অফবিট

চার হাজার বছরের পুরোনো মমির মতো প্রাচীন মানব সভ্যতার অসাধারন কিছু নিদর্শন

এই বিশাল মহাবিশ্বে কত রহস্য লুকিয়ে আছে তা কেউ জানেনা। পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের পর থেকে কালের প্রভাবে সভ্যতার বিবর্তন ঘটেছে। পুরোনো সভ্যতার পতন হয়েছে এবং নতুন সভ্যতার উদয় হয়েছে। যুগের পরিবর্তনে প্রযুক্তির উন্নয়নে বর্তমানে গোটা বিশ্ব হাতের মুঠোয়। কিন্তু আমাদের অতি পরিচিত এই পৃথিবী আজও রহস্যময়। এত পুরোনো মানব ইতিহাসের যেটুকু জানা গেছে তা যথেষ্ট নয়, পুরোনো সভ্যতার অনেক তথ্য এখনও আধুনিক যুগে এসেও জানা যায়নি। বলা হয় বহু আগেও উন্নত মানব সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল যা আজ কালের প্রভাবে নষ্ট হয়ে গেছে, হয়ত ভূগর্ভে চিরকালের মতো তাদের সমস্ত নিদর্শন বিলীন হয়ে গেছে। তবে সময় বিশেষে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পুরোনো সভ্যতার এমন কিছু নিদর্শন খুঁজে পাওয়া গেছে যা দেখে মনে হয় মাটির নীচে হয়ত আরও কত নাম না জানা সভ্যতার চিহ্ন লুকিয়ে আছে।

** ট্রাজানের স্নানাঘর:— রোমের সম্রাট ট্রাজানের সময় একটি বিশাল স্নানাঘর নির্মান করা হয়েছিল রোমে। জুলাই, ১০৯ সালে এই স্নানাঘরটির নির্মান সম্পূর্ন হয়েছিল। যদিও এর তেরো বছর আগেই রোমান সম্রাট ডমিটিয়ান এর নির্মানকাজ শুরু করেছিলেন। সেসময় রোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে উন্নত অঞ্চল ওপিয়ান পাহাড়ের দক্ষিন দিকে এই স্নানাগারটি তৈরি করা হয়েছিল। এটি নির্মান করেছিল দামাস্কাসের অ্যাপোলোডোরাস নামে এক স্থপতি। বলা হয় পঞ্চম শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত রোমের মানুষ এই স্নানাগারটি ব্যবহার করেছিল। এরপর ষোলো শতাব্দী পর্যন্ত স্নানাগার অব্যবহৃত ছিল, সেসময় এখান থেকে প্রাচীন রোমান শিল্পকলার অসাধারন সব নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়। যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল লাও কুম ও তার ছেলের স্থাপত্য, ১৫০৬ সালে হঠাৎই খুঁজে পাওয়া যায় এই স্থাপত্য। ২০১১ সালে এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের সময় ৫০ ফুট লম্বা বিশেষ পাথর পাওয়া যায় যাতে গ্রীক ও রোমান দেবতা অ্যাপোলোর ছবি রয়েছে। 

** ক্রিপটা নেপোলিটানা:— প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে ইতালির নেপলসের কাছে ৭০০ মিটারের বেশী লম্বা একটি সূড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছিল ৩৭ বিসিতে, একেই ক্রিপটা নেপোলিটানা বলে। নেপলসকে পোজুওলি শহরের সাথে সংযুক্ত করেছে এই সূড়ঙ্গ। নেপলস ও পোজুওলি ছিল প্রাচীন রোমের দুটি গুরুত্বপূর্ন বানিজ্যিক শহর কিন্তু এই দুটি শহরের মধ্যে সরাসরি সংযোগ ছিলনা যার জন্য বানিজ্যে সমস্যা হত। এই কারনে এই সূড়ঙ্গ নির্মান করা হয়। তবে এর আগেও বেশ কয়েকবার সূড়ঙ্গ নির্মানের চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু কোনওবারই সম্ভব হয়নি। অবশেষে ৩৭ বিসিতে লুসিয়াস কোকেসিয়াস অক্টাস নামে এক স্থপতি এই সূড়ঙ্গ নির্মান করেন। যেসময় এই সূড়ঙ্গ নির্মান করা হয় সেসময় রোমে ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে জুলিয়াস সিজার অক্টাভিয়ান ও সেক্সটাস পমপিয়াসের মধ্যে গৃহযুদ্ধ চলছিলো। বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এই সূড়ঙ্গ যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করা হত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই সূড়ঙ্গে বোমা রাখা হত। ১৯৫০ সালে এই সূড়ঙ্গে ধ্বস নামার পর, সূড়ঙ্গটিকে পুননির্মান করে ঐতিহাসিক স্থান হিসাবে সংরক্ষন করা হয়েছে। ৩৭ বিসিতে এই সূড়ঙ্গ নির্মান সত্যিই রোমানদের অসাধারন কারিগরি দক্ষতার নিদর্শন। 

** চার হাজার বছরের পুরোনো মমি:— পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যেই একটি মিশরীয় সভ্যতা যা অতীব রহস্যময়। পিরামিড থেকে শুরু করে মমি, বিখ্যাত শেয়াল দেবতা অনুবিস, প্রাচীন মিশরে এমন অনেক রহস্যময় জিনিস ছিল যার সম্পর্কে একবিংশ শতাব্দীতে এসেও মানুষ তেমন জানতে পারেনি। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে মিশরের সাক্কারাতে মাটির পঞ্চাশ ফুট নীচে একটি মমি খুঁজে পাওয়া গেছে যার বয়স প্রায় ৪,৩০০ বছর। মিশরের রাজধানী কায়রোর দক্ষিনে অবস্থিত এই সাক্কারাকে প্রাচীন মিশরে সমাধিস্থান হিসাবে ব্যবহার করা হত। এই জন্য সাক্কারাকে নেক্রোপলিস বা মৃত মানুষদের নগরীও বলা হয়। ইতিমধ্যেই এই সাক্কারা ইউনেস্কোর স্বীকৃতি প্রাপ্ত সংরক্ষিত এলাকা। অতীতে এই সাক্কারাকে মেম্ফিস বলা হত যা সেসময় মিশরের রাজধানী ছিল। সোনার পাতে মোড়ানো মমিটি প্রাচীন মিশরের হেকাশেপেস নামে এক ব্যক্তির। তবে হেকাশেপেস মিশরের ফারাওয়ের পরিবারের কেউ ছিলনা কিন্ত তার মমি দেখে মনে হয়েছে খুব সম্ভ্রান্ত পরিবারের ব্যক্তি ছিল সে। এখানে হেকাশেপেসের মমি ছাড়াও আরও বেশ কিছু মমি পাওয়া গেছে।

** সবুজ কফিন:— ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে আমেরিকা মিশরকে একটি কফিন ফেরত দেয়। এই কফিনটির বিশেষত্ব হল যে কফিনটির উপরে একটি সবুজ রঙের চিত্র রয়েছে। নয় ফুটের বেশী লম্বা এই কফিনটি প্রায় ২,৩০০ বছরের পুরোনো। এই কফিনটি প্রাচীন মিশরের এক পুরোহিত আখেনমাটের। আবু সির নামক এলাকা ২০০৮ সালে মিশর থেকে এটাকে চুরি করে জার্মানি হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গিয়েছিল একদল পাচারকারী। এই কফিনটির দাম দশ লাখ ডলারের বেশী৷ মিশর থেকে চোরা কারবারিরা অতীতে এরকম বহু কফিন, পুরোনো জিনিস চুরি করে ইউরোপ, আমেরিকাতে বিক্রি করেছে। 

** জাহাজের ধ্বংসাবশেষ:— এপ্রিল, ২০২২ সালে ইংল্যান্ডের কেন্ট উপকূলে ডাঞ্জনেসে খনিতে কাজ করার সময় একদল শ্রমিক ষোলো শতকের এক জাহাজের ধ্বংসস্তূপ খুজে পায়। ইংলিশ ওক গাছের কাঠ দিয়ে নির্মিত এই জাহাজটির নাম রাখা হয় ডাঞ্জনেস টিউডার জাহাজ। বিবিসি এই জাহাজটি তাদের একটি ডকুমেন্টরিতে দেখিয়েছিল। ষোলো শতকে ব্রিটেনের আধুনি জাহাজ নির্মানের একটি অনন্য নিদর্শন এই জাহাজটি।

** টাওস পুয়েবলো:— দক্ষিন পশ্চিম আমেরিকার আদি বাসিন্দাদের পুয়েবলো বলা হত। আমেরিকার নিউ মেক্সিকো প্রদেশের টাওস শহরের ১.৬ কিলোমিটার উত্তরে আজও একটি আদি আমেরিকান জাতি বাস করে যারা টাওস ভাষায় ভাষায় কথা বলে। আমেরিকার সবচেয়ে প্রাচীন অধিবাসীদের মধ্যে একটি এই টাওস পুয়েবলো। ইউনেস্কো সংরক্ষিত এলাকার তকমা দিয়েছে এই অঞ্চলকে। ৯৫,০০০ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই এলাকায় ৪,৫০০ মানুষ বাস করে। টাওস পুয়েবলো আটটি উত্তর পুয়েবলো জাতির একটি ভাগ। আমেরিকা এই অঞ্চলকে ঐতিহাসিক স্থানের তকমা দিয়েছে। এখানকার বাড়িঘর খুবই অদ্ভুত, সমস্ত বাড়ি দেওয়ালের মাধ্যমে একে অন্যের সাথে যুক্ত এখানে এবং বাড়িঘর খুবই জরাজীর্ন। ২০১১ সালে এখানে বাড়িঘর সংরক্ষনের জন্য আমেরিকান সরকার ৮ লাখ ডলারের প্রজেক্ট শুরু করেছিল। এখানে একটি নির্দিষ্ট এলাকা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের প্রবেশ অনুমতি দেওয়া হয়। 

** টাগা ঘর:— উত্তর মারিয়ান দ্বীপপুঞ্জের টিনিয়ান দ্বীপে সান জোস গ্রামে বিশাল বিশাল পাথরের খন্ড রয়েছে, যার মধ্যে কিছু পাথর সোজা মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে। এসব পাথরের সাহায্যে কয়েক হাজার পূর্বে এখানে বাড়ি তৈরি করা হত, সেসময় পাথর গুলোর লম্বায় পনেরো ফুট ছিল। পনেরো ফুট লম্বা এই  পাথরস্তম্ভের উপর ঘর তৈরি করা হত। এই ধরনের ঘরে থাকবার কারনে বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও হিংস্র জন্তদের হাত থেকে রক্ষা পেত মানুষজন। এই ধরনের ঘর নির্মান সম্পর্কে স্থানীয় উপকথা থেকে জানা যায় গুয়ামে কয়েক হাজার বছর আগে দশ ফুট উচ্চতার এক ছেলে ছিল যার নাম টাগা। ছোটবেলা থেকেই তার কিছু অতিমানবীয় ক্ষমতা ছিল। তার ক্ষমতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে তার বাবাই তাকে হত্যার চেষ্টা করেছিল। যার কারনে টাগা গুয়ামের এক পাহাড় থেকে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে ৮০ কিলোমিটার সাঁতার কেটে রোটা নামক জায়গায় উপস্থিত হয়। সেখানেই একজন স্থানীয় মেয়েকে বিয়ে করে টাগা এবং দুজনে টিনিয়ানে উপস্থিত হয়। টিনিয়ানের প্রধান টাগার ক্ষমতা থেকে এত প্রভাবিত হয়েছিল যে টাগাকে টানিয়ানের প্রধান ঘোষনা করে। টাগা এরপর নিজের হাতে পাথর ভেঙে একাই তার লোকেদের জন্য এসব ঘর তৈরি করে। সেইথেকে এসব ঘরকে টাগার ঘর বলা হয়। 

** কাঠের বৃত্ত :— বহু বছর ধরে মানুষের কাছে অজানা ছিল ইংল্যান্ডের নরফ্লোকে কাঠের বৃত্তের অস্তিত্বের কথা। ১৯৯৮ সালে ইংল্যান্ডের উত্তর নরফ্লোকের সমুদ্রতীরে এই কাঠের বৃত্তকে খুঁজে পাওয়া যায়। বলা হয় এই কাঠের বৃত্ত প্রায় চার হাজার বছরের পুরোনো ব্রোঞ্জ যুগের। ইংল্যান্ডের মিডিয়া এর নাম দিয়েছে সীহেঞ্জ। সমুদ্রে যাতে এগুলো নষ্ট না হয়ে যায় সেজন্য এগুলোকে সেখান থেকে তুলে এনে মিউজিয়ামকে রাখা হয়েছে। কেন এরকম কাঠের বৃত্ত তৈরি করা হয়েছিল তা আজও জানা যায়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *