ফিচার আর্টিকেল

ভারতীয় সেনাবাহিনীর কিংবদন্তি স্যাম মানেকশ

সামরিক শক্তির বিচারে ভারত বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী দেশ। ভারতীয় তিন বাহিনীর প্রত্যেকটি সদস্য সর্বদা দেশের প্রয়োজনে নিজেদের জীবন বলিদান দিতেও প্রস্তত। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই সুনাম একদিনে হয়নি, কালের নিয়মে বিভিন্ন যুদ্ধে রীতিমতো পরীক্ষা দিতে হয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে। চীনের সাথে যুদ্ধই হোক কিংবা পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধই, সর্বক্ষেত্রেই ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে। ইতিহাসের পাতায় স্বর্নাক্ষরে লেখা আছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জীবনের বিনিময়ে অসাধারন বীরত্বের কথা। ভারত মায়ের অসংখ্য বীর সন্তানের মধ্যে এমন একজন বীর সন্তান ছিল সবসময় শত্রুর থেকে এককদম এগিয়ে থাকত। ভারতের সামরিক বাহিনীর ইতিহাসে তিনজন সদস্যকে এখনও পর্যন্ত ফিল্ড মার্শালের সম্মান দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় বায়ুসেনার অর্জুন সিং, ভারতীয় সেনাবাহিনীর কেএম কারিয়াপ্পা এবং স্যাম মানেকশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে একাধিক যুদ্ধে নিজের তীব্র বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন স্যাম মানেকশ। ভারতীয় সেনার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র তিনি, বলা হয় শত্রুর অবস্থান ও অস্ত্র দেখে তিনি দক্ষ রননীতি তৈরি করতেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কিংবদন্তি স্যাম মানেকশ সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

স্যাম হরমুসজি ফার্মজি জামসেদজি মানেকশর জন্ম ১৯১৪ সালের ৩ এপ্রিল, অমৃতসরে হয়েছিল। ওনার পিতা হরমিজড মানেকশ একজন বিখ্যাত ডাক্তার ছিলেন যাকে অমৃতসরের সবাই সম্মান করতেন। খুবই অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে ছিলেন স্যাম মানেকশ যাকে স্যাম বাহাদুরও বলা হত ভালোবেসে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে। ছোটবেলা থেকে বাবাকে দেখে ওনার ইচ্ছে হয়েছিল ডাক্তার হবার এবং ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করবার কিন্তু বড় হবার সাথে সাথে ওনার মধ্যে সেনাবাহিনীতে যোগ দানের ইচ্ছে জেগে ওঠে যার জন্য দেরাদুনের ইন্ডিয়ান মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে যোগদান করেন তিনি। দেরাদুনের অ্যাকাডেমিতে ওনার দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয় মহম্মদ মুসা খান যে পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান হয় এবং স্মিথ হ্যান যে পরে মায়ানমার সেনাবাহিনীর উচ্চপদে যায়।

১৯৩৪ সালের ডিসেম্বরে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে কমিশনড অফিসার হন তিনি। কুড়ি বছর বয়স থেকে শুরু হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ফিল্ড মার্শাল হবার যাত্রা। ১৯৩৭ সালে ওনার পোস্টিং হয় লাহোরে। সেখানেই একদিন রাতে এক অনুষ্ঠানে ওনার পরিচয় হয় শীলু নামে এক অসাধারন সুন্দরী রমনির সাথে, ধীরে ধীরে উভয়ের মধ্যে প্রনয় গাঢ় হয় এবং ১৯৩৯ সালে দুজনেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। এর কিছুদিন পরেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং স্যাম মানেকশকে বার্মা পাঠানো হয়। সেখানে সিতং ব্রিজ নামক জায়গায় ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং জাপনিজ সেনাবাহিনীর মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ক্যাপ্টেন স্যাম মানেকশ ছিল সেই ব্রিটিশ ভারতীয় দলের প্রধান। তাঁর অসাধারন রণনীতির কারনে প্রবল যুদ্ধের পরেও জাপানীরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে সরাসরি হাতাহাতিতে বেশ কিছু জাপানি সেনাকে খতম করেন স্যাম মানেকশ, এর জন্য তার শরীরে নয়টি বুলেট পর্যন্ত লাগে। রক্তাক্ত অবস্থায় ৩৬ ঘন্টা পর রেঙ্গুনের এক হসপিটালে ওনার অস্ত্রোপচার করা হয়, সবাই ভেবেছিল তিনি মারা যাবেন কিন্তু ভগবানের বোধ হয় অন্যরকম ইচ্ছে ছিল। তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং বেশ কিছুদিন সেনা প্রশিক্ষনের কাজ করেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চরমে পৌঁছালে আবারও তাঁর ডাক পড়ে। ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের নেতৃত্ব গ্রহন করে বার্মাতে জাপানিজদের সাথে ভয়ানক যুদ্ধ করেন তিনি এবং দশহাজার জাপানি সেনা আত্মসমর্পন করে বাধ্য হয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ওনার পোস্টিং হয় দিল্লীতে। অসাধারন বীরত্বের কারনে ওনাকে স্যাম বাহাদুর উপাধি দেওয়া হয় এবং মার্শাল পদ দেওয়া হয়। দিল্লিতে তার সহকর্মী ছিল অফিসার ইয়াহিয়া খান যে পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ফিল্ড মার্শাল ও প্রসিডেন্ট হয়। এরপর ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হয়। তখন অখন্ড ভারতীয় সেনাবাহিনীর অনেক সদস্যই পাকিস্তান চলে যায় কিন্তু মেজর স্যাম মানেকশ ভারতেই থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।

১৯৪৮ সালে তাঁর পদন্নোতি হয় এবং ৮ গোর্খা রাইফেলের কর্নেল হন তিনি। এই বছরই কাশ্মীরকে নিয়ে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ হয়, যাতে স্যাম মানেকশের অসাধারন বীরত্বে পাকিস্তান ধরাশায়ী হয়। যার জন্য ওনাকে সম্মান দিয়ে তামিলনাড়ুর ডিফেন্স সার্ভিস স্টাফের প্রধান নিযুক্ত করা হয়। এরপর ১৯৬২ সালে চীন সেনা অবৈধভাবে ম্যাকমোহন লাইন অতিক্রম করে ভারত আক্রমন করার হুমকী দেয় কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ভি কে মেনন চীন সরকারের যুদ্ধবিরতির উপর পূর্ণ ভরসা ছিল কিন্তু স্যাম মানেকশ চুপ করে বসে থাকার লোক ছিলেন না। তিনি ভিকে মেননকে সম্ভাব্য চাইনিজ আক্রমনের কথা জানান কিন্তু ভিকে মেনন সে কথায় পাত্তা না দিয়ে চীনের উপর ভরসা করে বসে। ফলে ১৯৬২ এর অক্টোবরে চীন আক্রমন করে ভারত। সঠিক পরিকল্পনা না থাকা অবস্থায়ও অল্প ভারতীয় সেনা তখন বীরত্বের সাথে লড়াই করেছিল। এই ঘটনার পর বাধ্য হয়ে ভিকে মেনন ইস্তফা দেয় এবং জওহরলাল নেহেরু স্যাম ম্যাকেনশকে দায়িত্ব দেয় ভারতীয় সেনার। তাঁর নেতৃত্বে উত্তর পূর্বের ভারতীয় সেনা অসাধারন যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু মিজোরামের একটি ব্যাটেলিয়ন যুদ্ধ করতে অস্বীকার করেছিল প্রথমে, যার কারনে স্যাম মানেকশ একটি চিঠি ও চুড়ি পাঠায় ব্যাটেলিয়নের প্রধানকে এবং বলে সবাইকে চুড়ি পড়ে বসে থাকতে। এরপরই সেই ব্যাটেলিয়ন যুদ্ধে অংশ নেয় এবং বীরত্বের পরিচয় দেয়। যুদ্ধের পর স্যাম মানেকশ আবার একটি চিঠি লেখেন সেই ব্যাটেলিয়ন প্রধানকে এবং বলেন চুড়ি ফেরত দিতে।

১৯৬৯ সালের ৭ জুন জেনারেল কুমার মঙ্গলামের অবসরের পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর নতুন সেনাধ্যক্ষ হন জেনারেল স্যাম মানেকশ। ১৯৭০ সাল আসতে আসতে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনা পূর্ব পাকিস্তানের উপর অত্যাচার করতে শুরু করে। লাখ লাখ বাঙ্গালী ভারতে আসতে শুরু করে। এরকম অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত সাড়ে দশটায় দিল্লিতে একটি বৈঠক করেন। যাতে স্যাম মানেকশ সহ ভারতীয় বায়ুসেনা, নৌবাহিনীর প্রধান ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী উপস্থিত ছিল। ইন্দিরা গান্ধী সরাসরি প্রস্তাব দেন পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করার। কিন্তু স্যাম মানেকশ স্পষ্ট মানা করে দেন, তিনি বলেন পাকিস্তানের সাথে সরাসরি যুদ্ধ করতে গেলে চীন সুযোগ বুঝে ভারত আক্রমন করতে পারে। তাছাড়া বর্ষাকালে বাংলাদেশে বন্যা হয় যার জন্য ট্যাঙ্ক নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। সেই জন্য স্যাম মানেকশ প্রস্তাব দেন যুদ্ধ কিছু সময় পর হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের পাকিস্তান বিরোধীদের সশস্ত্র প্রশিক্ষন দেওয়া হবে। ইন্দিরা গান্ধী এই প্রস্তাব মেনে নেয় এবং এর দায়িত্ব দেওয়া হয় র এর প্রধান আর এন কাওকে।

ভারত পূর্ব পাকিস্তানে যাদের প্রশিক্ষন দিত তাদের মুক্তিবাহিনী বলা হয় এবং সেইসময় পূর্ব পাকিস্তানের বদলে বাংলাদেশ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেইবছর নভেম্বরে স্যাম মানেকশ ইন্দিরা গান্ধীকে জানায় ভারত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত এবং ৪ ডিসেম্বর যুদ্ধের দিন নির্নয় করা হয়। ভারতীয় বায়ুসেনা ও নৌসেনা পাকিস্তানকে ঘিরে ফেলে পুরো এবং প্রায় অর্ধেক ভারতীয় সেনা বাংলাদেশে চলে যায়।

আমেরিকা, চীন ও আরব দেশগুলো থেকে সাহায্য পাওয়া সত্বেও প্রায় ৯০,০০০ পাকিস্তানি সেনা সহ জেনারেল নিয়াজী ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারতের কাছে আত্মসমর্পন করে যা বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কোন আত্মসমর্পন। জেনারেল স্যাম মানেকশ শুধু পাকিস্তানকে পরাজয়ই করেনি বরং পাকিস্তানকে দুই টুকরো করে দিয়েছিল।

১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতি ভিভিগিরি দ্বারা পদ্মবিভূষন সম্মান পান তিনি। ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি ফিল্ড মার্শাল সম্মান পান তিনি। অবশেষে সেই বছরই ১৫ জানুয়ারি তিনি অবসরে যান। এরপর তামিলনাড়ুর কুন্নুড়ে তিনি চলে যান। পরবর্তী জীবনে তিনি বেশ কয়কটি বেসরকারি সংস্থার সফল চেয়ারম্যান পদ সামলেছেন। জীবনের চল্লিশ বছর ভারতীয় সেনাবাহিনীর হয়ে নিষ্ঠা ভাবে কাজ করার পর পরবর্তী জীবনেও সফল পারিবারিক জীবন অতিবাহিত করেছেন তিনি। ২০০৪ সালে ওনার স্ত্রীর মৃত্যু হয়। ২০০৮ সালের জুন মাসের শুরু থেকেই ওনার শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। ওনাকে তামিলনাড়ুর ওয়েলিংটন হসপিটালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু ২৭ জুন ভারত মায়ের এই বীর সন্তান চিরনিদ্রায় শায়িত হয়ে যান। উটিতে ওনার স্ত্রীর কবরের পাশেই ওনাকেও শোয়ানো হয়। ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশের নাম প্রত্যেক ভারতীয়র মনের মনিকোঠায় অমর হয়ে থাকবে। প্রত্যেক ভারতীয় সেনার নায়ক তিনি।

 ভালো থাকবেন স্যার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *