অফবিট

ভারত সরকার বায়ু শক্তি উৎপাদনের উপর জোর দেওয়ার কারন কি?

করোনা মহামারী ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্বের বহু দেশেই অর্থনৈতিক মন্দা দেখা যায় বিগত দুই বছরে। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে চীন, জাপান, দক্ষিন কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, তাইওয়ান সহ ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা গিয়েছিল। কিন্তু সেই তুলনায় ভারতে কোনও অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়নি। উপরন্ত ব্রিটেনকে হারিয়ে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হয়ে ওঠে ভারত। ভারতকে অর্থনৈতিক ভাবে আরও শক্তিশালী করবার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০২৫ এর মধ্যে ভারতের অর্থনীতি পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার করার লক্ষ্য নিয়েছে। 

২০১৮-১৯ সালে ইকোনমিক সার্ভে অফ ইন্ডিয়া জানিয়েছে ভবিষ্যতে শক্তিশালী অর্থনীতি করতে হলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। তবে বর্তমানে বিশ্বের দেশগুলি অর্থনৈতিক বৃদ্ধির পাশাপাশি শক্তির নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহের দিকেও নজর দিয়েছে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের সময় রাশিয়া প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে ইউরোপীয়ান দেশগুলোতে মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক সমস্যা তৈরি করবার চেষ্টা করেছিল, এই ঘটনা আবারও প্রমান করেছে বিশ্ব রাজনীতিতে তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা সহ অন্যান্য শক্তি উৎসের জন্য একক ভাবে কোনও এক দেশের উপর নির্ভরশীল হওয়া উচিৎ নয়। এছাড়াও আরও একটি সমস্যা হচ্ছে বিশ্ব উষ্ণয়ন ও তার জেরে হওয়া আবহাওয়া পরিবর্তন যার জন্য সব উন্নত দেশই কার্বন মুক্ত দেশ গঠনের জন্য নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের উপর জোর দিয়েছে। ভবিষ্যতে সৌর শক্তি ও বায়ু শক্তি কয়লা ও তেলের বিকল্প হিসাবে ব্যবহৃত হবে। ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে ভবিষ্যতে যে দেশ নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনে বেশী সক্ষম হবে ভূরাজনীতিতে তার প্রভাবই বেশী থাকবে। তাছাড়া নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন দেশটির অর্থনৈতিক বিকাশেও সহায়তা করে। ঠিক এই জন্যই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারত সরকার ভারতে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনে একাধিক প্রজেক্ট শুরু করেছে। বিভিন্ন নবায়নযোগ্য শক্তি উৎসের মধ্যে বায়ু শক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন, ভারতে বায়ুশক্তি উৎপাদনের আদর্শ পরিবেশ রয়েছে।

২০২১ সালে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন বিভাগে বিশ্বে ৪৪০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়। গ্লোবাল উইন্ড এনার্জি কাউন্সিল বা জিইডব্লুউসির তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালে বিশ্বে মোট ৯০৬ গিগাওয়াট বায়ু শক্তি উৎপন্ন হয়েছে। জিইডব্লুউসি জানিয়েছে ২০২৩ থেকে ২০২৭ এর মধ্যে আরও ৬৮০ গিগাওয়াট নতুন বায়ু শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি হবে অর্থাৎ প্রতিবছর ১৩৬ গিগাওয়াট করে নতুন বায়ু শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি হবে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি ২০৫০ এর মধ্যে নেট জিরো অর্থাৎ কার্বন নির্গমন শূন্য করবার লক্ষ্য নিয়েছে যাতে বিশ্ব উষ্ণয়ন ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশী না হয়। এর জন্য বিশ্বের সবদেশ গুলো কার্বন নির্গমন কম করার জন্য নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের জোর দিয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির সমীক্ষা অনুযায়ী বিশ্ব উষ্ণয়নের মাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হলে বায়ু শক্তি উৎপাদন আরও বৃদ্ধি করতে হবে। সমীক্ষা অনুযায়ী বিশ্ব উষ্ণয়নকে প্রতিরোধ করতে ২০৩০ এর মধ্যে পৃথিবীতে বায়ু শক্তি উৎপাদন ৩০০০ গিগাওয়াট এবং ২০৫০ এর মধ্যে ৬১৭০ গিগাওয়াট করা প্রয়োজন। যা থেকে স্পষ্ট আগামী দশকে নবায়নযোগ্য শক্তি হিসাবে বায়ুশক্তি উৎপাদন খুব গুরুত্বপূর্ন হতে চলেছে। 

