ফিচার আর্টিকেল

মার্শাল আইল্যান্ড বর্তমানে ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ন হয়ে পড়েছে, এখানে ভারত ও চীনের মধ্যে কার প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে!

সম্প্রতি ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী এস জয় শংকর প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ মার্শাল আইল্যান্ডে চারটি গুরুত্বপূর্ন প্রজেক্ট ঘোষনা করেছে যার মধ্যে একটি হচ্ছে বিমানবন্দর নির্মান। এছাড়াও মার্শাল আইল্যান্ডে ভারত একটি স্পোর্টস সেন্টার, এয়ারপোর্ট টার্মিনাল ও কমিউনিটি বিল্ডিং নির্মান করবে। এইসব প্রজেক্টের জন্য ভারত সরকার এই দ্বীপ দেশটিকে অর্থ সাহায্য করবে, তবে এটা কোনও ঋন নয়, এই অর্থ ভারত ফেরতও নেবেনা। প্রশান্ত মহাসাগরে নিউজিল্যান্ড, মেক্সিকো, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এসব দেশগুলোর মাঝে অনেক ছোট ছোট দ্বীপ দেশ রয়েছে এগুলোকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশ বলা হয় আবার এসব দেশগুলো পলিনেশিয়া, মাইক্রোনেশিয়াতেও বিভক্ত রয়েছে। এদের মধ্যেই একটি দেশ হচ্ছে মার্শাল দ্বীপ যেখানে ভারত সরকার বিমানবন্দর নির্মানের কথা ঘোষনা করেছে। বর্তমানে ভূরাজনীতিতে মার্শাল আইল্যান্ডের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে কারন সম্প্রতি চীন এই দ্বীপ রাষ্ট্রটির সাথে নিরাপত্তা চুক্তি করেছে। যার জন্য ভারত ও পশ্চিমা দেশগুলোর নজর পড়েছে এই দেশটিতে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশগুলোতে বিনিয়োগ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবার ভারতও এখানে যুক্ত হয়েছে। 

কিছুদিন আগেই জাপান প্যাসিফিক দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর সাথে বৈঠক করে দেশগুলোতে আরও সহায়তার কথা ঘোষনা করে। গত ১৪ জুলাই আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার সহায়তায় প্যাসিফিক দেশগুলোকে বিশ্বব্যাংক একটি নির্দিষ্ট অর্থ প্রদানের ঘোষনা করে। এছাড়াও আমেরিকা আলাদা করে এসব দেশগুলোর উন্নয়নের জন্য ৬৪ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তা ঘোষনা করেছে। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপানের মতোন দেশ নিয়মিত ভাবেই প্যাসিফিক দেশগুলোতে বিনিয়োগ করে চলেছে। এসব দেশগুলো প্যাসিফিক অঞ্চলে এত বেশী বিনিয়োগ করছে কারন চীনের ভয়ে। প্রশান্ত মহাসাগরে মোট ১৪টি দ্বীপ রাষ্ট্র রয়েছে, এদের মধ্যে ১০টি দেশের সাথে চীনের কুটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। চীনের বহুদিন ধরেই লক্ষ্য এসব দেশগুলোর সাথে নিরাপত্তা চুক্তি করা। চীন মার্শাল আইল্যান্ডের সাথে যে নিরাপত্তা চুক্তি করেছে তা অত্যন্ত গোপন রেখেছিল, চুক্তির বিষয়ে কোনও তথ্যই প্রথমে জানানো হয়নি। কিন্তু পরবর্তীকালে এই চুক্তির তথ্য ফাঁস হয়ে যায় যাতে দেখা যায় চীন নিরাপত্তা চুক্তির আওতায় মার্শাল আইল্যান্ডে কয়েক মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে চলেছে, দেশটির পুলিশ বাহিনীকে প্রশিক্ষন দেবে, সাইবার সিকিউরিটিতেও প্রশিক্ষন দেবে এবং প্রয়োজনে মার্শাল আইল্যান্ডে চীন তার সামরিক উপস্থিতিও বাড়াবে। অর্থাৎ একপ্রকার চীন এখানে নব্য ঔপনিবেশবাদ শুরু করতে চাইছে। এই খবর প্রকাশ হওয়ার সাথেসাথে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার মতোন দেশগুলো প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশগুলোর সাথে বৈঠক করে এবং যার ফলস্বরূপ দশটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ চীনের এই নিরাপত্তা চুক্তির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। এসব দেশগুলো খুব একটা আর্থিকভাবে শক্তিশালী নয়, এসব দেশের মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ দরকার। সেজন্য পশ্চিমা দেশগুলো এখানে বিনিয়োগ করছে যাতে চীন না বিনিয়োগ করতে পারে। 

চীনের হঠাৎ করে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এতবেশী সক্রিয় হবার প্রধান কারন হল এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন বা ইইজেড। জাতিসংঘের সমুদ্র আইন অনুযায়ী কোনও দেশের উপকূল ভাগ থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল অঞ্চলকে দেশটির এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন বলা হয়। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো আয়তনে অনেক ছোট হওয়ায় এদের ইইজেড অনেক বেশী হয়। যেমন কিরিবাতি, এফএসএমের মতোন দেশের ইইজেড ভারতের থেকেও বেশী। এসব দেশগুলোর জনসংখ্যা খুবই কম কিন্তু বিশাল সামুদ্রিক সীমা রয়েছে। এখানের অনেক দ্বীপেই কোনও জনবসতি নেই। রাশিয়া থেকে এই অঞ্চল অনেকটাই দূর হওয়ায় শীতল যুদ্ধের সময় আমেরিকা, ফ্রান্স, ইউকে এই অঞ্চলে পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা করেছে অনেকবার। ঐতিহাসিক ভাবেই প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর সাথে আমেরিকা সহ পশ্চিমা দেশগুলোর কুটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান ও আমেরিকার মধ্যে এসব দ্বীপ দেশগুলোর দখল নিয়ে যুদ্ধ হয়েছিল। ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ যেমন প্রাকৃতিক ভাবেই এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার হিসাবে কাজ করে। ঠিক তেমনি এই প্যাসিফিক দেশগুলোও প্রাকৃতিক এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের মতোনই কাজ করে। এই অঞ্চল থেকে প্রশান্ত মহাসাগর সহ সমগ্র ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব। ইন্দো প্যাসিফিক ভবিষ্যতের ভূরাজনীতির মূল কেন্দ্র বিন্দু। এই জন্য এই অঞ্চল স্ট্রাটেজিক ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। চীনের এই অঞ্চলে এত আগ্রহের প্রধান কারন হচ্ছে বিপুল সামুদ্রিক সম্পদ। এছাড়া চীন তার নৌবাহিনীর শক্তি ক্রমশ বৃদ্ধি করছে। ইতিমধ্যেই সংখ্যার বিচারে চীনের নৌবাহিনী আমেরিকাকেও ছাড়িয়ে গেছে। চীন ব্লু ওয়াটার নেভি গঠনের মাধ্যমে দক্ষিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও তার প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। তাছাড়া ভবিষ্যতে চীন তাইওয়ানকে দখল করলে তাইওয়ান যে চীনের অংশ তার জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন লাগবে। 

ভারত, আমেরিকার মতোন পশ্চিমা দেশগুলো কখনওই চীনকে ভোট দেবেনা। সেক্ষেত্রে দক্ষিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশগুলো চীনের পক্ষে থাকলে চীন ১৪টি ভোট পাবে। চীনের এসব পরিকল্পনা প্রতিরোধ করতেই আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া সক্রিয় হয়েছে এই অঞ্চলে। পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি ভারতও এখানে তার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। চীনের তুলনায় প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারতের প্রভাব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এর প্রধান কারন হচ্ছে বিশ্বে চীনের পরিচয় একটি আগ্রাসী সামরিক শক্তিশালী দেশ হিসাবে এজন্য চীনকে সহজে কোনও দেশ তার ভূখন্ডে আসতে দিতে চায়না। সেই তুলনায় ভারত সফট পাওয়ার হিসাবে পরিচিত বিশ্ব রাজনীতিতে। দক্ষিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে আদি অধিবাসী তেমন নেই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমা দেশগুলো এসব দ্বীপে বসতি স্থাপন করিয়েছে। সেজন্য এখানকার জনসংখ্যায় সমস্ত দেশের মানুষদের সংমিশ্রন লক্ষ্য করা যায়। যেমন ফিজিতে ৪০ শতাংশ ভারতীয় রয়েছে। এজন্য ভারতের এখানে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন অনেক বেশী সহজ হয়ে গেছে। তাছাড়া এসব দেশগুলোর কাছে বিপুল সামুদ্রিক সম্পদ থাকলেও তা ব্যবহার করার মতোন ক্ষমতা নেই এই দেশগুলোর, এজন্য ভারত এসব দেশকে সহায়তা করছে। বিশ্বে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন যার কারনে বিশ্ব উষ্ণয়নের মতোন সমস্যা দেখা দিয়েছে এবং সমুদ্রের জলস্তরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এজন্য বিশ্বের উন্নত সবদেশই বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে কার্বন নির্গমন শূন্য করার লক্ষ্যে কাজ করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে এই প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশগুলোর উপর। কারন সমুদ্রে জলস্তর বৃদ্ধি পেলে এই দেশগুলো ডুবে যাবে। সুতরাং এরকম পরিস্থিতিতে ভারতই এসব দেশগুলোকে সহায়তা করতে পারে। এই জন্য দক্ষিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর কাছে ভারতও গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *