১৯৭১ এর যুদ্ধে পাকিস্তান নৌবাহিনীর কোমর ভেঙে দিতে কি করেছিল ভারতবর্ষের গোয়েন্দারা?
সময়টা ১৯৭১ সালের, দক্ষিন এশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি উপ্তপ্ত। পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার ঘোষনা করেছে, এর বিরুদ্ধে পাকিস্তান তার সেনা মোতায়েন করেছে পূর্ব পাকিস্তানে এবং বাঙালিদের উপর অমানুষিক অত্যাচার শুরু করেছে। এরকম অবস্থায় ভারত এগিয়ে আসে বাংলাদেশ গঠনের সহায়তায়, যার ফলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ ছিল সময়ের অপেক্ষা মাত্র। সেসময় ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছিলেন বাবু জগজীবন রাম। একদিন তার সাথে বৈঠক করেন ভারতীয় নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল নন্দা। বৈঠকে অ্যাডমিরাল নন্দা জানান তার কাছে খবর আছে করাচি বন্দরের আশেপাশে পাকিস্তান মিসাইল মোতায়েন করে রেখেছে। তাদের কাছে সুস্পষ্ট কোনও তথ্য নেই। অ্যাডমিরাল নন্দা বাবু জগজীবন রামকে অনুরোধ করেন র কে এই ব্যাপারে জানাতে যাতে র তাদের আরও তথ্য দেয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বাবু জগজীবন রাম সম্পূর্ন ব্যাপারটা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে জানান। ইন্দিরা গান্ধী র এর প্রধান রামেশ্বর নাথ কাওকে জানান সাহায্যের জন্য।
রামেশ্বর নাথ কাওকে ইন্দিরা গান্ধীকে জানান তিনি তার চেষ্টা করবেন এই ব্যাপারে তথ্য জোগাড় করতে। রামেশ্বর নাথ কাও র এর অফিসে জরুরী বৈঠক করেন এস শঙ্করন আইয়ারের সাথে, যিনি সেসময় র এর ডেপুটি প্রধান ছিলেন। রামেশ্বর নাথ কাও করাচির ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব এস শঙ্করন আইয়ারের উপর দেয়। এস শঙ্করন আইয়ার মুম্বাইয়ে র এর এক আধিকারিককে বিশেষ বার্তা পাঠায়। এর কিছুদিন পর এস শঙ্করন আইয়ার, র এর ফটোগ্রাফি বিভাগের প্রধান মিঃ মূর্তি বিমানে মুম্বাইয়ে যান। সেখানে মেরিন ড্রাইভে র এর এক বিশেষ আস্তানায় এস শঙ্করন আইয়ার, মিঃ মূর্তি ও মুম্বাইয়ের র এর আধিকারিকের একটি বিশেষ বৈঠক হয় দুই দিন ধরে। ধরা যাক মুম্বাইয়ে র এর বিশেষ সেই আধিকারিকের নাম মিঃ এক্স। ওই বৈঠকে মিঃ এক্স জানান তার একজন পার্সি বন্ধু আছে যে ডাক্তার, সে একটি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান জাহাজে চাকরি করে। জাহাজটি মুম্বাই হয়ে কুয়েত যায় এবং যাত্রাপথে করাচি বন্দর হয়ে যায়। তার কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া যাবে। এস শঙ্করন আইয়ার নির্দেশ দেয় ওই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করার। মিঃ এক্স তার বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করে, তবে সেই ব্যাক্তি তার বন্ধুর সাথে সরাসরি র এর কথা বলেনি বরং জানায় দিল্লি থেকে ভারতীয় নৌবাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসার এসেছে তার সাথে দেখা করতে চায় দরকার আছে কিছু। ডাক্তার রাজি হয়ে যায় দেখা করতে।
পরেরদিন সকালে মুম্বাইয়ের মেরিন ড্রাইভের এক পাঁচতারা হোটেলে ডাক্তারের সাথে কথা হয় এস শঙ্করন আইয়ার, মিঃ এক্স এবং মিঃ মূর্তির। মিঃ এক্স তার বন্ধু ডাক্তারের সাথে এস শঙ্করন আইয়ারের পরিচয় করায় ভারতীয় নৌবাহিনীর অফিসার হিসাবে। এস শঙ্করন আইয়ার সরাসরি ডাক্তারকে জানায় করাচি বন্দরের ব্যাপারে তথ্য চাই তার। ডাক্তার জানায় তার তথ্য দিতে অসুবিধা নেই তবে এর বদলে চেন্নাইয়ে কাস্টমস বিভাগে তার কিছু ইলেকট্রনিক জিনিস আটকে গেছে সেগুলো ছাড়াতে হবে। এস শঙ্করন আইয়ার চেন্নাইয়ের কাস্টমস বিভাগের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে দেখেন ভাগ্যক্রমে সেখানে তারই ব্যাচের একজনের পোস্টিং রয়েছে। এস শঙ্করন আইয়ার সেই ব্যাক্তির সাথে যোগাযোগ করেন এবং র এর গোপন ফান্ড থেকে পয়সা দিয়ে সেইসব ইলেকট্রনিক জিনিসের ফাইন শোধ করে। এর পরের দিন সকালে এস শঙ্করন আইয়ার আবারও ডাক্তারের সাথে দেখা করে তাকে জানিয়ে দেয় তার কাজ হয়ে গেছে। এবার ডাক্তার জানায় করাচি বন্দর সম্পর্কে তথ্যের জন্য তার সাথে দুজন ফটোগ্রাফারকে জাহাজে পাঠাতে। র এর দুজন এজেন্টকে নির্বাচন করা হয় এই কাজের জন্য। তাদের দুটো নকল পাসপোর্ট তৈরি করা হয়, একজনের নাম দেওয়া হয় মিঃ রড এবং অন্যজনের নাম দেওয়া হয় মিঃ মরিয়ার্তি। তিনদিন পর নির্দিষ্ট জাহাজে চাপে মিঃ রড এবং মিঃ মরিয়ার্তি। জাহজে পৌঁছেই তারা প্রথম দেখা করে সেই ডাক্তারের সাথে। ডাক্তার আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিল। ডাক্তার তাদের জানায় যখনই জাহাজ করাচি বন্দরের কাছে পৌঁছাবে তখনই তারা যেন অসুস্থ হওয়ার ভান করে। তাহলে তাদেরকে সাথে সাথে জাহাজের নীচের তলায় চিকিৎসা কেন্দ্রে ভর্তি করে দেওয়া হবে।
জাহাজটি নীচে থাকা চিকিৎসা কেন্দ্রের ছোট ছোট জানলা থেকে করাচি বন্দরের চারপাশ খুব ভালো ভাবে লক্ষ্য করা যেত, তাই এই পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছিল। যথারীতি জাহাজ করাচি বন্দরে প্রবেশের সময়েই মিঃ রড ও মিঃ মরিয়ার্তি পরিকল্পনা মাফিক অসুস্থ হবার ভান করে, তাদের জাহাজের নীচের তলায় নিয়ে আসা হয়। ডাক্তার আগে থেকেই তাদের বিছানা গুলো জানলার পাশে এমনভাবে ব্যাবস্থা করে রেখেছিল যাতে জনলা দিয়ে খুব সহজেই বাইরের দৃশ্যের ছবি তোলা যায়। চিকিৎসা কেন্দ্র হওয়ায় কারও সন্দেহও হবেনা। সেবার জাহাজটি করাচি বন্দরের কাছে এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছিল যেখান থেকে বন্দরের পাশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মোতায়েন করা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যাবস্থা সম্পর্কে পুরো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। এরই মধ্যে পাকিস্তানের কাস্টমস বিভাগ থেকে এক অফিসার জাহজে এসে জাহাজের ক্যাপ্টেন, একজন কর্মী এবং জাহাজের ডাক্তারকে তার সাথে করাচি বন্দরে যেতে হবে সমস্ত যাত্রীদের পাসপোর্ট নিয়ে। করাচি বন্দরে কাস্টমস বিভাগ সমস্ত জাহাজের যাত্রীদের পাসপোর্ট পরীক্ষা করার পর জানায় দুজন যাত্রীর পাসপোর্ট কম আছে। এর জবাবে জাহাজের ক্যাপ্টেন জানায় দুজন যাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাদের জাহাজের চিকিৎসা কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়েছে সেইজন্য দুটো পাসপোর্ট কম আছে। তখন করাচির কাস্টমস বিভাগ জাহজের চিকিৎসা কেন্দ্রে গিয়ে ওই দুই যাত্রী অর্থাৎ মিঃ রড এবং মিঃ মরিয়ার্তির পাসপোর্ট পরীক্ষা করার নির্দেশ দেয়। এবার সমস্যা হয়ে যায় কারন মিঃ রড এবং মিঃ মরিয়ার্তির কাছে ফটোগ্রাফিক যন্ত্র আছে যদি পাকিস্তানের কাস্টমস বিভাগ পরীক্ষা করতে আসে তাহলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা আছে। এমন সময়ে উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় দেয় ডাক্তার, তিনি জানান ওই দুই ব্যাক্তির চিকেন পক্স হয়েছে যার কারনে তাদের চিকিৎসা কেন্দ্রে আলাদা রাখা হয়েছে। সে ওই দুই ব্যক্তির পাসপোর্ট নিয়ে এসেছে। সেসময় চিকিনপক্স ছিল একটি ছোঁয়াচে রোগ যার কারনে পাকিস্তানের কাস্টমস বিভাগ সেখানেই ডাক্তারের কাছ থেকে পাসপোর্ট পরীক্ষা করে ছেড়ে দেয়। এরপর জাহাজ বেশ কিছুদিন করাচি বন্দরে ছিল, যেখানে যতটা সম্ভব তথ্য জোগাড় করে ও ফটো তোলে র এর দুই এজেন্ট। এরপর জাহাজ করাচি থেকে কুয়েত রওনা দেয়। কুয়েত পৌঁছেই জাহাজ থেকে সোজা ভারতীয় দূতাবাসে পৌঁছায় মিঃ রড এবং মিঃ মরিয়ার্তি। সেখানে সেইসব ছবি জমা দেওয়া হয়। সেইসব ছবি একটি কুটনৈতিক খামে ভরে ভারতীয় দূতাবাস অফিসার দিল্লী রওনা দেয়। কুটনৈতিক খামে থাকা কোন জিনিসকে বিমানবন্দরে পরীক্ষা করা হয়না। মিঃ রড ও মিঃ মরিয়ার্তিও অন্য বিমান ধরে দিল্লি আসেন। ওইসব ছবি ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল নন্দাকে দেওয়া হয়। এই ফটোর উপর ভিত্তি করেই ভারতীয় নৌসেনা ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর রাতে অপারেশন ট্রাইডেন্ট শুরু করে। করাচি বন্দরে থাকা পাকিস্তান নৌবাহিনীর একটি ডেস্ট্রয়ার, একটি মাইনসুইপার এবং একটি কার্গো জাহাজকে ধ্বংস করে দেয় ভারতীয় নৌবাহিনী। ওই কার্গো জাহাজে গোলা বারুদ ও তেল ছিল।
পাকিস্তান নৌবাহিনীর আরও একটি ডেস্ট্রয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ভারতের পক্ষে কোন ক্ষতিই হয়নি। ভারত ৪ ডিসেম্বর এই উপলক্ষ্যে নৌদিবস পালন করে প্রতিবছর। এই অপারেশনে ভারত তিনটি বিদ্যুৎ ক্লাস মিসাইল বোট, দুটি অ্যান্টি সাবমেরিন আর্নালা ক্লাস করভেট ও একটি ট্যাঙ্কার ব্যবহার করেছিল ভারত। এরপরে পাকিস্তান নৌবাহিনী ভারতীয় নৌবাহিনীর দ্বারা এতটা ভীত হয়ে পড়ে যে তারা বানিজ্যিক জাহাজের ছদ্মবেশে নিজেদের যুদ্ধজাহাজকে আরব সাগরে পাঠানোর চেষ্টা করে কিন্তু ভারত বুঝতে পেরে যায় এবং অপারেশন ট্রাইডেন্টের চারদিনের মধ্যেই অপারেশন পাইথন শুরু করে ভারতীয় নৌবাহিনী। যাতে ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি মিসাইল বোট এবং দুটি ফ্রিগেট পাকিস্তানের জাহজের উপর আক্রমন করে। এতে পাকিস্তান নৌবাহিনীর পিএনএস ডেক্কা ট্যাঙ্কার এতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে এটা আর সারানো যায়নি এবং পাকিস্তানের কেমারি তেল কেন্দ্র ধ্বংস হয়ে যায়। অপারেশন ট্রাইডেন্ট ও অপারেশন পাইথনের জন্য পাকিস্তান নেভির কোমড় ভেঙে যায় যার কারনে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান নৌবাহিনী পৌঁছাতে পারেনি। ১৯৭১ এর ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের কথা হলেই অপারেশন ট্রাইডেন্ট ও অপারেশন পাইথনের কথা আসে কিন্তু এর পেছনে র এর যে অসাধারন অবদান ছিল করাচি বন্দরের সমস্ত তথ্য জোগাড় করায় তার জন্য কোন প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। ১৯৭১ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে ভারত জয়লাভ করে। এরপর একটা মজার ঘটনা ঘটে। যে পার্সি ডাক্তার অজান্তে র কে সাহায্য করেছিল সে দিল্লিতে ১৯৭২ সালে নৌবাহিনীর কেন্দ্রে গিয়ে উপস্থিত হয়। সে সেখানে কম্যান্ডার মেননের খোঁজ করে। আসলে মুম্বাইয়ের মেরিন ড্রাইভের পাঁচতারা হোটেলে এস শঙ্করন আইয়ার কম্যান্ডার মেননের পরিচয়ে ওই পার্সি ডাক্তারের সাথে দেখা করেছিল। নৌবাহিনীর কেন্দ্রে ডাক্তার খবর পায় কম্যান্ডার মেনন জাহাজে আছে। তাই ডাক্তার কম্যান্ডার মেননের বাড়ির ঠিকানায় গিয়ে উপস্থিত। কম্যান্ডার মেননের বাড়িতে পৌঁছে তার ছবি দেখে ডাক্তার হতবাক হয়ে যায় কারন ডাক্তারের দেখা কম্যান্ডার মেননের সাথে ছবির কম্যান্ডার মেননের কোন মিল নেই!!!!