অফবিট

ইসরায়েলের পরমানু ক্ষমতা অর্জন করতে মোসাদ যে দুর্ধর্ষ অভিযান করেছিল

১৯৬০ এর দশকের শেষের দিকে আরব দেশগুলোর সাথে একের পর এক যুদ্ধ সমস্যায় পড়ে যায় ইসরায়েল, কারন আমেরিকা ও ফ্রান্স ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এরকরম অবস্থায় ইসরায়েলের কাছে নিজেদের সুরক্ষার জন্য একটাই উপায় ছিল তাহল পরমানু অস্ত্র তৈরি। এরকম পরিস্থিতিতে ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে ইসরায়েলের বন্দরে এক জাহাজ আসে যাতে চার মিলিয়ন ডলার মূল্যের ইউরেনিয়াম ছিল। এই ইউরেনিয়াম মোসাদ অত্যন্ত গোপন অপারেশনের মাধ্যমে ইসরায়েলে এনেছিল যার উদ্দেশ্য ছিল পরমানু অস্ত্র তৈরি কিন্তু ইসরায়েলের এই অভিযানের কথা বহু বছর আমেরিকাও বুঝতে পারেনি। ইসরায়েল এই ইউরেনিয়াম ব্যবহার করে পরমানু শক্তি উৎপাদনের পাশপাশি নিজেদের সুরক্ষার জন্য পরমানু অস্ত্র নির্মানেরও পরিকল্পনা করেছিল। 

১৯৪৮ সালে ইসরায়েল তৈরি হওয়ার পর থেকে আরব দেশগুলো বারবার ইসরায়েল আক্রমন করা শুরু করে। যদিও প্রতিবার ইসরায়েল যুদ্ধে জয়লাভ করে কিন্তু স্থায়ী সমাধানের জন্য ইসরায়েলের পরমানু অস্ত্র প্রয়োজন ছিল। আয়তনে ছোট দেশ হওয়ায় ইসরায়েলের কাছে পর্যাপ্ত কৃষিজ জমিও ছিলনা, সেজন্য ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গ্যুরোন পরমানু শক্তি উৎপাদনের পরিকল্পনা করে যার মাধ্যমে কৃষিকাজ করা যাবে। 

১৯৫৩ সালে আমেরিকা অ্যাটমস ফর পিস নামে একটি কর্মসূচি শুরু করে যার মাধ্যমে আমেরিকা পরমানু শক্তির সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার জন্য বিভিন্ন দেশকে প্রযুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এই কর্মসূচিতে যুক্ত হওয়ার জন্য একটি শর্ত ছিল তাহল নিদিষ্ট দেশটিকে প্রথমে পরমানু অস্ত্র  তৈরি না করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হতে হবে। ইসরায়েল এটারই সুযোগ নেয় এবং চুক্তি করে আমেরিকার সাথে। কিন্তু ইসরায়েলের পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন, ইসরায়েল পরমানু অস্ত্র তৈরির জন্যই এই চুক্তি সাক্ষর করেছিল। ইসরায়েল নেগিভ মরুভূমি অঞ্চলে আমেরিকা সহায়তায় একটি ছোট পরমানু চুল্লি তৈরি করা হয় কিন্তু এই ছোট চুল্লির পেছনে ইসরায়েল গোপনে আরও একটি বড় পরমানু চুল্লি নির্মান শুরু করে। গোটা বিশ্ব জানত নেগিভ অঞ্চলে ইসরায়েল পরমানু বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করছে কিন্ত ডেভিড বেন গ্যুরোন গোটা বিশ্বকে লুকিয়ে অস্ত্র তৈরির জন্য বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপাদনের ব্যবস্থা তৈরি করে। কিন্ত অস্ত্র নির্মানের জন্য অতিরিক্ত ইউরেনিয়াম আমেরিকা ইসরায়েলকে সরবরাহ করেবেনা তা ইসরায়েল জানতো। সেজন্য ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সিমন পেরেস ফ্রান্স যান। সেসময় সুয়েজ খাল নিয়ে সমস্যা চলছিলো, ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে ফ্রান্সকে সহায়তা করার আশ্বাস দেয় এবং ফ্রান্স ইউরেনিয়াম সরবরাহ শুরু করে ইসরায়েলের কাছে। আমেরিকা এই ব্যাপার বুঝতে পেরে তাদের ইনটেলিজেন্স সংস্থা সিআইএকে দায়িত্ব দেয় ইসরায়েলের উপর নজর রাখতে। সিআইএ নেগিভ অঞ্চলের উপর দিয়ে ড্রোন ওড়ায় কিন্তু ইসরায়েলের পরমানু কার্যক্রম ভূমির নীচে চলায় সিআইএ বুঝতে পারেনি। 

১৯৬৭ সালে পুনরায় ইসরায়েল আরব যুদ্ধ শুরু হয় যার জন্য আমেরিকা ইসরায়েলকে অস্ত্র ও ইউরেনিয়াম সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। আমেরিকার দেখাদেখি ফ্রান্সও অস্ত্র ইউরেনিয়াম সরবরাহ বন্ধ করে দেয় ইসরায়েলকে যার জন্য সমস্যায় পড়ে যায় ইসরায়েল। আমেরিকার ইসরায়েলকে ইউরেনিয়াম সরবরাহ বন্ধ করার পেছনে আরও একটি কারন ছিল তাহল দুই বছর আগে অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে আমেরিকার অ্যাটমিক কমিশন খুঁজে পায় নিউম্যাক নামক একটি সংস্থার ২০০ পাউন্ড ইউরেনিয়াম উধাও হয়ে গেছে। ওই সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট স্যাপিরো ছিল একজন ইহুদি যার জন্য আমেরিকা ইসরায়েলকে সন্দেহ করে। 

২০০ পাউন্ড ইউরেনিয়াম দিয়ে অনেক পরমানু বোম্ব নির্মান সম্ভব যার জন্য সিআইএ, এফবিআই এর মতোন সংস্থাগুলি তদন্ত শুরু করে এবং স্যাপিরোর উপর নজর রাখা শুরু হয় কিন্তু স্যাপিরোকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, তদন্ত করেও ২০০ পাউন্ড ইউরেনিয়ামের ব্যাপারে কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। আমেরিকা ও ফ্রান্স ইউরেনিয়াম সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় ইসরায়েলের কাছে অবৈধ ভাবে ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিলনা, ইসরায়েল তার ইনটেলিজেন্স সংস্থা মোসাদকে এই বিষয়ে কাজে লাগায়। মোসাদের এজেন্টরা এক রাসায়নিক ব্যবসায়ী হার্বাট সুজ্যেনের সাথে যোগাযোগ করে যে আসমারাচেমি নামক সংস্থার মালিক ছিল। মোসাদ সুজ্যেনকে নির্দেশ দেয় ইউরোপীয়ান কোনও সংস্থার কাছ থেকে হলুদ কেক ইউরেনিয়াম কেনার। হলুদ কেক ইউরেনিয়ামে ৮০ শতাংশ ইউরেনিয়াম অক্সাইড থাকে। হলুদ কেক ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা অনেক কম। এই ধরনের ইউরেনিয়ামকে পরিশোধন করে অস্ত্র তৈরির উপযুক্ত করা হয়। যার জন্য হলুদ কেক ইউরেনিয়াম ইউরোপে খুব সহজেই পাওয়া যেত, বিভিন্ন শিল্প কারখানায় এই হলুদ কেক ইউরেনিয়াম ব্যবহার করা হয় যার জন্য এটা কেনায় বাধা ছিলনা। কিন্তু সমস্যা হল ইউরোপের বাইরে কোনও দেশ হলুদ কেক ইউরেনিয়াম কিনতে পারতোনা। এক্ষেত্রে সুজ্যেন মিলানে তার এক বন্ধুর সংস্থার মাধ্যমে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে অবস্থিত এসজিএম সংস্থা থেকে হলুদ কেক ইউরেনিয়াম কেনে। মোসাদ আগে থেকে একটি সুইজারল্যান্ডের ব্যাঙ্কে চার মিলিয়ন ডলার রেখেছিল এই চুক্তির জন্য। মোসাদ সুজ্যেনের বন্ধুকেও বারো হাজার ডলার দেয়। ইউরেনিয়াম কেনার পর সবচেয়ে বড় কাজ ছিল ব্রাসেলেস থেকে ইসরায়েল নিয়ে যাওয়া জাহাজে করে। এর জন্য মোসাদ আরও একটি দুর্ধর্ষ পরিকল্পনা তৈরি করে যার নাম দেওয়া হয় অপারেশন প্লামব্যাট। এই অপারেশনে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করে মোসাদ যাতে এই অভিযানে ইসরায়েলের যুক্ত থাকার ব্যাপারে কেউ জানতে না পারে। এর জন্য মোসাদ তুরস্কের ব্রাহাম নামে এক ব্যাক্তিকে ভাড়া করে যে এই ধরনের অপারেশনে দক্ষ। ব্রাহামের নামে লাইবেরিয়া থেকে মোসাদ একটি নকল সংস্থা তৈরি করে। এই সংস্থার নামে মোসাদ চার লাখ ডলারের বিনিময়ে বেলজিয়ামে একটি জাহাজ কেনে। 

