২১ বার পৃথিবীকে ক্ষত্রিয় মুক্ত করেছিলেন। কতোটা শক্তিধর ভগবান পরশুরাম?
ভগবত গীতার চতুর্থ অধ্যায় জ্ঞানযোগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন:—
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানম অধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্॥
পরিত্রাণায় হি সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাম।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে॥
অর্থাৎ যখনই ধর্মের গ্লানি হয় এবং অর্ধমের বৃদ্ধি হয়, তখনই সাধুদের উদ্ধার করতে এবং অধর্মীদের শাস্তি দিয়ে পুনরায় ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে তিনি অবতীর্ন হন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে হিন্দুধর্মের ত্রিদেবের একজন ভগবান বিষ্ণুর অবতার অষ্টম অবতার বলা হয়। শ্রীকৃষ্ণ অবতারে তিনি যে গীতার জ্ঞান দিয়েছিলেন তা সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি চার যুগের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সোজা ভাষায় যখনই পৃথিবীতে অধর্ম বৃদ্ধি পেয়েছে তখনই ভগবান বিষ্ণু কোনও না কোনও রূপে অবতীর্ন হয়েছেন। ভগবান বিষ্ণুর অনেক অবতার রয়েছে তার মধ্যে মূল দশ অবতারকে বলা হয়। এই দশ অবতারের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভগবান পরশুরাম। ইনি ভগবান বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার। ভগবান পরশুরাম ভগবান শ্রী বিষ্ণুর এমনই এক অবতার যিনি বিভিন্ন কালে ভগবান শ্রী বিষ্ণুর অন্য অবতারের সাথেও সমান ভাবে রয়েছেন। রামায়ন, মহাভারতেও ভগবান পরশুরামের উল্লেখ পাওয়া যায়। দ্রোনাচার্য, পিতামহ ভীষ্ম, অঙ্গরাজ কর্নের গুরু ছিলেন পরশুরাম। ভগবান পরশুরাম চিরঞ্জীবি যিনি কলিযুগের শেষ পর্যন্ত থাকবেন এবং ভগবান বিষ্ণুর দশম অবতার কল্কি ভগবানেরও গুরু হবেন তিনি।
ভগবান পরশুরামের সম্পর্কে বলা হয় তিনি ২১ বার গোটা পৃথিবীকে ক্ষত্রিয় শূন্য করেছিলেন। আসলে অধর্মী ও পাপী রাজাদের শাস্তি দিয়েছিলেন তিনি। ঋষি ভৃগুর পুত্র ছিলেন ঋচিক এবং ওনার স্ত্রী সত্যবতী। পুত্র সন্তান লাভের জন্য ঋষি ঋচিক তাঁর স্ত্রী সত্যবতীকে দুটি বিশেষ ফল দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন অশ্বত্থ গাছকে আলিঙ্গন করে এই ফল খেতে। কিন্তু সত্যবতী ভুল গাছকে আলিঙ্গন করে এই ফল খান। যার ফলে ঋষি ঋচিক রেগে গিয়ে সত্যবতিকে বলেন তার পুত্র ব্রাহ্মন ঘরে জন্মালেও কর্মের দিক দিয়ে ক্ষত্রিয় হবে। সত্যবতির অনেক প্রার্থনায় ঋষি ঋচিক জানান তার বলা কথা অবশ্যই সত্য হবে, তবে সত্যবতির ছেলের ছেলে কর্মে ক্ষত্রিয় হবে কিন্তু জন্ম হবে ব্রাহ্মনকুলে। বিভিন্ন হিন্দু শাস্ত্রে রয়েছে ঋষি, মুনিদের কোন কথা একবার উচ্চারিত হলে তা অবশ্যই ফলপ্রসূ হবেই, তা আটকানো সম্ভব নয়। তবে ঋষি, মুনিরা দয়া করে প্রভাব কিছুটা কমিয়ে দেন। সত্যাবতির পুত্র হচ্ছে ঋষি জামাদাগ্নি। হিন্দু ধর্মের উচ্চতম সাধক সপ্তর্ষিদের মধ্যে একজন হচ্ছে এই ঋষি জামাদাগ্নি, ওনার স্ত্রী হচ্ছেন রেনুকা। এই ঋষি জামাদাগ্নি ও রেনুকার পুত্র হচ্ছে ভগবান বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার ভগবান শ্রী পরশুরাম। দেবরাজ ইন্দ্রের আশীর্বাদে জন্ম হয়েছিল ওনার। রেনুকা দেবীকে দক্ষিন ভারতীয় রাজ্য গুলোতে কর্নাটক, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা, কেরালা, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং মহারাষ্ট্রে ইলাম্মা রূপে পূজো করা হয়। পরশুরাম নামটিতে পরশু শব্দের অর্থ কুঠার। ভগবান শ্রী পরশুরাম দেবাদিদেব মহাদেবের তপস্যা করেছিলেন এবং ভগবান শিব সন্তষ্ট হয়ে ওনাকে বিশেষ কুঠার দিয়েছিলেন। ভগবান শ্রী পরশুরাম ভার্গবা, ভৃগুপতি, জামাদগ্না, রামভদ্রা নামেও পরিচিত। এই সময়েরই একজন শক্তিশালী রাজা হচ্ছে শ্রী কার্তাভিরিয়া অর্জুন যিনি সহস্রবাহু অর্জুন নামেও বিখ্যাত কারন তার একহাজার হাত ছিল। ভগবান শ্রী বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রের অবতার বলা হয় তাকে।
হিন্দু পুরান অনুযায়ী তিনি পৃথিবীর সাত মহাদেশ সহ গোটা পৃথিবী বিজয় করেছিলেন। তিনি ভগবান দত্তাত্রেয়র উপাসনা করতেন। ধনুর্বিদ্যায় পারদর্শী শ্রী কার্তাভিরিয়া অর্জুন রাবনকেও পরাস্ত করেছিলেন। বলা হয় তিনি ৮৫,০০০ বছর রাজত্ব করেছিলেন, তাঁর রাজধানীর নাম ছিল মাহিশমতি, যা অধুনা মধ্যপ্রদেশের নর্মদা নদীর তীরে অবস্থিত। একদিন শ্রী কার্তাভিরিয়া অর্জুন বরুন দেবকে জানান তিনি সবথেকে শক্তিশালী, তিনি দেবরাজ ইন্দ্রকেও পরাস্ত করতে সক্ষম, তার থেকে শক্তিশালী কে আছে? বরুন দেব জানান ঋষি জামাদাগ্নির পুত্র ভগবান শ্রী পরশুরাম সবচেয়ে শক্তিশালী। এই কথা শুনে শ্রী কার্তাভিরিয়া অর্জুন তার সেনা নিয়ে ঋষি জামাদাগ্নির আশ্রমে উপস্থিত হন। সেসময় শ্রী পরশুরামজী আশ্রমে ছিলেননা। ঋষি জামাদাগ্নির কাছে কামধেনু ছিল যা দিয়ে সকলের ভরনপোষন করেন তিনি। এটা দেখে শ্রী কার্তাভিরিয়া অর্জুন জোর করে কামধেনু তার রাজধানীতে নিয়ে আসেন৷ এই ঘটনা শুনে ভগবান শ্রী পরশুরাম জী স্বয়ং মাহিশমতি উপস্থিত হন, তিনি শ্রী কার্তাভিরিয়া অর্জুনের সতেরো অক্ষৌহিণী সেনার সাথে যুদ্ধ করেন এবং শেষে শ্রী কার্তাভিরিয়া অর্জুনকে হত্যা করে কামধেনু ফেরত নিয়ে আসেন। ভগবান শ্রী পরশুরাম একা সতেরো অক্ষৌহিণী সেনা ও বিশ্বজয়ী শ্রী কার্তাভিরিয়া অর্জুনের সাথে একা যুদ্ধ করে সবাইকে পরাস্ত করেন!! এই ঘটনার পর শ্রী কার্তাভিরিয়া অর্জুনের পুত্ররা পিতার হত্যার প্রতিশোধ নিতে ঋষি জামাদাগ্নিকে হত্যা করে। শ্রী কার্তাভিরিয়া অর্জুনের তিন পুত্র ঋষি জামাদাগ্নির শরীরে একুশ বার আঘাত করে এবং তার মাথা কেটে ফেলে। ঋষি জামাদাগ্নি যখন ধ্যানস্থ ছিলেন তখন তাকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার পর ভগবান শ্রী পরশুরাম শ্রী কার্তাভিরিয়া অর্জুনের তিন পুত্রকে হত্যা করেন এবং প্রতিজ্ঞা করেন একুশবার পৃথিবীকে ক্ষত্রিয় শূন্য করবেন। শ্রী পরশুরাম ভগবান এরপর একুশবার পৃথিবীকে ক্ষত্রিয় শূন্য করেন, এসব রাজাদের মধ্যে সেসময় পাপ এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে রাজ কর্তব্য ভুলে গিয়েছিল তারা। ভগবান শ্রী পরশুরামজীকে শান্ত করার জন্য রাজারা হনুমানজীকে অনুরোধ করেন। এরপর হনুমানজী পরশুরামজীকে বলেন শান্ত হতে কিন্তু শ্রী পরশুরামজী হনুমানজীর মধ্যে ছোটখাটো যুদ্ধ বেঁধে যায়। কিছুক্ষন পরই হনুমানজী বুঝতে পারেন পরশুরামজীকে হারানো অসম্ভব, তখন তিনি ভগবান শিবকে স্মরন করেন। সেই মহূর্তেই মহাদেব প্রকট হয়ে সেখানে দুজনকে শান্ত করেন৷ এরপর থেকেই পরশুরামজী আর কোনওদিন কাউকে বধ করেননি। তারপর থেকে তিনি গুরুর ভূমিকা গ্রহন করেন।
মহাভারতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পর সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল পিতামহ ভীষ্ম, ওনারও গুরুদেব ছিলেন শ্রী পরশুরামজী। পরশুরামজী ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মন যুবকদের প্রশিক্ষন দিতেন। অঙ্গরাজ কর্ন সূর্যপুত্র হলেও তাঁর লালনপালন ক্ষত্রিয় পরিবারে হয়নি। কর্ন সেজন্য তার পরিচয় লুকিয়ে পরশুরামজীর কাছে শিক্ষা নেন। পরে পরশুরামজী সব বুঝতে পেরে কর্নকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে যখন সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন হবে তখনই তার সমস্ত বিদ্যা বিস্মরন হয়ে যাবে৷ বাস্তবে তাই হয় মহাভারতের যুদ্ধে অর্জুন ও কর্নের সাক্ষাৎ কালে কর্নের সমস্ত বিদ্যা বিস্মরন হয়ে গিয়েছিল। রামায়ন কালে যখন প্রভু শ্রীরাম মাতা সীতার স্বয়ংবর সভায় ভগবান শিবের দেওয়া ধনুক ভেঙে দিয়েছিলেন তখন শ্রী পরশুরামজী সেখানে উপস্থিত হন এবং অত্যন্ত ক্রোধী হয়েছিলেন কারন তিনি ছিলেন ভগবান শিবের উপাসক। ঋষি দুর্বাসার মতোন ভগবান শ্রী পরশুরামজীও ছিলেন অত্যন্ত ক্রোধী স্বভাবের। ভগবান শ্রী পরশুরামজী সম্পর্কে আরও একটি কথা আছে যে তিনি তাঁর মাকেও হত্যা করেছিলেন। তবে এসম্পর্কে পুরো ঘটনাটা অনেকেই জানেননা। একবার শ্রী পরশুরামজীর মা রেনুকা দেবী জল আনতে সরোবরে যান, সেখানে তখন এক রাজকুমার স্নান করছিলেন, যার জন্য রেনুকা দেবীর জল আনতে দেরী হয় একটু। এই ঘটনা ধ্যানযোগে জানতে পারেন ঋষি জামাদাগ্নি। ঋষি জামাদাগ্নি ও রেনুকা দেবীর পাঁচ পুত্র ছিল। ঋষি জামাদাগ্নি একে একে চার পুত্রকে আদেশ দেন রেনুকা দেবীকে হত্যা করতে কিন্তু কোনও পুত্রই আদেশ মানেনা। তখন ঋষি জামাদাগ্নি শ্রী পরশুরামজীকে আদেশ দেন তার চার দাদা সহ, মাকে হত্যা করতে। কারন তার ছেলেরা তার আদেশ অমান্য করেছিল। ভগবান শ্রী পরশুরামজী একে একে চার দাদা সহ মাকে হত্যা করেন। এরপর ঋষি জামাদাগ্নি প্রসন্ন হয়ে শ্রী পরশুরামজীকে বর চাইতে বলে। তখন শ্রী পরশুরামজী তার মা সহ চার দাদর পুনর্জীবনের বর চান। ঋষি জামাদাগ্নি তপবলে তার স্ত্রী ও চার পুত্রকে জীবিত করেন।