বর্তমানে সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতোন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তেলের কারনে যেমন বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ন, ঠিক তেমনি আগামী দশকে যে দেশ নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনে যত সক্ষম হবে সেই দেশ ভূরাজনীতিতে ততটাই প্রভাবশালী হবে। বর্তমানে বায়ু শক্তি উৎপাদনে সবচেয়ে শীর্ষে রয়েছে চীন। বায়ু শক্তি উৎপাদনের প্রয়োজনীয়  সমস্ত জিনিস তৈরি থেকে শুরু করে, তামা, নিকেল সহ বিরল উপাদান এবং প্রয়োজনীয় কাঁচামালের ৫৫ থেকে ৬৫ শতাংশই চীন নিয়ন্ত্রন করে। চীনে ৩২৯ গিগাওয়াট বায়ু শক্তি উৎপাদন হয়। পৃথিবীর শীর্ষ পাঁচটি বায়ু শক্তি উৎপাদকারী দেশের মধ্যে ভারতও রয়েছে। সাম্প্রতিক কিছু বছরে ভারতেও উৎপাদন ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৩ এর হিসাব অনুযায়ী ভারতে ৪৪.৭৩৬ গিগাওয়াট বায়ু শক্তি উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে যা বিশ্বের মধ্যে ভারতকে চতুর্থ বৃহত্তম বায়ু শক্তি উৎপাদনকারী দেশে পরিনত করেছে। ভারতের আগে রয়েছে চীন, আমেরিকা ও জার্মানি। 

ভারত সরকার ২০৩০ এর মধ্যে ভারতে ১৪০ গিগাওয়াট বায়ু শক্তি উৎপাদনের লক্ষ্য ঠিক করেছে। ভারতের বায়ু শক্তি উৎপাদন ক্ষমতা প্রধানত দক্ষিন, পশ্চিম এবং উত্তর-পশ্চিম রাজ্যগুলি জুড়ে বিস্তৃত। ২০১৪ সালের পর থেকে বিগত নয় বছরে ভারতে প্রায় ৩২ গিগাওয়াট বায়ু শক্তি উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের সমুদ্র উপকূলে ৭০ গিগাওয়াট বায়ু শক্তি উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে বিশেষ করে তামিলনাড়ু ও গুজরাটের উপকূলে জুড়ে বায়ু শক্তি উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির সম্ভবনা সবচেয়ে বেশী রয়েছে। বায়ু শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র মূল ভূভাগে ও উপকূলে দুই জায়গায় হয়। তবে উপকূলে হাওয়ার গতি মূল ভূভাগের তুলনায় অনেকটাই বেশী থাকে।

২০২০ সালে ম্যাকেনসি গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের বিশ্ব বাজারে ভারতের বিশেষ সুযোগ রয়েছে। আত্মনির্ভর ভারত, মেক ইন ইন্ডিয়া এবং বায়ু শক্তি উৎপাদন ভারতকে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হতে সহায়তা করবে। ১৯৮০ এর দশকে ভারত এক কিলোওয়াটের কম ক্ষমতা সম্পন্ন টার্বাইনের মাধ্যমে বায়ু শক্তি উৎপাদন করা শুরু করেছিল, সেখান থেকে বর্তমানে ভারত ২.২৫ মেগাওয়াটের টার্বাইন জেনারেটর তৈরি করছে। ইতিমধ্যেই ভারতে ৩ মেগাওয়াটের বেশী টার্বাইন জেনারেটরের চাহিদা দেখা দিয়েছে৷ বেশী শক্তিশালী টার্বাইন জেনারেটর কম খরচে বেশী বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম। অদূর ভবিষ্যতে এই জেনারেটর, টার্বাইন সহ প্রযুক্তি সহ নবায়নযোগ্য শক্তির উপকরন রপ্তানি করে ভারত আর্থিক ভাবে শক্তিশালী হতে পারবে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে ইউরোপ রাশিয়ার উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাশিয়াকে এক ঘরে করে দিতে চেয়েছিল। এর কারনে রাশিয়া প্রাকৃতিক গ্যাসকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে ইউরোপের বহু দেশে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল। যার কারনে ইউরোপীয়ান দেশগুলোর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল এবং মুদ্রাস্ফীতির বিরোধীতা করতে সাধারন মানুষ প্রতিবাদ শুরু করেছিল। এমনকী ওই দেশগুলোর গ্রীন এনার্জি ব্যবহারের পক্ষে থাকা সংগঠনগুলিও জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিল সরকারকে। এজন্যই ভারত কোনও একটি নির্দিষ্ট দেশ থেকে তেল কেনে না, তবে তেলের আমদানির জন্য এখনও ভারত ৮৫ শতাংশ মধ্যপ্রাচ্যের উপর নির্ভরশীল। এই কারনে বায়ু শক্তি সহ নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন করে ভারত স্বনির্ভরশীল হতে চাইছে শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে, এতে ভারতের বৈদেশিক সঞ্চয় আরও বাড়বে। তাছাড়া নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন এখন সব দেশের জন্যই জরুরী হয়ে পড়েছে বিশ্ব উষ্ণয়নের কারনে। 

২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর থেকে ১৩ নভেম্বর গ্লাসগোতে হওয়া কপ ২৬ এর সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জানিয়েছিলেন ২০৩০ এর মধ্যে ভারত তার শক্তি চাহিদার ৫০ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে পূরন করবে এবং ২০৭০ এর মধ্যে ভারত পুরো শূন্য কার্বন নির্গমন দেশে পরিনত হবে। আর এক্ষেত্রে বায়ু শক্তি নবায়নযোগ্য শক্তি উৎসের অন্যতম বড় বিকল্প। সৌর শক্তি ও বায়ু শক্তি যৌথভাবে ২৪ ঘন্টা শক্তি উৎপাদন করতে সক্ষম। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে বিশ্বে নবায়নযোগ্য শক্তির চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। 

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০২২ সালে ঘোষনা করেছে ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তির চাহিদা ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ড, জার্মানি ও বেলজিয়াম ২০৫০ সালের মধ্যে ১৫০ গিগাওয়াট বায়ু শক্তি উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়েছে। ব্রিটেন ২০৩০ এর মধ্যে ৫০ গিগাওয়াট বায়ু শক্তি উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, ভিয়েতনাম সহ আরও অনেক দেশও তাদের বায়ু শক্তি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে চলেছে। বিশ্ব বাজারে বিশেষ করে এশিয়া প্যাসিফিক ও ইউরোপে বায়ু শক্তির এই চাহিদা পূরন করার জন্য ভারতের জন্য এটা একটা বড় সুযোগ। এই কারনে ভারত সরকারের বিদ্যুৎ মন্ত্রক নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের জন্য বেসরকারি সংস্থাগুলোর জন্য টেন্ডার ডেকেছে। এর জন্য ভারত সরকার পাঁচ বছরে চারশো কোটি টাকা দেবে যাতে ভারতে বায়ু শক্তির পাশাপাশি অন্যান্য নবায়নযোগ্য শক্তির উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি হয়। ভারত নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের উপকরন, প্রযুক্তি বিক্রির৷ পাশাপাশি বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, মায়ানমারের মতোন প্রতিবেশী দেশকে বিদ্যুৎ বিক্রিও করতে পারবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *