জানেনকী অতীতে রাশিয়া চারবার ভারত আক্রমনের চেষ্টা করেছিল!
ভূরাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন শর্ত হল দুটি দেশ চিরদিনের জন্য একে অপরের বন্ধু থাকেনা অথবা দুটি দেশের মধ্যে চিরস্থায়ী শত্রুতা থাকাও সম্ভব নয়। বিশ্ব রাজনীতিতে দেশগুলো তাদের স্বার্থ অনুযায়ী নিজেদের মধ্যে কুটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। আজ রাশিয়া ভারতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ কুটনৈতিক মিত্র দেশগুলোর মধ্যে একটি কিন্তু একটা সময় রাশিয়াও ভারতে আক্রমনের পরিকল্পনা করেছিল। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূচনা লগ্নে ব্রিটিশরা যখন ধীরে ধীরে ভারতে তাদের আধিপত্য বিস্তার করছিলো তখন রাশিয়া ভাবতে থাকে ব্রিটিশদের মতো তারাও ভারতে প্রভাব বিস্তার করবে। আঠারো শতক থেকেই ভারতে ব্রিটিশদের পাশাপাশি ডাচ, পর্তুগীজ, ফরাসীদের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে শুরু করে যা রাশিয়াকেও ভারত আক্রমনের জন্য উৎসাহিত করে। রাশিয়া অন্তত চারবার ভারত আক্রমনের পরিকল্পনা করেছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাশিয়া তাদের এই পরিকল্পনা পূর্ন করতে পারেনি। তবে রাশিয়া ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করতে নাকী ভারতে উপনিবেশ স্থাপনের জন্য ভারত আক্রমনের পরিকল্পনা করেছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে।
আঠারো শতকে রাশিয়ার শাসক বা জার ছিল প্রথম পল। তিনি লক্ষ্য করেন ভারতে ব্রিটিশদের প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে। তিনি বুঝতে পারেন ব্রিটিশদের প্রতিরোধ করা না হলে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ আধিপত্য স্থাপন হবে এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ব্যাপক ধনী হয়ে যাবে। সেসময় ইউরোপীয়ান সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর মধ্যে একে অপরের সাথে বিরোধীতা ছিল। বিশেষ করে ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ড একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। জার প্রথম পল ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়নকে প্রস্তাব দেয় ভারতে সামরিক অভিযানের। প্রথম পল নেপোলিয়নকে বলেন ফরাসী সেনা দান্যিয়ুব নদী ও কৃষ্ণসাগর অতিক্রম করে মধ্য এশিয়ার দেশ কাজাখিস্তানে আসবে, সেখানে আগে থেকেই রাশিয়ান সেনাবাহিনী পৌঁছে যাবে। এখান থেকেই দুই দেশের মিলিত বাহিনী ভারতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করবে। এই পরিকল্পনায় প্রায় ৭০,০০০ ফরাসী ও রাশিয়ান সেনার ভারত অভিযানের কথা ছিল। কিন্তু অনেক ভাবনা চিন্তার পর নেপোলিয়ন প্রথম পলের এই প্রস্তাবে অসম্মত হয়। তখন প্রথম পল একাই তার ২২,০০০ সেনা সহ ভারত অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথম পল ভেবেছিল অন্তত অর্ধেক ভারত ব্রিটিশদের থেকে দখল করে নেবে। কিন্তু রাশিয়ার জারের কাছে থাকা ২২,০০০ সেনা ভারত অভিযানের জন্য যথেষ্ট ছিলনা। তাসত্বেও প্রথম পল ভারত অভিযানের জন্য সেনাও পাঠিয়ে দিয়েছিল। রাশিয়া থেকে ভারত পর্যন্ত সুদীর্ঘ পথ অভিযানে প্রয়োজনীয় রসদের অভাবে অনেক সেনার মৃত্যু হয় যার জন্য এই অভিযান ব্যর্থ হয়ে যায়। তাসত্ত্বেও আবারও প্রথম পল ভারত আক্রমনের ব্যাপারে মনস্থির করে ফেলেছিল কিন্তু হঠাৎ রাশিয়াতে জার প্রথম পলকে হত্যা করা হয়। এরপর রাশিয়ার নতুন শাসক হয় আলেক্সান্ডার প্রথম। তিনিও ভারতে অভিযানের স্বপ্ন দেখতেন। ১৮০৭ সালে আলেকজান্ডার প্রথম নেপোলিয়নকে টিলসিটের চুক্তির প্রস্তাব দেয়। এই চুক্তিতে বলা হয়েছিল পশ্চিম ইউরোপ ফ্রান্সের এবং পূর্ব ইউরোপ রাশিয়ার। এই চুক্তিতে দুই দেশের একত্রে ভারত অভিযানের প্রস্তাবও ছিল। কিন্তু এই চুক্তির আগেই ব্রিটিশরা সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। প্রথম পল যখন ভারত অভিমুখে সেনা পাঠিয়েছিল তখন থেকেই ব্রিটিশরা তাদের কুটনীতি শুরু করে দেয়। কাজাখিস্তান থেকে পার্সিয়ান সাম্রাজ্য ও আফগানিস্তান হয়ে ভারতে আসতে হত। সেসময় ইরানকে পার্সিয়া বলা হত। ব্রিটিশরা পার্সিয়ার সাথে চুক্তি করে পার্সিয়া যেন ফ্রেঞ্চ ও রাশিয়ান সেনাবাহিনীকে তাদের ভূমিতে প্রবেশাধিকার না দেয়, পার্সিয়া তাই করে। যার জন্য ভারত অভিযানের দ্বিতীয় পরিকল্পনাও ব্যর্থ হয়ে যায় রাশিয়ার।
নেপোলিয়ন যদি প্রথম পলের সাথে আগেই ভারত অভিযান করতো তবে নিশ্চিত ভাবেই ভারতবর্ষের বড় একটি অংশ তারা দখল করে নিত। ১৮১২ সালে নেপোলিয়ন হঠাৎ ফ্রান্সের দীর্ঘদিনের বন্ধু রাশিয়া আক্রমন করে এবং মস্কো জ্বালিয়ে দেয়। এই ঘটনার পর রাশিয়ান সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন হতে চল্লিশ বছর লেগে যায়। ১৮৫০ সালের পর জেনারেল আলেকজান্ডার ডুহামেল রাশিয়ার জার নিকোলাস প্রথমকে প্রস্তাব দেন ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেট বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের। আলেকজান্ডার ডুহামেল পার্সিয়া সহ বিভিন্ন দেশে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত হিসাবে বহুদিন ছিল। সেজন্য আলেকজান্ডার ডুহামেল নিকোলাস প্রথমকে জানায় সে পার্সিয়া ও আফগানিস্তানকে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর প্রবেশাধিকার নিয়ে মানিয়ে নিতে পারবে। ডুহামেলের কাছে খবর ছিল ভারতবাসীরাও ব্রিটিশ শাসন নিয়ে খুশি ছিলনা, অনেকেই বিদ্রোহ করতে চায়। আলেকজান্ডার ডুহামেল জানতো এটাই ভারত অভিযানের সঠিক সময়। কিন্তু হঠাৎই সেসময় অটোম্যান সাম্রাজ্যের সাথে রাশিয়ার ক্রিমিয়ান যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় যার জন্য নিকোলাস প্রথম আলেকজান্ডার ডুহামেলের ভারত অভিযানের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে জানায় এই মূহুর্তে রাশিয়াতেই সেনাবাহিনীর প্রয়োজন আছে। এভাবে তৃতীয় বারের মতো ভারত অভিযানের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায় রাশিয়ার। যদি সেসময় অটোম্যান সাম্রাজ্যের সাথে রাশিয়ার যুদ্ধ না হত তাহলে রাশিয়া নিশ্চিত ভাবেই ভারতে সেনাবাহিনী পাঠাতো।
১৮৫৫ সালে রাশিয়ান জেনারেল স্টিপ্যান খ্রুলেভ জার আলেকজান্ডার দ্বিতীয়কে প্রস্তাব দেয় রাশিয়া কম সংখ্যক সেনা আফগানিস্তানে পাঠাবে, সেখানকার স্থানীয়দের প্রশিক্ষন দিয়ে আফগানদের সাথে যৌথভাবে ভারতে অভিযান করবে। কিন্তু সেসময় ক্রিমিয়ান যুদ্ধে রাশিয়া হেরে যাওয়ায় এই পরিকল্পনাও ব্যর্থ হয়ে যায়। এভাবে রাশিয়ার ভারত অভিযানের চারটি পরিকল্পনাই ব্যর্থ হয়। ব্রিটিশরা যখন খ্রুলেভের পরিকল্পনার কথা জানতে পারে তখন ব্রিটিশরা আফগানিস্তান সাথেও চুক্তি করে নেয়। এরপরে আর কখনও রাশিয়া ভারতে অভিযানের পরিকল্পনা করেনি কখনও। এর বহুবছর পর ১৯৭০ এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে সেনাবাহিনী পাঠিয়েছিল কিন্তু দশ বছর যুদ্ধ করেও আফগানিস্তান জিততে পারেনি সোভিয়েত ইউনিয়ন।
রাশিয়ার ভারত আক্রমনের প্রধান উদ্দেশ্য ভারতের বিপুল ভূসম্পত্তি দখল এবং ভারতের গরম জলের বন্দরে প্রবেশাধিকার পাওয়া। আন্তর্জাতিক বানিজ্য বহুকাল ধরেই রাশিয়ার জন্য একটি প্রধান সমস্যা কারন রাশিয়ার অধিকাংশ বন্দরের জলই শীতকালে কয়েকমাসের জন্য বরফ হয়ে যায়। এজন্য রাশিয়ার এমন বন্দরের প্রয়োজন পড়ে যেগুলো সারাবছরই জাহাজ চলাচলযোগ্য থাকবে। এই জন্য ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া বন্দর দখল করে। অতীতে ভারত আক্রমনের পেছনেও রাশিয়ার এই উদ্দেশ্য ছিল মনে করে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা।