ফিচার আর্টিকেল

যেভাবে এক ব্যক্তির কারনে পুরো আমেরিকাতে ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপ শুরু হয় এবং আমেরিকা স্বাধীনতা লাভ করে

জার্মানির স্বৈরাচারী শাসক অ্যাডলফ হিটলার একবার বলেছিলেন যখন কিছু মানুষকে বোঝানোর প্রয়োজন হয় তখন তিনি যুক্তি ব্যবহার করেন এবং যখন বহু মানুষকে কিছু বোঝানোর প্রয়োজন হয় তখন তিনি আবেগকে ব্যবহার করেন। মানুষ অনেকসময় যুক্তি দিয়ে কিছু বোঝেনা কিন্তু সেই মানুষই আবেগে পড়ে একই জিনিস বুঝে যায়। এই পদ্ধতিই ব্যবহার করে একবার এক আমেরিকান ব্যক্তি ব্রিটিশ লোকদের তার আয়ত্তে এনেছিল। ১৭৬৫ সালে আমেরিকা ব্রিটেনের অধীনে ছিল। ব্রিটেন থেকে বহু লোক সেসময় আমেরিকাতে এসে বসতি স্থাপন করেছিলো। এসব লোকেদের কলোনিস্ট বলা হত। স্বাভাবিক ভাবেই এদের আনুগত্য ব্রিটিশদের প্রতিই ছিল। এই সময়েই একজন আমেরিকান দার্শনিক স্যামুয়েল অ্যাডামস মনে করতো আমেরিকাকে ব্রিটিশ শাসন থেকে বেরিয়ে স্বাধীন হওয়া প্রয়োজন। তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আমেরিকার স্বাধীনতার জন্য দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য একাধিক আর্টিকেল লেখা শুরু করেন বিভিন্ন পত্রিকায়। কিন্তু সেসময় বেশীরভাগ কলোনিস্টরা মনে করতো তাদের ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই, কারন ব্রিটেন তাদের সমস্ত সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে। কিন্তু অল্প কিছু সংখ্যক এমন মানুষজনও ছিল যারা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা চাইছিলো। 

১৭৬০ এর দশকে হঠাৎই ব্রিটিশ অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অতিরিক্ত অর্থের জন্য ব্রিটেন স্ট্যাম্প আইন চালু করবার সিদ্ধান্ত নেয় আমেরিকায়। স্ট্যাম্প আইনে বলা ছিলো যদি আমেরিকাতে কোনও ব্যক্তিকে ব্যবসা করতে হয় তবে ব্রিটেনের কাছে একটি অনুমতিপত্রে ব্রিটেনের রাজমুকুটের একটি স্ট্যাম্প লাগাতে হবে। এতদিন পর্যন্ত স্যামুয়েল অ্যাডামসের আর্টিকেল তেমন বেশী লোক অনুসরন করতোনা। কিন্তু এই স্ট্যাম্প আইনের মাধ্যমে ব্রিটিশ বিরোধীতার একটি বড় সুযোগ পেয়ে যায় সে। স্যামুয়েল অ্যাডামস প্রচার করতে শুরু করে আমেরিকা প্রতিবছর যথেষ্ট পরিমান কর দেয় ব্রিটেনকে, তাসত্বেও ব্রিটিশরা স্ট্যাম্প আইনের মাধ্যমে অতিরিক্ত কর চাইছে, এত কর তারা দেবেনা। স্যামুয়েল অ্যাডামস ব্রিটিশদের উদ্দেশ্যে দাবী করে তারা এত বেশী কর দিচ্ছে ব্রিটেনকে তবে এর বদলে সংসদে আমেরিকান প্রতিনিধি নিয়োগ করতে হবে। প্রথমদিকে আমেরিকানরা স্যামুয়েল অ্যাডামসকে ততটা পাত্তা না দিলেও, এবার স্যামুয়েল অ্যাডামসের অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। স্যামুয়েল সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেনী বিশেষ করে শ্রমিকদের সাথে একটি ভালো সম্পর্ক তৈরি করে এবং তাদের নিয়ে সনস অফ লিবার্টি নামে একটি সংগঠন তৈরি করে। এই সংগঠন স্ট্যাম্প আইনের বিরোধীতা শুরু করে আমেরিকায় এবং তাদের স্লোগান ছিল লিবার্টি, প্রপার্টি এবং নো স্ট্যাম্প। ধীরে ধীরে এই প্রতিবাদ হিংস্রতার রূপও নেয়, সংগঠনের লোকেরা যেসব জায়গায় স্ট্যাম্প পাওয়া যেত সেখানে হামলাও করতো। যেদিন স্ট্যাম্প আইন সরকারি ভাবে আইন হওয়ার কথা ছিল আমেরিকাতে তার আগেই স্যামুয়েল ম্যাসাচুসেটসে সমস্ত দোকান, ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন এতটাই তীব্র ছিল যে ব্রিটেনের রাজা জর্জ তৃতীয় বাধ্য হয় স্ট্যাম্প আইন প্রত্যাহারে। এই ঘটনা তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল যে আমেরিকার লোকেদের সামনে ব্রিটিশ রাজা পীছু হটতে বাধ্য হয়। তবে এই ঘটনায় স্যামুয়েল অ্যাডামস অনেক বেশী উৎসাহিত হয় এবং সে ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপ আরও বেশী করে শুরু করে। 

ব্রিটিশরা স্ট্যাম্প আইন প্রত্যাহার করে নিলেও ১৭৬৭, ১৭৬৮ সালে এমন কীছু আইন প্রনয়ন করে যাতে পরোক্ষভাবে তারা আমেরিকা থেকে কর পেত। এসব আইনের বিরুদ্ধেও আমেরিকাতে তীব্র সহিংস আন্দোলন শুরু হয় যাতে ব্রিটেন আমেরিকাতে তাদের সরকারি কার্যালয়গুলিকে রক্ষা করতে সেনা পাঠাতে বাধ্য হয়। আমেরিকার মানুষজন সেসময় দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়, একদল মানুষ চাইলো ব্রিটিশ শাসন থেকে সম্পূর্ন স্বাধীনতা তাদের প্যাট্রিয়টস বলা হত এবং একদল লোক তখনও ব্রিটিশদের অধীনেই থাকতে চাইতো তাদের লয়্যালিস্ট বলা হত। আমেরিকাতে সেসময় প্যাট্রিয়টস ও লয়্যালিস্টদের মধ্যে প্রায়ই লড়াই হত। ১৭৭০ সালের মার্চ মাসে বোস্টনের কাস্টমস অফিসের বাইরে হঠাৎই ব্রিটিশ সেনাবাহিনী একদল আমেরিকান আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালিয়ে দেয় যাতে পাঁচজন লোকের মৃত্যু হয়। এই ঘটনা বোস্টন গনহত্যা নামে পরিচিত। সাথে সাথে পুরো আমেরিকা জুড়ে আরও জোরদার ব্রিটিশ বিরোধীতা শুরু হয়। স্যামুয়েল অ্যাডামসও ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে কোনও রেস্টুরেন্টে খাওয়ার না দিতে, হোটেলে আশ্রয় না দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করে। আমেরিকাতে ব্রিটিশ বিরোধীতা এতটা বড় রূপ নেয় যে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর লোকেরা নিজেরাও কোনওরকমে আমেরিকা থেকে পালাতে চাইছিলো। ১৭৭৩ সালে ব্রিটিশরা আরও একটি ভুল করে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের মুনাফার জন্য আমেরিকাতে একটি নতুন আাইন প্রনয়ন করে যে আমেরিকাতে একমাত্র তারাই চা বিক্রি করবে অন্যকেউ বিক্রি করতে পারবেননা। তবে এই আইনে লাভ হত আমেরিকানদেরই। কারন এর আগে ব্রিটিশদের থেকে কীছু আমেরিকান ব্যবসায়ী চা কিনে বিক্রি করতো যাতে চায়ের দামও বৃদ্ধি পেত কিন্তু ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরাসরি চা বিক্রির কথা ঘোষনা করায় চায়ের দাম কমতো। কিন্ত এই ঘটনা স্যামুয়েল সম্পূর্ন ভিন্নরূপে উপস্থাপন করে। স্যামুয়েল প্রচার করা শুরু করে ব্রিটিশরা সস্তা চা খাইয়ে তাদের থেকে স্বাধীনতা কেড়ে নিতে চাইছে। 

১৭৭৩ সালে স্যামুয়েল ও তার সনস অফ লিবার্টি সংগঠন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বদলা নেওয়ায় একটি বিশেষ পরিকল্পনা করে। ১৭৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসে বোস্টন বন্দরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চা বোঝাই জাহাজ দাঁড়িয়েছিল। সেসময় সনস অফ লিবার্টির সদস্যরা আদি আমেরিকানবাসীর ছদ্মবেশে ব্রিটিশ জাহাজে গিয়ে হামলা করে এবং সমস্ত চা সমুদ্রে ফেলে দিয়ে তারা পালিয়ে যায় সেখান থেকে। ইতিহাসে এই ঘটনা বোস্টন টি পার্টি নামে পরিচিত। এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে ব্রিটিশরা পুরো বোস্টন বন্দরই বন্ধ করে দেয় এবং ম্যাসাচুসেটসে সামরিক আইন জারি করে। যার জন্য আরও বেশী আমেরিকান ব্রিটিশদের বিরোধী হয়ে ওঠে। এসব কারনে আমেরিকাতে লয়্যালিস্টরাও ব্রিটিশ বিরোধী হয়ে ওঠে। ১৭৭৫ সালে আবারও ব্রিটিশ সেনাবাহিনী কীছু আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালায়। আমেরিকাতে ব্রিটিশ বিরোধীতা এতটা তীব্র আকার ধারন করে যে শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশরা হার মানতে বাধ্য হয়। ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই ১৩টি আমেরিকান কলোনী একসাথে আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষনা করে। আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনে স্যামুয়েল অ্যাডামস ছাড়াও জর্জ ওয়াশিংটন সহ বহু নেতা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলো। তবে ১৭৬৫ সাল থেকে স্যামুয়েল অ্যাডামসই ব্রিটিশ বিরোধী মতবাদ প্রচার শুরু করেছিল আমেরিকা জুড়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *