ফিচার আর্টিকেল

ইহুদী মেয়েদের রক্ষা করতে কি পদক্ষেপ নিয়েছিল ইসরায়েলের গোয়েন্দারা?

১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের কোন এক দুর্যোগময় রাতে ভূমধ্যসাগরের উত্তাল জলরাশি চিড়ে এগিয়ে চলেছে ইসরায়েল নৌবাহিনীর এক জাহাজ যার গন্তব্য সিরিয়া। সেইদিন সন্ধ্যাবেলাতেই জাহাজটি ইসরায়েলের হাইফায় নৌবাহিনীর বেস থেকে লেবানন উপকূল হয়ে সিরিয়া অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছিল। তুরস্কের সীমানার কাছে সিরিয়ার লাটাকিয়া বন্দরের উত্তর প্রান্তে বন্দর থেকে কিছুটা দূরে জাহাজটা থেমে যায়। ইসরায়েলের নেভাল কম্যান্ডোরা জাহাজ থেকে একটি রবার বোট নীচে নামায়। কিছুক্ষন পর জাহাজ থেকে তিনজন ব্যাক্তি সাধারন পোষাকে পিঠে বিশেষ ব্যাগ নিয়ে সেই বোটে চেপে বসে। তাদের ব্যাগে ছিল নকল পাসপোর্ট, যোগাযোগের জন্য বিশেষ মাধ্যম, বন্দুক ও বিশেষ কিছু জিনিস। ইসরায়েল নেভাল কম্যান্ডোদের এই তিনজন লোকের পরিচয়, মিশন সম্পর্কে কিছু জানানো হয়নি। শুধু বলা হয়েছিল তাদের সিরিয়া উপকূলের কাছে পৌঁছে দিতে। এতক্ষন ইসরায়েল নৌবাহিনীর জাহজে যে কম্যান্ডোরা এই তিনজনকে সিরিয়া উপকূলে নিয়ে এল তারা ইসরায়েল নৌবাহিনীর শায়েতত ১৩ বাহিনীর সদস্য। শায়েতত ১৩ ইসরায়েল নৌবাহিনীর সমুদ্র থেকে ভূৃমিতে মিশনের জন্য বিশেষ দক্ষ বাহিনী। রবার বোটে করে সেই তিনজন ব্যাক্তি সিরিয়া উপকূলে পৌঁছায়। সেখানে আগে থেকেই তাদের জন্য এক ব্যাক্তি অপেক্ষা করছিল যার নাম জোনাথন কিন্তু এই ব্যাক্তিটির সংকেতিক নাম হচ্ছে প্রসপার। উপকূলে পৌঁছেই ওই তিন ব্যাক্তি পোষাক পরিবর্তন করে নেয় এবং আগে থেকেই নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি গাড়িতে চেপে বসে তারা। গাড়ি সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কাসে প্রবেশ করে। সেখানে গিয়ে তারা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে গিয়ে আলাদা আলাদা দুটি হোটেলে ওঠে। পরের দিন সকালে সবাই একটি নির্দিষ্ট জায়গায় মিলিত হয়। মোট পাঁচজন ব্যাক্তিকে সিরিয়া পাঠিয়েছিল ইসরায়েলের ইনটেলিজেন্স সংস্থা মোসাদ একটি বিশেষ মিশনে। এই পাঁচজনই ইতিপূর্বে শায়েতত ১৩ এর সদস্য ছিল। সিরিয়ায় একটি খুবই গোপন ও গুরুত্বপূর্ন অপারেশনের পরিকল্পনা করেছিল মোসাদ।

হঠাৎ করে সিরিয়ায় মোসাদের এই অপারেশনের প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছিল এই ঘটনার প্রায় দুইবছর আগে। ১৯৭০ সালে সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি হয় হাফিজ আল আসাদ। সেই সময় থেকেই সিরিয়ায় থাকা ইহুদিদের উপর অত্যাচারের পরিমান বেড়ে যায়। যার কারনে বহু ইহুদি ইসরায়েল পালিয়ে আসে। কিন্তু বেশ কিছু ইহুদি মেয়ে তখনও সিরিয়াতেই থেকে যায়, এদের মধ্যে কয়েকজন লেবানন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। সেখানের মোসাদ এজেন্টরা তাদের নিরাপদ আশ্রয় দেয়। ১৯৭০ সালেই ইসরায়েলের একটি মিসাইল বোট লেবাননে উত্তর বেইরুট শহরের একটি উপকূলে এসে পৌঁছায়। সেখানে একজন মোসাদ এজেন্ট বারো জন ইসরায়েল মেয়েকে ইসরায়েলের জাহাজে পৌঁছে দেয়। সেই জাহজের ক্যাপ্টেন ছিল কর্নেল আব্রাহাম। তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ইসরায়েলি মেয়েদেরকে নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে। সেই মতো কর্নেল আব্রাহাম লেবানন থেকে সেই মেয়েদের নিয়ে হাইফা অভিমুখে রওনা দেয়। পরেরদিন হাইফা পৌঁছেই কর্নেল আব্রাহাম দেখতে পান আগে থেকেই বন্দরে উপস্থিত রয়েছেন ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার এবং উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা। সেই বারোজন মেয়েকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার অভিবাদন জানান এবং তাদের সম্মানে একটি বড় সভার আয়োজন করেন। সেখানে সেই মেয়েগুলো সিরিয়ায় ইহুদি মেয়েদের উপর হওয়া অত্যাচারের কথা বলে, যা শুনে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীরও চোখে জল চলে আসে। সেই সভাতেই প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার সিদ্ধান্ত নেন তার দেশের মেয়েদের দেশে ফিরিয়ে আনবেই সিরিয়া থেকে। এই অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয় মোসাদকে। সিরিয়া থেকে ইসরায়েলি মেয়েদের সুরক্ষিত ভাবে নিয়ে আসার পরিকল্পনা শুরু হয় ইসরায়েলের রাজধানী তেল আভিবে মোসাদের হেড কোয়ার্টারে। মোসাদ শায়েতত ১৩ বিশেষ বাহিনী থেকে চারজন সদস্যকে এই মিশনের জন্য নির্বাচন করে, এদের বিশেষ প্রশিক্ষন দেওয়া হয় সিরিয়ায় গিয়ে মিশনের জন্য। এই চারজনের দলের নাম দেওয়া হয়েছিল কোসানোস্ত্রা। মোসাদের প্রধান এই কোসানোস্ত্রা দলের প্রত্যেক সদস্যকে সিরিয়াতে হওয়া ইহুদি মেয়েদের উপর নারকীয় অত্যাচারেরে কথা জানায়। সিরিয়ায় ইহুদী মেয়েদের উপর শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি তাদের ক্রীতদাসের মতোন বিক্রি পর্যন্ত করে দেওয়া হত। এই ধরনের পাশবিক অত্যাচারের কথা শুনে কোসানোস্ত্রার প্রত্যেক সদস্য জানায় তারা ইসরায়েলি মেয়েদের উদ্ধারের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। একটি গোপন মিশনের পরিকল্পনা করা হয় যার নাম দেওয়া হয় অপারেশন স্মিচা, হিব্রু ভাষায় এই শব্দের অর্থ হল ব্ল্যাঙ্কেট। অবশেষে নভেম্বর, ১৯৭১ সালে অপারেশন শুরু হয়।

প্রথমে মোসাদ এজেন্টদের সমুদ্রের মাধ্যমে সিরিয়া পাঠানো হয় এবং সেখান থেকে সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসে যায় তারা। দামাস্কাসে বেশ কিছুদিন ধরে মোসাদ এজেন্টরা সাধারন মানুষ সেজে ঘুরে বেড়াতে থাকে এবং সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করতে থাকে। সিরিয়ান ইনটেলিজেন্স সংস্থার নজর এড়াতে মোসাদ এজেন্টরা নিজেদের মধ্যে ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বলতে থাকে। মোসাদ দামাস্কাসে বেশ কিছু ইসরায়েলি মেয়েদের উদ্ধার করে এবং তাদের একটি ট্রাকে করে শহরের বাইরে একটি সমুদ্র তীরে নিয়ে যাবার পরিকল্পনা করে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সিরিয়ান হাইওয়েতে সিরিয়ান সেনা পাহাড়া দিচ্ছিল। তাই মোসাদ পরিকল্পনা করে যদি সিরিয়ান সেনা তাদের আটকায় তাহলে বলা হবে স্কুল থেকে শিক্ষা মূলক সফরের জন্য যাচ্ছে তারা। কারন উদ্ধার করা প্রত্যেক মেয়ের বয়স পনেরো থেকে ষোলো বছরের মধ্যে ছিল, একজন নাবালক ছেলেও ছিল তাদের মধ্যে। এদের শেষপর্যন্ত একটি সমুদ্রতীরে নিয়ে আসে মোসাদ এজেন্টরা এবং একটু দূরেই দাঁড়িয়ে থাকা ইসরায়েল নৌসেনার মিসাইল জাহাজকে সংকেত দেওয়া হয়। সাথেসাথে ইসরায়েল নৌসেনার শায়েতত ১৩ কম্যান্ডোরা রবার বোটে করে আসতে শুরু করে উপকূলের দিকে। হঠাৎই সেখানে উপস্থিত হয় সিরিয়ান পুলিশ এবং পিছন থেকে গুলি চালাতে শুরু করে রবার বোটের দিকে। ফলে বাধ্য হয়ে মোসাদ এজেন্টরা ট্রাক ঘুরিয়ে নিয়ে অন্য একটি নির্জন সমুদ্র তীরে আসে এবং সেখানে রবার বোটে করে মেয়েদের জাহাজে পাঠানো হয় এবং জাহাজ হাইফা চলে যায় তাদের নিয়ে। পরের দিনই মোসাদ তদন্ত শুরু করে সিরিয়ান পুলিশ কীভাবে খবর পেল সেটা নিয়ে। পরে জানা যায় পুলিশ সন্দেহ করছিলো মাদকের চোরাকারবার সম্পর্কে। মোসাদ নিশ্চিন্ত হয় কারন অপারেশন আরও বাকী ছিল। এরপর মোসাদ আবারও কোসানোস্ত্রা দলকে সিরিয়ায় পাঠায় তবে এবারে আর সমুদ্র পথে নয় বরং প্যারিস থেকে বিমানে দামাস্কাসে পৌঁছায় কোসানোস্ত্রা দল। এবারে তাদের পরিচয় হয় প্রত্নতাত্ত্বিক ছাত্র হিসাবে। বিমানবন্দর থেকে পৌঁছেই দলের প্রত্যেক সদস্য আলাদা হয়ে গিয়ে আলাদা আলাদা হোটেলে ওঠে। আগের মতোই বেশ কয়েকদিন ধরে অনুসন্ধান করে আবারও কিছু ইহুদি মেয়েকে উদ্ধার করে তারা। তবে এবারে আর সমুদ্রপথে তাদের ইসরায়েলে পাঠানো সম্ভব হয়না কারন দামাস্কাসের সমুদ্রতীর গুলো পাহাড়া দিচ্ছিল সিরিয়ান পুলিশ। মোসাদ লেবানন হয়ে মেয়েদের ইসরায়েল পাঠানোর পরিকল্পনা করে। এরজন্য মোসাদ এজেন্টরা ট্রাকে করে মেয়েদের নিয়ে লেবাননের বেইরুটে পৌঁছায়। সেখানে মোসাদ এজেন্টরা একটি ইয়ট ভাড়া নেয় সমুদ্রে ঘোরবার নাম করে। সেখানে মেয়েদেরকে নিয়ে তারা গভীর সমুদ্রে প্রবেশ করে। সেখানে নির্দিষ্ট জায়গায় থাকা ইসরায়েল নৌবাহিনীর জাহাজে মেয়েদের তুলে দেওয়া হয়। তারপর কোসানোস্ত্রা আবার দামাস্কাসে ফিরে যায় আরও মেয়েদের উদ্ধার করার জন্য। অবশেষে এপ্রিল, ১৯৭৩ সালে অপারেশন স্মিচা শেষ হয়। 

নভেম্বর, ১৯৭১ থেকে সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩ সাল অবধি মোসাদ সিরিয়াতে কুড়িটির বেশী অপারেশন করে যাতে ১২০ জন ইসরায়েলি মেয়েকে উদ্ধার করা হয়। মোসাদ এতটাই নিখুঁত অপারেশন করে যে সিরিয়ান ইনটেলিজেন্স সংস্থা জানতেও পারেনি। এই অপারেশন পরবর্তী ত্রিশ বছর অবধি গোপন রেখেছিল মোসাদ। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার নিজে কোসানোস্ত্রার সদস্যদের অভিবাদন জানিয়েছিলেন। যখনই শত্রু দমন করার কথা হোক কিংবা নিজের দেশের সুরক্ষার কথা হোক, ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের মতোন নিখুঁত অপারেশন পৃথিবীর খুব কম দেশের ইনটেলিজেন্স সংস্থাই করতে পারে। যার কারনে মোসাদকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ইনটেলিজেন্স সংস্থা বলা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *