শহর। হস্তিনাপুর সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা এই শহর একদম বর্জিত ছিল। শ্রীকৃষ্ণের আদেশে মহারাজ যুধিষ্ঠির ও বাকী পান্ডব ভাইরা খাণ্ডবপ্রস্থে তাদের রাজত্ব তৈরি করে এবং তাদের রাজধানী হয় ইন্দ্রপ্রস্থ যার অর্থ দেবরাজ ইন্দ্রের নগরী। সেই প্রাচীন ইন্দ্রপ্রস্থই অধুনা দিল্লি। ঐতিহাসিকদের তথ্য অনুযায়ী নতুন দিল্লিকে মিলিয়ে মোট আটটি শহর ছিল এখানে, যা বিভিন্ন সাম্রাজ্যের আমলে তৈরি হয়েছিল। দিল্লির এই আটটি শহরের সূত্রপাত ১০৬০ খ্রিস্টাব্দে, যখন তোমার সাম্রাজ্যের রাজা অনঙ্গপাল তোমার তার রাজধানী লালকোটে স্থাপন করেন যা দিল্লির প্রথম শহর বলে পরিচিত। তোমার রাজবংশ ছিল গুর্জর প্রতিহার রাজবংশেরই একটি ভাগ যার উত্থান হয় গুর্জর প্রতিহার বংশের ও পতনের পর।
ভারতের ৩৬ টি রাজপুত রাজবংশের একটি হচ্ছে এই তোমার রাজবংশ। রাজধানীতে তোমাররা একটি দুর্গ তৈরি করে একেই লালকোট বলা হয়। ১১৭৯ সালে পিথ্বীরাজ তৃতীয় বা পিথ্বীরাজ চৌহান দিল্লির রাজা হন এবং তিনি তোমারদের থেকে দিল্লি অধিকার করে লালকোট শহরের বিস্তার ঘটান। ষোলো শতাব্দীতে মুঘল ঐতিহাসিক আবুল ফজল এই লালকোটের নাম দেন কিলা রায় পিথোরা বা রাজা পিথ্বীরাজের দুর্গ। দিল্লির কুতবমিনার, সাকেত, মেহেরাউলি, বসন্ত কুঞ্জ এলাকায় আজও এই শহরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। দিল্লির বিখ্যাত আয়রন পিলার উদয়গিরি থেকে এনে দিল্লিতে স্থাপন করেছিলেন অনঙ্গপাল। ১১৯২ সালে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ চৌহানকে হারিয়ে মহম্মদ ঘোরী চৌহান রাজবংশের রাজত্ব শেষ করেন। এরপরে দিল্লি শহরের যা ইতিহাস এবং এখানে শাসন করা রাজবংশের ইতিহাস যেকোনও ছবির গল্পকেও হার মানাবে। দিল্লির প্রথম সুলতান একসময় শাসকের প্রজা ছিল। ১২০৬ সালে মহম্মদ ঘোরীর মৃত্যুর পর তারই লেফটেন্যান্ট জেনারেল কুতুবউদ্দিন আইবক নিজেকে দিল্লির সুলতান হিসাবে ঘোষনা করেন এবং দিল্লিতে শুরু হয় মামলুক রাজবংশের। তবে এসময় এই রাজত্বের রাজধানী ছিল লাহোর।
১২১০ সালে কুতুবউদ্দিন আইবকের মৃত্যুর পর মামলুক রাজবংশের নতুন সুলতান হয় তারই জামাই শামসুদ্দিন ইলতুতমিস এবং তিনিই তার রাজধানী লাহোরের বদলে দিল্লিকে ঘোষনা করেন। এইসময় দিল্লির প্রাণকেন্দ্র ছিল মেহরালি। ১২৯০ সালে মামলুক রাজবংশের পতনের পর জালালউদ্দিন খিলজি দিল্লির সিংহাসন দখল করে এবং শুরু হয় খিলজি রাজত্ব। জালালউদ্দিন খিলজি মামলুক রাজবংশের জায়গিরদার ছিলেন, যে শেষ রাজা মইজউদ্দিন কৈকাবাদকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু ১২৯৬ সালে তারই জামাই আলাউদ্দিন খিলজি তাকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেন। এইসময় দিল্লিতে দ্বিতীয় শহর নির্মান হয় সিরি।
মোঙ্গল আক্রমন থেকে বাঁচতে কুতুবমিনারের পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বে এই দুর্গ তৈরি করা হয়। ১৫৪০-৪৫ এ শেরশাহ সুরি এই দুর্গ ধ্বংস করেন। আলাউদ্দীন খিলজিকে তারই জেনারেল মালিক কাফুর হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেন। তবে মালিক কাফুরকেও পরে হত্যা করা হয়। ১৩২২ সালে খুসরাব খান খিলজি রাজত্বের পতন ঘটায় তবে খুব শীঘ্রই গিয়াসুদ্দিন তুঘলক খুসরব খানকে হত্যা করে তুঘলক রাজত্বের সূচনা করে। গিয়াসুউদ্দিন দিল্লির তৃতীয় শহর তুঘলকাবাদ তৈরি করে। মোঙ্গল আক্রমন থেকে বাঁচতে এই তুঘলকাবাদ দুর্গ তৈরি হয়। কিন্তু ১৩২৪ সালে পিতা গিয়াসুদ্দিনকে হত্যা করে তার পুত্র মহম্মদ বিন তুঘলক দিল্লির নতুন সুলতান হন এবং দিল্লির চতুর্থ শহর জাঁহাপানা তৈরি করা হয় যার জন্য ১৩২৭ সালে তুঘলকাবাদ দুর্গ পরিত্যক্ত হয়ে যায়। কিলা রায় পিথোরাগর এবং সিরি দুর্গকে মিলিয়ে ছিল এই জাঁহাপনা দুর্গ। এবিষয়ে আরও ভালভাবে জানা যায় বিখ্যাত মরোক্কান ভ্রমনকারী ইবন বতুতার লেখা থেকে যিনি ১৩৩৩-১৩৪১ পর্যন্ত দিল্লিতেই ছিলেন। ১৩৫১ সালে ফিরোজ শাহ তুঘলক দিল্লির নতুন রাজা হন যিনি দিল্লির পঞ্চম শহর নির্মান করেন যাকে ফিরোজাবাদ বা ফিরোজা শাহ কোটলাও বলা হয়। তুঘলক রাজত্বের শেষের দিকে মোঙ্গল শাসক তৈমুর ভারত আক্রমন করে লুঠপাট করে এবং দুই লাখের মতো মানুষকে হত্যা করা হয়। তৈমুর ফিরে যাওয়ার আগে দিল্লির শাসনভার দিয়ে যায় তারই সেনাপ্রধান খাইজার খান কে এবং শুরু হয় দিল্লিতে সৈয়দ রাজবংশের যা দিল্লির ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্বল রাজত্ব ছিল। ১৪৫১ সালে দিল্লির শাসনভার অধিকার করে লোদী বংশ। বহুলল লোদীর সাথে যুদ্ধে হেরে পালিয়ে যায় সৈয়দ বংশের শেষ সুলতান। ১৫২৬ সালে পানিপথের যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে দিল্লিতে মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা করেন বাবর। ১৫৩০ সালে বাবরের পুত্র হুমায়ুন শাসনভার গ্রহন করে কিন্তু ১৫৪০ সালে বিহারের সুলতান শের শাহ সুরি দিল্লি দখল করে সুরি সাম্রাজ্যের সূচনা করে। শের শাহ সুরি দিল্লির ষষ্ঠ শহর শেরগড় তৈরি করে। আবুল ফজলের লেখনী অনুযায়ী শেরগড় তৈরি হয়েছে মহাভারতের ইন্দ্রপ্রস্থের ধ্বংসস্তূপের উপর। মুঘল সাম্রাজ্যে বাবর থেকে শুরু করে জাহাঙ্গীর পর্যন্ত মুঘলের রাজধানী ছিল আগ্রা তবে শাহজাহানের সময়ে আগ্রা থেকে দিল্লি মুঘলদের রাজধানী হয়, এজন্য দিল্লির সপ্তম শহর শাহজাহানাবাদ তৈরি করে শাহজাহান ১৬৪৮ সালে এবং ১৮৫৭ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের আগে পর্যন্ত এটাই ছিল মুঘলদের রাজধানী। এখানেই বিখ্যাত লালকেল্লা ও চাঁদনীচক অবস্থিত। তবে ১৭৫২ থেকে ১৮০৩ সাল পর্যন্ত পরোক্ষভাবে দিল্লিতে মারাঠাদের প্রভাব ছিল। এরপর দিল্লিতে ইংরেজ শাসন শুরু হয়। ১৯১১ সালে কলকাতার বদলে দিল্লিকে ইংরেজরা ভারতের রাজধানী হিসাবে ঘোষনা করে এবং নতুন দিল্লি বা লিওটিয়ান্স দিল্লি নামে দিল্লির অষ্টম শহর তৈরি করে। সুতরাং দিল্লি শহরের ইতিহাস দেখলে বোঝা যায় ক্ষমতার লোভে মানুষ নিজের বাবা, পরিজনদের মারতেও দ্বিধাবোধ করেনা৷ সেই রাজপুতদের সময় থেকেই দিল্লি ছিল ভারতের গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্যিক কেন্দ্র। দিল্লির মাধ্যমে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ শহর গুলোতে বানিজ্য হত, এজন্য সবসময় দিল্লি ভারতের ধনী রাজ্য গুলোর মধ্যে একটি ছিল। যার কারনে যেকোনও সাম্রাজ্যের লক্ষ্য থাকত দিল্লি দখল করা, কারন দিল্লির মাধ্যমে অধিকাংশ ভারতে খুব সহজেই সাম্রাজ্য বিস্তার সম্ভব ছিল। এজন্য একসময় দিল্লিকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ রাজধানী বলা হত।