১৯৬৮ সালের অক্টোবর মাসে উত্তর ইউরোপ থেকে উত্তর পশ্চিম আফ্রিকা পর্যন্ত জাহাজটির একবার চালিয়ে পরীক্ষাও করে মোসাদ। ১৫ নভেম্বর, ১৯৬৮ সালে এসজিএম স্যুজ্যেনকে হলুদ কেক ইউরেনিয়াম দিয়ে দেয়। ১৭ নভেম্বর জাহাজ ব্রাসেলস ছেড়ে ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা হয় কারন এসজিএমকে বলা হয়েছিল জাহাজ ইতালি যাবে কিন্তু মোসাদের পরিকল্পনা অন্যরকম ছিল। জাহাজটি জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন হয়ে জিব্রাল্টার প্রনালীতে পৌঁছায় এরপর জাহাজটির ইতালির অভিমুখে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু জাহাজটি ভূমধ্যসাগর অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। এই সময় ইসরায়েল থেকেও একটি জাহাজ ভূমধ্যসাগরের দিকে যাত্রা শুরু করে। কিছুদিনের মধ্যেই ভূমধ্যসাগরে দুটি জাহাজ একসাথে মিলিত হয় এবং বেলজিয়ম থেকে আসা জাহাজটি থেকে হলুদ কেক ইউরেনিয়াম ইসরায়েল থেকে আসা পন্যবাহী জাহাজে স্থানান্তরিত করা হয় এবং প্রথম জাহাজটি তুরস্ক অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। জাহাজটি যখন তুরস্কে পৌঁছায় ততক্ষনে ইসরায়েলের জাহাজটি থেকে ইউরেনিয়াম নেগিভ মরুভূমিতে পরমানু কেন্দ্রে পৌঁছে যায়। এর কিছুদিন পর গোটা ইউরোপ জেনে যায় চার মিলিয়ন ডলার মূল্যের হলুদ কেক ইউরেনিয়াম ইউরোপ থেকে উধাও হয়ে গেছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও ইসরায়েলই যে হলুদ কেক ইউরেনিয়াম নিয়েছে তার কোনও প্রমান পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে আমেরিকাতে নিউম্যেক সংস্থার থেকে ২০০ পাউন্ড ইউরেনিয়াম উধাও হয়ে যাওয়া নিয়ে তদন্তের মাঝেই আরও ৪০০ পাউন্ড ইউরেনিয়াম উধাও হয়ে যায়। 

আমেরিকার ইনটেলিজেন্স সংস্থাগুলো অনেক খুঁজেও এই ছয়শো পাউন্ড ইউরেনিয়াম উদ্ধার করতে পারেনি যার জন্য স্যাপিরোকে নিউম্যাক সংস্থার প্রেসিডেন্ট পদ থেকেই সরিয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনার কুড়ি বছর পর আমেরিকার পরমানু সংস্থা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাতে বলা হয় হারিয়ে যাওয়া ৬০০ পাউন্ড ইউরেনিয়াম ১৯৮২ সলােই নিউম্যাক সংস্থাতেই পাওয়া যায় কিন্তু এই ঘটনার জেরে স্যাপিরোর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছিল সেগুলোর কোনও প্রতিকার হয়নি। তবে নিউম্যাক ঘটনার প্রকৃত তথ্য কখনও প্রকাশ হয়নি। ইসরায়েলের পরমানু কেন্দ্রে হলুদ কেক ইউরেনিয়াম পৌঁছানোর চার পাঁচ বছর পর নরওয়ের পুলিশ এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে একজন মরোক্কর হোটেল কর্মীকে গুলি করে হত্যা করার অপরাধে। ওই ব্যক্তির নাম ড্যান অ্যারবেল। ড্যান অ্যারবেলই সেই ব্যক্তি যে মোসাদের সাথে হার্বাট সুজ্যেনের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। পুলিশের কাছে ড্যান ইসরায়েলের হলুদ কেক ইউরেনিয়াম কেনার সমস্ত তথ্য এবং অপারেশন প্ল্যামব্যাটের কথা প্রকাশ করে দেয়। এর থেকেই মোসাদের দুর্ধর্ষ অভিযানের কথা সবাই জানতে পারে। এই খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও আসে কিন্ত ইসরায়েল অস্বীকার করে, বেশ কিছু দেশও ইসরায়েলকে সমর্থন করে যার জন্য ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। ইসরায়েলের জনগনও জানতোনা তাদের সরকার দেশে পরমানু অস্ত্র তৈরি করছে। আমেরিকার সিআইএ মোসাদের অভিযানের কথা জানতে পারেনি নাকী আমেরিকা সব জেনেও চুপ ছিল সেটা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। মোসাদের এই অভিযান বিশ্বের সামনে ইসরায়েলি ইনটেলিজেন্স সংস্থার দক্ষতা প্রমান করেছিলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *