সুদান ও ইথিওপিয়া থেকে কিভাবে ইহুদিদের উদ্ধার করেছিল ইসরায়েল?
আফ্রিকার অন্যতম গরীব দুই দেশ ইথিওপিয়া ও সুদান। এই দুটি দেশে বিশেষ করে সুদানে প্রায় সময়ই রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকে। অতীতে এই দেশ দুটিতে বহুবার গৃহযুদ্ধ হয়েছে। গৃহযুদ্ধ চলাকালীন ইথিওপিয়া এবং সুদানের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর স্থানীয় সরকার অত্যাচার করে যথেষ্ট। ইথিওপিয়ার এমনই একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হচ্ছে ফালাশ মুরা। ইথিওপিয়ান সংখ্যালঘু ইহুদি সংগঠনের নাম ফালাশ মুরা এদের বেটা ইসরায়েল বেটা ইসরায়েল জাতিও বলা হয়। একসময় পূর্ব আফ্রিকা জুড়ে বিস্তৃত থাকা আকসুম সাম্রাজ্য ও পরবর্তীকালে ইথিওপিয়ান সাম্রাজ্যের সময়েও এই ফালাশ মুরা জনগোষ্ঠীর ইথিওপিয়াতে বসবাসের উল্লেখ পাওয়া যায়। ইসরায়েল তৈরি হওয়ার পর এই জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষ ইসরায়েল চলে আসে এবং ইথিওপিয়াতে থেকে যাওয়া বাকী ফালাশ মুরা জনগোষ্ঠী খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহন করে পরবর্তী কালে। ইথিওপিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় ইথিওপিয়ার মুরভূমি অঞ্চল দিয়ে খালি পায়ে এই জনগোষ্ঠীর মানুষরা বাধ্য হয়ে সুদানের শরনার্থী শিবিরে যাত্রা শুরু করে। কিন্ত মানুষগুলো জানতো না সুদানে তাদের বোন, মেয়েদেরকে বেচে দেওয়া হবে। ইসরায়েলের ইনটেলিজেন্স সংস্থা মোসাদ তাদের এই নরক থেকে উদ্ধার করেছিল।
১৯৬০ এস দশক থেকে ইথিওপিয়াতে একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে জন বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯৭৩ সাল আসতে আসতে এই বিক্ষোভ আরও বৃদ্ধি পায়। ইথিওপিয়ার এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে সমস্যায় পড়ে দেশটির সংখ্যা লঘু ইহুদি সম্প্রদায়। একটা সময় ইথিওপিয়াতে লক্ষাধিক ফালাশ মুরা জনগোষ্ঠীর লোক বসবাস করতো। আঠারো শতাব্দী থেকেই ফালাশ মুরার মানুষরা শুনে আসছে তাদের নিজস্ব দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু পরবর্তী দুইশো বছরেও তারা ইথিওপিয়া ছাড়তে পারেনি। এই সময়কালে তাদের উপর অত্যাচার, অবিচার প্রচুর হয়েছে যার কারনে বিংশ শতাব্দী আসতে আসতে তাদের জনসংখ্যা কমে হয় ২৫,০০০। ফালাশ মুরার জনগন অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় মানুষ তারা সবসময় চাইতো তারা যেন শান্তিপূর্ন ভাবে বসবাস করতে পারে।
১৯৭২ এর দশকে ইথিওপিয়াতে সরকার বিরোধী বিক্ষোভে সংখ্যালঘু ফালাশ মুরাকে নিশানা করা হয় যার কারনে ইথিওপিয়ান ইহুদিরা দেশ ছেড়ে ইসরায়েল চলে যাওয়ার চেষ্টা শুরু করে। কিন্তু ইথিওপিয়ান গৃহযুদ্ধে কোন নাগরিরককে দেশের বাইরে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দেওয়া হয় যার জন্য পরবর্তী পাঁচবছর ফালাশ মুরার জনগোষ্ঠী বাধ্য হয়ে ইথিওপিয়াতেই থাকতে বাধ্য হয়৷ ১৯৭৭ সালে ইসরায়েলের নতুন প্রধানমন্ত্রী হন মেনাচেম বেগিন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন ইথিওপিয়া থেকে সমস্ত ইহুদিদের ইসরায়েলে ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন। এর জন্য ইসরায়েল ইথিওপিয়ার মধ্যে একটি গোপন চুক্তি হয়, চুক্তি অনুযায়ী ইসরায়েল ইথিওপিয়া সরকারকে অস্ত্র দেবে বিদ্রোহ মোকাবিলায় এবং এর বদলে ইথিওপিয়া ফালাশ মুরাদের ইসরায়েলে পাঠাবে। ১২২ জন ইহুদি ইথিওপিয়া থেকে ইসরায়েলে পৌঁছানোর পর হঠাৎই এই চুক্তির কথা মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়ে যায় এবং ইথিওপিয়া এই চুক্তি ভেঙে দেয়। এরকম পরিস্থিতিতে ফালাশদের ইসরায়েলে পৌঁছানোর একমাত্র শেষ আশাও নষ্ট হয়ে যায়। বেশ কিছু সংখ্যক ইহুদি সুদানের শরনার্থী শিবিরে পলিয়ে যায়। সুদানের শরনার্থী শিবির পৃথিবীতে নরকের থেকে কম কিছু ছিলনা। এখানে জীবনযাপনের অত্যাবশকীয় উপাদান পর্যন্ত কম ছিল, এখানে পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে কেউ মারা গেলে তার মৃতদেহ সেখানেই পড়ে থাকতো। এই শিবিরেই একজন ইহুদি ছিল আকলুম যে লুকিয়ে মোসাদকে চিঠি লিখতো শরনার্থী শিবিরে থাকা ইহুদিদের ব্যাপারে। একদিন আকলুমের লেখা চিঠি পৌঁছায় এক মোসাদ এজেন্টের কাছে। সাথে সাথে মোসাদ একটি গোপন অপারেশন শুরু করে এবং ওই শরনার্থী শিবিরে থাকা দুইশোর অধিক ইহুদিদের সেখান থেকে ইসরায়েলে নিয়ে আসে। আকলুমকে মোসাদ দায়িত্ব দেয় আরও ইহুদিদের খুঁজে বার করতে। আকলুম সুদান থেকে ইথিওপিয়া চলে যায় ইহুদিদের খোঁজে সেখান ফালাশ মুরার জনগোষ্ঠীকে সুদান হয়ে ইসরায়েল পৌঁছানোর কথা জানায়। যার জন্য গোপন পথ দিয়ে হাজার হাজার ফালাশ মুরা সুদান অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু সুদান পৌঁছানোর পথ এত সহজ ছিলনা। ইথিওপিয়ার মরুভূমি অঞ্চলে খাদ্য, জলের অভাবে বেশ কিছু ইহুদিদের মৃত্যু হয়। মরুভূমিতে বিষাক্ত পোকা, সাপের আক্রমনেরও অনেকের মৃত্যু হয়, এছাড়া ডাকাদের হামলাতেও মানুষ মারা যায়। এই পুরো যাত্রাপথে প্রায় ১,৭০০ ইহুদির মৃত্যু হয়েছিল।
অবশেষে এই জনগোষ্ঠী যখন সুদান পৌঁছায় কিন্ত সুদানও তাদের জন্য নিরাপদ ছিলনা। কারন সুদান ইসরায়েলের শত্রু ছিল, এর আগে সুদান আরব লীগের সাথে তিনটি যুদ্ধে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সেনা পাঠিয়েছিল। সেজন্য সুদানে ফালাশ মুরা জনগোষ্ঠী তাদের ইহুদি পরিচয় গোপন করে।
সুদানের শরনার্থী শিবিরে মানুষদের উপর নারকীয় অত্যাচার করা হত, মহিলাদের শোষন করা হত, বাচ্চাদের বিক্রি করে দেওয়া হত। এত বিশাল সংখ্যক ইহুদি জনগোষ্ঠীকে সুদান থেকে ইসরায়েলে নিয়ে আসা মোসাদের জন্য যথেষ্ট কঠিন ছিল। সরাসরি সুদান সীমান্তে বাস পাঠানোও সম্ভব ছিলনা কারন ইসরায়েল ও সুদানের মাঝে রয়েছে মিশর যে ইসরায়েলের শত্রুদেশ। মোসাদ পরিকল্পনা করে লোহিত সাগর হয়ে ইহুদিদের সুদান থেকে ইসরায়েল নিয়ে আসবে কারন ইসরায়েল ও সুদান উভয়দেশই লোহিত সাগরের উপকূলে অবস্থিত। এই অপারেশনের জন্য মোসাদ একটি বিশেষ পরিকল্পনা তৈরি করে। সেসময় সুদানে লোহিত সাগরের নীচে প্রবাল প্রাচীর, জলজ জীবন দেখার জন্য স্কুবা ডাইভিং এর প্রচলন ছিল। এর জন্য ইতালির একটি সংস্থা সুদানের একটি নির্জন সমুদ্রতীরে একটি রিসর্ট তৈরি করেছিল কিন্তু ব্যবসা তেমন লাভজনক না হওয়ায় এই রিসর্টটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল। মোসাদের কিছু এজেন্ট সুইজারল্যান্ডের একটি নকল সংস্থা তৈরি করে ৩,২০,০০০ ডলারের বিনিময়ে তিন বছরের জন্য রিসর্টটি ভাড়া নেয়। সুদানের পর্যটন বিভাগ রিসর্টটির নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল। সুদানের শরনার্থী শিবির থেকে লড়িতে করে ইহুদিদের ৬০০ মাইল দূরে সুদানের লোহিত সাগর উপকূলে নিয়ে আসা হত। সেখান থেকে রবারের নৌকা করে সুদানি ইহুদিদের গভীর সমুদ্রে নিয়ে যাওয়া হত যেখানে আগে থেকেই ইসরায়েলি জাহাজ দাঁড়িয়ে থাকতো, এরপর সেই জাহাজে করে ইহুদিদের ইসরায়েল নিয়ে যাওয়া হত। এই রিসর্টটিকে লড়ি, নৌকা, গুরুত্বপূর্ন যোগাযোগ মাধ্যম রাখার জন্য এবং পরিকল্পনার জন্য মোসাদ এজেন্টরা ব্যবহার করতো যাতে মেসাদের অভিযান সম্পর্কে কেউ বুঝতে না পারে। জাহাজের পাশাপাশি সুদানের একটি পরিত্যক্ত রানওয়েতে হারকিউলিস বিমান পাঠিয়েও ইহুদিদের সুদান থেকে নিয়ে আসে মোসাদ৷ এই অপারেশনের নাম দেওয়া হয় অপারেশন ব্রাদার্স, এভাবে ১,৫০০ ইহুদিদের সুদান থেকে নিয়ে আসার পর হঠাৎই এই অপারেশনের খবর মিডিয়াতে প্রচার হয়ে যায় যার জন্য মোসাদ বাধ্য হয়ে অপারেশন বন্ধ করে দেয় এবং ওই রিসর্ট ছেড়ে মোসাদ এজেন্টরা চলে যায়। মোসাদ ইহুদিদের সুদান থেকে উদ্ধারের জন্য নতুন পরিকল্পনা তৈরি করে। ১৯৮৪ সালে সুদানে খাদ্যাভাবের কারনে সুদান আমেরিকার কাছে সাহায্য চায়। ইসরায়েলের সাথে বন্ধুত্বের কারনে আমেরিকা সুদানকে সাহায্যে পরিবর্তে সুদান থেকে ইহুদিদের ইসরায়েলে নিয়ে আসার প্রস্তাব দেয়। সুদান প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। মোসাদ অপারেশন মোসেস শুরু করে যাতে ১৯৮৪ সালের ২১ নভেম্বর থেকে ১৯৮৫ সালের ৫ জানুয়ারীর মধ্যে প্রায় ৮,০০০ ইহুদিকে প্রথমে সুদান থেকে বেলজিয়াম ও পরে বেলজিয়াম থেকে ইসরায়েল নিয়ে আসা হয়। সাত সপ্তাহে ৩০টিরও বেশী বিমানে করে ইহুদিদের উদ্ধার করে ইসরায়েল। তবে এই খবরও মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়ায় সুদান বাধ্য হয়ে এই অপারেশন বন্ধ করে দেয়। তবে তখনও বেশ কিছু ইহুদি সুদানে রয়ে গিয়েছিল যাদের আমেরিকা অপারেশন জোশুয়ারের মাধ্যমে উদ্ধার করে। এভাবে সুদান থেকে সমস্ত ইহুদি ইসরায়েল উদ্ধার করে যাতে আমেরিকা সহায়তা করেছিল। এই সমস্ত অপারেশনে দশ হাজারের মতোন ইহুদিকে উদ্ধার করা হয়। কিন্তু এরপরেও ইথিওপিয়াতে এখনও ১৫,০০০ ফালাশ মুরা জনগোষ্ঠী বাকী ছিল।
১৯৯১ সালে ইথিওপিয়ার রাজনৈতিক অবস্থা সংকট জনক হয়, বিদ্রোহীদের কাছে ইথিওপিয়ান সরকারের পতন প্রায় সুনিশ্চিত হয়৷ এই সুযোগে ইসরায়েল ইথিওপিয়া থেকে ইহুদিদের উদ্ধারের পরিকল্পনা করে, এই মিশনের নাম দেওয়া হয় অপারেশন সলোমন। আমেরিকাও এই অপারেশনে ইসরায়েলকে সহায়তা করে।
১৯৯১ সালের ২৪ থেকে ২৫ মের মধ্যে ইসরায়েল বায়ুসেনার সি ১৩০ হারকিউলিস ও বোয়িং ৭৪৭ সহ ৩৫টি বিমান ১৪,৩২৫ জন ফালাশ মুরাকে ইসরায়েল নিয়ে আসে। এই অপারেশনে একটি ইসরায়েলি বোয়িং ৭৪৭ বিমান ১,০৮৮ জন যাত্রীকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে যা গিনেস বুকের বিশ্ব রেকর্ডে স্থান। এভাবে প্রথমে সুদান ও পরে ইথিওপিয়া থেকে সমস্ত ইহুদিদের উদ্ধার করে ইসরায়েল।