ভারত মহাসাগরে চীনকে প্রতিরোধে ত্রিস্তরীয় মাস্টার প্ল্যান
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পারস্পরিক স্বার্থের জন্য দুটি দেশের মধ্যে কুটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যেমন সম্প্রতি ভারত ও মালদ্বীপের কুটনৈতিক সম্পর্ক অবনতি হয়েছে। চীনের কারনে মালদ্বীপ দীর্ঘদিনের বন্ধু ভারতের বিরুদ্ধাচারন করেছে। মালদ্বীপকে বিশেষ করে ভারত মহাসাগরে চীনকে প্রতিরোধ করতে ভারত ইতিমধ্যেই তার পরিকল্পনা শুরু করে দিয়েছে। ভারত মহাসাগরে চীনকে প্রতিরোধ করতে ভারত মূলত ত্রিস্তরীয় পরিকল্পনা করেছে, লাক্ষাদ্বীপ, মরিশাস ও ওমান ভারতের এই মহা পরিকল্পনার অংশ, বিশেষ করে মরিশাস অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ন। এই কারনেই সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মরিশাসের আগালেগা দ্বীপে এয়ারস্ট্রিপের উদ্ভোদন করেছেন। মরিশাসের সাথে ভারতের সবসময়ই মজবুত কুটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। মরিশাসে ইউপিআই ব্যবহার হচ্ছে, রুপে কার্ডের ব্যবহার হচ্ছে। গতবছর মরিশাস ও ভারতের মধ্যে পাঁচশো মিলিয়ন ডলারের বানিজ্য হয়েছে। ভারত মরিশাসকে একশো মিলিয়ন ডলারের ঋনও দিয়েছে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার জন্য। মরিশাসের পাশেই অবস্থিত পূর্ব আফ্রিকার একটি দেশ মাদাগাস্কার। পূর্ব আফ্রিকারই আরেকটি দেশ মোজাম্বিক ও মাদাগাস্কারের মাঝে অবস্থিত মোজাম্বিক চ্যানেল একসময় গুরুত্বপূর্ন সমুদ্র বানিজ্য পথ ছিল। সুয়েজ খাল তৈরি হওয়ার আগে ইউরোপ থেকে কোনও জাহাজকে পূর্ব এশিয়া আসতে হলে এই মোজাম্বিক চ্যানেল হয়েই আসতে হত কিন্তু সুয়েজ খাল তৈরি হওয়ার পর এই অঞ্চলের গুরুত্ব কমে যায়। তবে পুনরায় এই অঞ্চলের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে কারন এই অঞ্চলে খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের নতুন ভান্ডার পাওয়া গেছে যার জন্য চীনও এই অঞ্চলে আট বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। একটা সময় বানিজ্যের ক্ষেত্রে আটলান্টিক মহাসাগরের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশী ছিল কিন্তু বর্তমানে বিশ্বের আশি শতাংশ সমুদ্র বানিজ্য ভারত মহাসাগর দিয়ে যায় যার কারনে ভারত মহাসাগর ভূরাজনীতির নতুন কেন্দ্র। এই কারনে চীন দক্ষিন মহাসাগরের পাশপাশি ভারত মহাসাগরেও তার উপস্থিতি বাড়িয়েছে যাতে বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
ভারত মহাসাগরের মাধ্যমে ভারতের আশি শতাংশ সমুদ্র বানিজ্য ও নব্বই শতাংশ এনার্জি পরিবহন হয়। এরকম অবস্থায় ভারত মহাসাগরে চীনের উপস্থিতি ভারতের জন্যও ভালো ব্যাপারনা। চীন ইতিমধ্যেই শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপকে ব্যবহার করে ভারত মহাসাগরে তাদের নৌবাহিনীর উপস্থিতি বাড়িয়েছে যার জন্য একে প্রতিরোধ করবার জন্য ভারতও ভারত মহাসাগরে তাদের নৌবাহিনীকে শক্তিশালী করছে। ভারত মহাসাগরে ইতিমধ্যেই আমেরিকা, ফ্রান্স তাদের নৌবাহিনী পাঠিয়েছে। ভারত মহাসাগরের রিইউনিয়ন দ্বীপ ফ্রান্সের অধীনে যার জন্য এখানে ফ্রান্সের নৌবাহিনী রয়েছে। ভারত মহাসাগরের দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপে ইতিমধ্যেই আমেরিকার একটি নৌঘাঁটি রয়েছে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আমেরিকার দুটি গুরুত্বপূর্ন সামরিক ঘাঁটির একটি হচ্ছে গুয়াম দ্বীপের এন্ডারসন বায়ুসেনা ঘাঁটি এবং আরেকটি এই দিয়েগো গার্সিয়া। ভারত মহাসাগরে চীনকে প্রতিরোধ করতে ফ্রান্স, আমেরিকার সাথে ভারতের কোয়াডের মতোনই জোট হতে পারে ভবিষ্যতে। ইতিমধ্যেই ফ্রান্সের রিইউনিয়ন দ্বীপে ভারতীয় নৌবাহিনীর পি এইটআই নেপচুন বিমান রয়েছে যা ভারত মহাসাগরে চীনের গতিবিধির উপর নজর রাখছে। ভারত মহাসাগরীয় কিছু দেশগুলোতে ভারতের সমরিক ঘাঁটি থাকলে চীনকে প্রতিরোধ করতে আরও সহজ হবে ভারতের জন্য। এই জন্য মরিশাস ভারতের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় কারন মরিশাসের অবস্থান স্ট্রাটেজিক্যালি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। মরিশাসের পূর্ব দিকে রয়েছে মালদ্বীপ এবং পশ্চিমে রয়েছে আফ্রিকান উপকূল। মরিশাসের জনসংখ্যা সত্তর শতাংশই ভারতীয় বংশোদ্ভূত কারন অতীতে ভারত থেকেই মানুষ গিয়ে মরিশাসে বসতি স্থাপন করেছিল। একটা সময় মরিশাস ফ্রান্স ও ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত আন্দোলনের পর মরিশাস ব্রিটেন থেকে স্বাধীন হয়। মরিশাসে প্রথম উপনিবেশ ছিল ফ্রান্সেরই। সেসময় ভারতের পন্ডিচেরীও ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল যার জন্য পন্ডিচেরী থেকে ভারতীয়দের মরিশাসে নিয়ে যায় ফ্রান্স। মহাত্মা গান্ধী আফ্রিকা থেকে ভারতে আসবার সময়ে মরিশাসে গিয়েছিলেন। সেই কারনে প্রতিবছর ১২ মার্চ মরিশাস গান্ধীজির ডান্ডি অভিযান উদ্দেশ্যে পালন করে, ওইদিন মরিশাসের স্বাধীনতা দিবসও। এসব কারনে মরিশাসের বিদেশনীতিতে বরাবরই ভারতের প্রভাব রয়েছে। আগালেগা দ্বীপ মরিশাসের রাজধানী পোর্ট লুইস থেকে ১,১০০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত দুটি দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত। মালদ্বীপের রাজধানী মালে থেকে আগালেগা দ্বীপের দূরত্ব ২,৫০০ কিলোমিটার। ২০০৫ সালেই ভারত মরিশাসে এয়ারস্ট্রিপ তৈরির ঘোষনা করে। ২০১৫ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মরিশাস সফরে এই ব্যাপারে চুক্তি হয়, তবে ২০১৯ সালের দিকে চীনের সমর্থিত কিছু সংগঠন মরিশাসে এই এয়ারস্ট্রিপ তৈরিতে বাধা দেয় তবে শেষ পর্যন্ত এই এয়ারস্ট্রিপ নির্মান সম্পূর্ন হয়েছে। গত ২৯ ফেব্রুয়ারী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী প্রবিন্দ জগনাউথ যৌথভাবে মরিশাসে এই এয়ারস্ট্রিপ, একটি জাহাজঘাট ও ছয়টি অন্য প্রকল্পের উদ্ভোদন করেন। উত্তর আগালেগা দ্বীপে নির্মিত এই এয়ারস্ট্রিপ থেকে আগে ভারতীয় নৌবাহিনীর ডরনিয়ার বিমান চলাচল করতে পারতো। তবে এয়ারস্ট্রিপ আপগ্রেডেশনের ফলে এখান থেকে পি৮ আই এর মতোন বিমানও চলাচল করতে পারবে। সুয়েজ খাল অঞ্চলে সম্প্রতি ইয়ামেনের হুথী বিদ্রোহীদের আক্রমনের কারনে বর্তমানে অন্তত ৪০ শতাংশ জাহাজ সুয়েজ খালের পরিবর্তে মোজাম্বিক চ্যানেল হয়ে ইউরোপ যাচ্ছে। তাছাড়া পশ্চিম ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডার রয়েছে, বিশেষ করে মোজাম্বিকের রোভুমা বেসিনে একশো ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিটের প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডার রয়েছে। এই কারনে পূর্ব আফ্রিকার এই অঞ্চলে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আসছে প্রচুর। যেমন আমেরিকার বিশিষ্ট এনার্জি সংস্থা অ্যানাডারকো ২০ বিলিয়ন ডলার মোজাম্বিককে বিনিয়োগ করেছে।
২০১৭ সালেই ইতালিয়ান সংস্থা ইনি এখানে আট বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে, ইতিমধ্যেই সংস্থাটি এখান থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস আরোহন করে এলএনজি রূপে এশিয়াতে বিক্রিও শুরু করে দিয়েছে। প্রাকৃতিক গ্যাস ছাড়াও পশ্চিম মাদাগাস্কারে খনিক তেলের ভান্ডার রয়েছে। সমীক্ষা অনুযায়ী এখানে ৯.৯ বিলিয়ন ব্যারেল খনিজ তেল রয়েছে, মাদাগাস্কারের প্রতিদিন মাত্র ১৫,০০০ ব্যারেল তেল প্রয়োজন, সুতরাং তেল রপ্তানির ব্যাপক সুযোগ রয়েছে এখানেও। চীনও ২০১৬ সালে এখানে ৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। ভারতের ওএনজিসি বিদেশে ২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে এখানে। এসব কারনে পশ্চিম ভারত মহাসাগরে জলদস্যু, জঙ্গিবাদ, মাদক কারবারিদের গতিবিধি বৃদ্ধির সম্ভবনা রয়েছে সেজন্য মরিশাস, মোজাম্বিকের মতোন দেশের ভারত, আমেরিকার মতোন শক্তিশালী দেশকে প্রয়োজন নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য। ভারত মরিশাসের এয়ারস্ট্রিপ, জাহাজঘাট ব্যবহার করে চীনের গতিবিধির উপর নজর রাখতে পারবে এবং এই অঞ্চলে সামুদ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা দিতে পারবে। মরিশাস জানে চীন ঋনের ফাঁদে ফেলে ছোট দেশগুলোর জমি অধিগ্রহন করে নেয় সেজন্য মরিশাস ভারতকে এয়ারস্ট্রিপ তৈরি করতে দিয়েছে আগালেগা দ্বীপে।
ভারত ইতিমধ্যেই মালদ্বীপের বিকল্প হিসাবে লাক্ষাদ্বীপের মিনিকয় দ্বীপে আইএনএস জটায়ু নৌঘাঁটি তৈরি করেছে। আইএনএস জটায়ু লাক্ষাদ্বীপে ভারতের দ্বিতীয় নৌঘাঁটি, ২০১২ সালের কাভারত্তি দ্বীপে প্রথম নৌঘাঁটি আইএনএস দ্বীপরক্ষক তৈরি করেছে ভারত।
১৯৮০ সাল থেকেই মিনিকয় দ্বীপে নৌবাহিনীর উপস্থিতি ছিল তবে এবার মিনিকয়ে পূর্ন নৌঘাঁটি তৈরি করা হল। ভারতের পূর্ব উপকূলে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত ভারতীয় নৌসেনার ঘাঁটি আইএনএস বাজের মতোনই আইএনএস জটায়ু চীনের বিরুদ্ধে ভারতীয় নৌবাহিনীকে আরও সুবিধা দেবে। রামায়নের জটায়ুর নাম থেকেই এর নৌঘাঁটির নাম আইএনএস জটায়ু রাখা হয়েছে। এই মিনিকয় দ্বীপে ভারত সরকার একটি বিমানবন্দরও তৈরি করবে যা ভারতীয় বায়ুসেনা যুদ্ধবিমান ও সাধারন যাত্রীবাহী বিমান উভয়েই ব্যবহার করতে পারবে।
বর্তমানে লাক্ষাদ্বীপের আগাত্তিতে একটিমাত্র এয়ারস্ট্রিপ রয়েছে, তবে এটি শুধুমাত্র ছোটি বিমানের জন্য ব্যবহার করা হয়। আইএনএস জটায়ু থেকে মালদ্বীপের সবচেয়ে উত্তরের দ্বীপ থুরাকুনুর দূরত্ব মাত্র ১৩০ কিলোমিটার। ভারতের মালদ্বীপকে প্রয়োজন ছিল শুধুমাত্র ভারত মহাসাগরে চীনের উপর নজরদারি করবার জন্য কিন্তু ভারতের লাক্ষাদ্বীপের মতো স্ট্রাটেজিক জায়গা থাকতে মালদ্বীপের প্রয়োজনীয়তা নেই। বরং অদূর ভবিষ্যতে মালদ্বীপেরই ভারতকে প্রয়োজন কারন অতীতে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক দূরাবস্থায় ভারত শ্রীলঙ্কাকে যে সহায়তা করেছিলো চীন তা করেনি সুতরাং মালদ্বীপের অবস্থাও চীনের মতোই হতে চলেছে। লাক্ষাদ্বীপ, মরিশাসের পর ওমানও ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ন। সম্প্রতি ওমানের সুলতান হাইথাম বিন তারিক ভারত সফরে আসেন এবং তারপরেই ওমান ভারতে তাদের ডুকম বন্দরের একটি এলাকা ব্যবহারের জন্য দিয়েছে। এর ফলে পারস্য উপসাগরে ভারত বানিজ্যিক সুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি পশ্চিম ভারত মহাসাগর ও লোহিত সাগরে ভারতীয় নৌবাহিনী আরও শক্তিশালী হবে। ডুকম বন্দরের মাধ্যমে মুম্বাই থেকে সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যে পন্য পরিবহনে সুবিধা হবে ভারতের।