রাশিয়ার সাথে দীর্ঘ প্রতিক্ষিত রেলোস চুক্তি এখনও হলনা ভারতের!
গত কয়েক সপ্তাহে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দুটি দেশে কুটনৈতিক সফরে গিয়েছিলেন রাশিয়া ও অস্ট্রিয়া। তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাশিয়া সফরের দিকে নজর ছিল গোটা বিশ্বের। কারন ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাশিয়া বিশ্বে একঘরে হয়ে রয়েছে রাশিয়ার পাশে চীন ছাড়া কোনওদেশ নেই। পশ্চিমা দেশগুলোর বারবার অনুরোধ সত্বেও ভারত রাশিয়ার উপর কোনওরূপ নিষেধাজ্ঞা দেয়নি উপরন্ত রাশিয়ার সাথে ভারত বানিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া সফরে খুশি নয় আমেরিকা সহ ইউরোপীয়ান দেশ গুলো। তবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর এই রাশিয়া সফর যথেষ্ট গেম চেঞ্জার বলেই মনে করছে রাশিয়া। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাশিয়া সফর যথেষ্ট সফল হয়। রাশিয়া সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মানও দেয় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে। তাছাড়া ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে বেশ কিছু চুক্তিও হয়। কিন্তু ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন চুক্তি রেলোস চুক্তি এবারেও হয়নি, এই একই ধরনের চুক্তি ২০১৬ সালেই ভারত ও আমেরিকার মধ্যে হয়েছে। রাশিয়া রেলোস চুক্তিপত্র তৈরি করে ফেলেছিলো কিন্তু কিছু কারনবশত এবারেও এই চুক্তি হয়নি।
২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবার মাত্র দুই বছরের মধ্যে নরেন্দ্র মোদী আমেরিকার সাথে দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা লজিস্টিক চুক্তি লেমোয়া স্বাক্ষর করে। এরপর একে একে বেকা, কনকাসার মতোন চুক্তিও হয় আমেরিকার সাথে।
লেমোয়া বা লজিস্টিক এক্সচেঞ্জ মেমোরেন্ডাম অফ এগ্রিমেন্টলর মাধ্যমে আমেরিকা ও ভারতের মধ্যে কুটনৈতিক সম্পর্ক আরও মজবুত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী ভারত ও আমেরিকা উভয়দেশই প্রয়োজনে উভয়ের নৌঘাঁটি ব্যবহার করতে পারবে। যেমন ভারত মহাসাগরে কোনও অপারেশনে আমেরিকা চাইলে ভারতের নৌঘাঁটি ব্যবহার করতে পারবে আবার ভারতও আমেরিকার নেভাল বেস ব্যবহার করতে পারবে কোনও অপারেশনে। এই ধরনের চুক্তি আগে কখনও ভারত কারও সাথে করেনি। আমেরিকার সাথে লেমোয়া চুক্তির পরেই ফ্রান্স, দক্ষিন কোরিয়া, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সাথেও ভারত একই ধরনের চুক্তি সাক্ষরিত করে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার এটাই ছিল যে এতসব দেশের সাথে চুক্তি হলেও দীর্ঘদিনের পুরোনো বন্ধু রাশিয়ার সাথে ভারতের এধরনের কোনও চুক্তি হয়নি কখনও। ভারতের বিদেশনীতিতে সবসময় আমেরিকা ও রাশিয়াকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সেজন্য আমেরিকার সাথে লেমোয়া চুক্তি হওয়ার পর ধরে নেওয়া হয়েছিল রাশিয়ার সাথেও এধরনের চুক্তি হবে। কিন্ত ২০১৬ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত আট বছরেও ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে এই চুক্তি হয়নি।
২০২১ সালে শোনা গেছিল ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে খুব শীঘ্রই রেলোস বা রেসিপ্রোকাল এক্সচেঞ্জ অফ লজিস্টিক এগ্রিমেন্ট হবে। রাশিয়ার সরকার তাদের ওয়েবসাইট চুক্তির যাবতীয় তথ্য প্রকাশও করেছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর এবারের রাশিয়া সফরেও এই চুক্তি হলনা ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে। ভূরাজনৈতিক বিশেষজ্ঞগনের ধারনা সম্ভবত আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে কুটনৈতিক সম্পর্কে সমতা রাখতেই ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে এই রেলোস চুক্তি হয়নি। কারন চুক্তি হলে রাশিয়া ভারতের নৌ ঘাঁটি ব্যবহার করার অনুমতি পেত যেটা আমেরিকা সহ অন্যান্য দেশের সমস্যার কারন ছিল। তবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া সফরের পরেও আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলো খুব বেশী বিরোধীতা করেনি এই ঘটনায় সবচেয়ে বেশী অবাক হয়েছে চীন। কারন চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং এর রাশিয়া সফরের তীব্র সমালোচনা করেছিল পশ্চিমা দেশগুলো। রাশিয়াতে শি জিনপিং এর মতোই কুটনৈতিক সম্মান দেওয়া হয়েছে নরেন্দ্র মোদীকে তারপরেও আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তেমন কোনও উচ্চবাচ্য না করায় যথেষ্ট ক্ষুব্ধ চীন। রাশিয়া সফরের পরেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অস্ট্রিয়া সফরে গিয়েছিলেন। অস্ট্রিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি গুরুত্বপূর্ন দেশ এবং বাকী সব ইউরোপীয় লান দেশের মতো অস্ট্রিয়াও রাশিয়ার উপরেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়া সত্বেও অস্ট্রিয়া ন্যাটোর সদস্য নয়। ভারতের এরকম বিদেশনীতি দেখে চীন অবাকই হয়ে গেছে।
রাশিয়ার সাথে রেলোস চুক্তি না হলেও রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে একাধিক চুক্তি হয়েছে। যেমন বর্তমানে রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে প্রতিবছর ৬৫ বিলিয়ন ডলারের বানিজ্য হয়, ২০৩০ এর মধ্যে এই বানিজ্য ১০০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছে দুই দেশই। রাশিয়া থেকে ভারত মূলত খনিজ তেল কেনে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়েছে রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞার কারনে ভারত রাশিয়া থেকে অনেক কম মূল্যে খনিজ তেল কিনছে যা দুই দেশের বানিজ্যিক সম্পর্ককে আরও মজবুত করেছে। ইউরোপিয়ান দেশ গুলো আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ভারত রাশিয়া থেকে ইউরেনিয়াম ও কিনবে। পরমানু বিদ্যুৎশক্তি অপ্রচলিত শক্তি উৎপাদক হিসাবে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ন। রাশিয়া ভারতে ছয়টি পরমানু চুল্লি নির্মান করতে চায়, ইতিমধ্যেই একটি নির্মান সম্পূর্ন হয়ে গেছে। সুতরাং রাশিয়া চাইছে তাদের ইউরেনিয়াম বিক্রির উপর পশ্চিমা দেশগুলো যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সেই ইউরেনিয়াম জ্বালানি হিসাবে ভারতকে বিক্রি করবে। যদিও ইউরেনিয়াম চুক্তি এখনও হয়নি, তবে এই ব্যপাারে কথা চলছে উভয়দেশেরই। খুব শীঘ্রই ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে ইউরেনিয়াম চুক্তি হতে চলেছে। তবে এইমূহুর্তে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারনে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে রেলোস চুক্তি না হলেও আগামী এক দুই বছরের মধ্যে এই চুক্তি হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। রাশিয়ার পাশপাশি ভারত ইউরোপের সাথেও সুসম্পর্ক বজায় রাখছে। ভারত বহুদিন ধরেই ইউরোপের সাথে একটি মুক্ত বানিজ্য চুক্তি করার চেষ্টা করছে, এর জন্য ইউরোপীয়ান দেশগুলোর সমর্থন প্রয়োজন। এই জন্যই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অস্ট্রিয়া সফরে গিয়েছিলেন। বিগত চার দশকে নরেন্দ্র মোদী প্রথম কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যিনি অস্ট্রিয়া সফরে যান। এরপরেই অস্ট্রিয়া ইউরোপের সাথে ভারতের মুক্ত বানিজ্যে সমর্থন জানিয়েছে। অস্ট্রিয়ার পাশাপাশি ফ্রান্স, ইতালিও ভারতকে সমর্থন করছে। তবে এখনও জার্মানি, পোল্যান্ড, সুইডেনের মতোন গুরুত্বপূর্ন ইউরোপীয়ান দেশের সমর্থন প্রয়োজন ভারতের।