অফবিট

উত্তর পূর্ব ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে চলা অবাক করা রেলওয়ে প্রজেক্ট

উত্তর পূর্ব ভারত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারনে বরাবরই ভারতের একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। উত্তর পূর্ব ভারতে আটটি রাজ্য রয়েছে সিকিম, অরুনাচল প্রদেশ, মনিপুর, আসাম, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মেঘালয় ও ত্রিপুরা। সিকিম ছাড়া বাকী সাতটি রাজ্যকে সেভেন সিস্টার বলা হয়।

পর্যটনকেন্দ্র ছাড়াও স্ট্রাটেজিক ভাবে এই অঞ্চল ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন, কারন উত্তর পূর্ব ভারতে চীন, মায়ানমার, বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালের সাথে ভারতের সীমানা রয়েছে, বিশেষ করে অরুনাচল প্রদেশে ভারত চীন সীমান্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন। ১৮৫৩ সালে ভারতে রেলওয়ে শুরু হলেও আজ ১৭১ বছর পরেও উত্তর পূর্ব ভারতে রেলওয়ে নেটওয়ার্ক তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি। যার জন্য এই অঞ্চলের উন্নয়নে ভারত সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে উত্তর পূর্ব ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে একাধিক রেলওয়ে প্রজেক্টে কাজ চলছে যা উত্তর পূর্ব ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহয়তা করবে। 

১৮৮২ সালে ডিব্রুগড় সাদিয়া রেলওয়ের প্রথম লোকোমোটিভ উত্তর পূর্ব ভারতের চায়ের বাগানের সাথে ব্রহ্মপুত্র নদীকে সংযুক্ত করেছিল, সেসময় আসাম থেকে কলকাতায় পন্য পৌঁছাতে সময় লাগত পনেরো দিন! বিগত ১৪৪ বছর ধরে ভারতীয় রেলওেয়ের যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে যার ফলে এই দূরত্ব কমে দাঁড়িয়েছে ২৪ ঘন্টায়, বিশেষ করে ২০১৪ সালের পর থেকে গত নয় বছরে উত্তর-পূর্ব ভারতে রেলওয়ে পরিকাঠামোর উন্নয়নের ফলে এই দূরত্ব আরও কয়েক ঘন্টা কমে গেছে। বিগত নয় বছরে উত্তর-পূর্ব ভারতে নতুন রেলপথ তৈরি, সেতু নির্মান, টানেল তৈরিতে ৫০,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে ভারত সরকার, এছাড়া আরও নতুন প্রজেক্টের জন্য ৮০,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত উত্তর পূর্ব ভারতে বছরে গড়ে ২, ১২২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হত রেলওয়ে খাতে কিন্তু বর্তমানে এই বিনিয়োগ ৩৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। 

২০২২-২৩ অর্থবর্ষে উত্তর-পূর্ব ভারতে রেলওয়ে খাতে ৯,৯৭০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। মালগাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি, জিরিবাম ইম্ফল রেললাইন, অ্যাক্ট ইস্ট নীতি অনুযায়ী আগরতলা আখাউরা রেললাইন নির্মান, পর্যটনশিল্পের বিকাশের জন্য আধুনিল ভিস্তাড্রোম কোচের ব্যবহার সহ বোগিবিল সেতু, ব্রহ্মপুত্র নদীর তলায় ভারতের প্রথম জলের নীচে রেল টানেল নির্মান সহ উত্তর-পূর্ব ভারতে রেলওয়ে পরিকাঠামোর উন্নয়নের জন্য একাধিক প্রজেক্টে কাজ করছে ভারত সরকার। উত্তর পূর্ব ভারতের নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ার রেলওয়ে বা এনএফআর আসাম থেকে গোয়া পর্যন্ত পার্সেল কার্গো এক্সপ্রেস শুরু করেছে যা পোষাক, চা, বাঁশের তৈরি জিনিস, ভোজ্যতেল সহ একাধিক হস্তনির্মিত জিনিস পরিবহন করে। এছাড়া এনএফআর মনিপুরের রানি গাইডিনলিউ স্টেশন থেকে ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও মালগাড়ির যাত্রা শুরু করেছে যাতে উত্তর পূর্ব ভারতের স্থানীয় ব্যাবসার প্রসার ঘটছে। 

উত্তর পূর্ব ভারতে চলা গুরুত্বপূর্ন কয়েকটি রেলওয়ে প্রজেক্ট :— 

** জিরিবাম ইম্ফল রেললাইন :— ১৩,৮০৯ কোটি টাকার প্রজেক্টে মনিপুরের রাজধানী ইম্ফল থেকে বাকী ভারতকে সংযুক্ত করার জন্য ১১১ কিলোমিটার লম্বা রেললাইন তৈরি করা হচ্ছে। এই পথে আটটি স্টেশন, ৬২ কিলোমিটার লম্বা টানেল, ১১টি প্রধান সেতু, ১৩৪টি ছোট সেতু রয়েছে। জিরিবাম ভাঙ্গাইচুংপাও তুপুল ইম্ফল পর্যন্ত তৈরি হওয়া এই রেললাইনে ভারতের সবচেয়ে লম্বা টানেল রয়েছে যার নাম টানেল নং ১২। জিরিবাম ও পশ্চিম ইম্ফল জেলার মধ্যে তৈরি হওয়া ১১.৫৫ কিলোমিটার লম্বা এই টানেলের আগে ভারতের সবচেয়ে লম্বা টানেল ছিল ৮.৫ কিলোমিটার লম্বা পীর পঞ্জাল রেলওয়ে টানেল। তবে এই রেলওয়ে টানেলের সমান্তরালে একটি ৯.৩৫ কিলোমিটার লম্বা নিরাপদ টানেলও রয়েছে জরুরী পরিস্থিতিতে উদ্ধারকার্যের জন্য। টানেল নং ১২ ও তার সমান্তরালের নিরপদ টানেল তৈরি করতে ৯৩০ কোটি ও ৩৬৮ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এই রেলপথেই তৈরি করা হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পিলার সেতু ননি সেতু যার উচ্চতা ১৪১ মিটার এবং সেতুর দৈর্ঘ্য ৭০৩ মিটার। আগে আসাম থেকে মনিপুর পৌঁছাতে সময় লাগতে ১০ থেকে ১২ ঘন্টা কিন্ত এই রেলপথ নির্মানের ফলে ইম্ফল থেকে আসামের মধ্য পৌঁছাতে সময় লাগবে মাত্র ২.৫ ঘন্টা। ভবিষ্যতে এই রেললাইন আরও বাড়িয়ে ইম্ফল থেকে মোরেয় হয়ে মায়ানমারে কালে রেলস্টেশন পর্যন্ত করা হবে, যা ভারতের লুক ইস্ট নীতির অঙ্গ। এর ফলে ভারত থেকে পন্য আরও সহজে মায়ানমার হয়ে পূর্ব এশিয়াতে ছড়িয়ে পড়বে। 

** সেবক রংপো লাইন:— পশ্চিমবঙ্গের সেবক থেকে সিকিমের রংপো পর্যন্ত ৪৪.৯৮ কিলোমিটার লম্বা রেললাইন তৈরি করা হচ্ছে। এই রেলপথের ৩.৫ কিলোমিটার পথ সিকিমের মধ্যে রয়েছে এবং বাকী পথ পশ্চিমবঙ্গেই রয়েছে। রংপো হতে চলেছে সিকিমের প্রথম রেল স্টেশন। সিকিমের সাথে চীন, ভুটান ও নেপালের আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে যার জন্য সিকিমে রেলপথ নির্মান স্ট্রাটেজিক ভাবেও গুরুত্বপূর্ন। সিকিমের তিনধাপে রেলওয়ে নেটওয়ার্ক তৈরি করা হচ্ছে। প্রথম ধাপে সিভক থেকে রংপো পর্যন্ত রেললাইন তৈরি করা হচ্ছে, এরপর দ্বিতীয় ধাপে রংপো থেকে গ্যাংটক পর্যন্ত রেললাইন তৈরি করা হবে এবং তৃতীয় ধাপে গ্যাংটক থেকে তিব্বত সীমান্তে নাথুলা পর্যন্ত রেললাইন নির্মান করা হবে। সিভক রংপো এই রেলপথের ৪৪.৯৮ কিলোমিটারের মধ্যে ৩৮.৫৫ কিলোমিটার পথ অর্থাৎ ৮৫ শতাংশ পথ টানেলের মধ্যে দিয়ে যাবে। এই পথে ১৪টি টানেল থাকবে এবং সবচেয়ে লম্বা টানেলের দৈর্ঘ্য হবে ৫.২৭ কিলোমিটার। যেহেতু এই পথের বেশীরভাগই টানেলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সেকারনে টানেলের ভিতরই একটি স্টেশন তৈরি করা হচ্ছে যার নাম তিস্তা বাজার রেল স্টেশন যা ভারতের প্রথম মাটির তলায় রেল স্টেশন হতে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের কালিম্পং জেলায় সিকিম সীমান্তের কাছেই এই স্টেশন তৈরি করা হচ্ছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে রংপো পর্যন্ত বন্দে ভারত ট্রেন চালানোর ঘোষনা করেছেন। 

** বৈরাবী সাইরাং লাইন:— মেঘালয়ের কোলাসিব জেলার বৈরাবী থেকে মেঘালয়ের আইজল জেলার সাইরাং পর্যন্ত ৫১.৩৮ কিলোমিটার লম্বা রেললাইন তৈরি করা হচ্ছে। এই প্রজেক্টের জন্য ২৪ হেক্টর জমি অধিগ্রহন করা হয়েছে। ৫,০২১.৪৫ কোটি টাকার এই প্রজেক্টে রেলপথ নির্মান করতে ১৪২টি সেতু, ২৩টি টানেল ও চারটি স্টেশন তৈরি করা হবে। এই প্রজেক্টের ৯১ শতাংশ কাজ সম্পূর্ন হয়ে গেছে, ২০২৪ এর মধ্যেই পুরো প্রজেক্টের কাজ সম্পূর্ন হয়ে যাবে। মিজোরামে এতদিন একটাই রেলওয়ে স্টেশন ছিল বৈরাবী। তবে এই প্রজেক্ট সম্পূর্ন হলে মিজোরামের রাজধানী আইজলও দেশের বাকী শহরগুলোতর সাথে যুক্ত হয়ে যাবে। ভবিষ্যতে সাইরাং থেকে রেললাইন বাড়িয়ে ভারত মায়ানমার সীমান্তে জোচাছুয়াহ পর্যন্ত করা হবে। মায়ানমারের ভিতরেও পরে আরও ৯০ কিলোমিটার রেল লাইন তৈরি করে কালাদান মাল্টিমোডাল প্রজেক্টের আওতায় সিটওয়ে বন্দরের সাথে যুক্ত করা হবে।  

** ধানসিড়ি জুব্জা লাইন:— নাগাল্যান্ডের ডিমাপুর রেলওয়ে স্টেশনের কাছে ধানসিড়ি জংশন থেকে কোহিমার জুব্জা রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত ৮৮ কিলোমিটার লম্বা এই রেললাইন তৈরির কাজ চলছে। পুরো প্রজেক্ট তিন দফায় শেষ করা হবে। প্রথম ধাপে ধানসিড়ি থেকে শোখুভি পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার লম্বা রেললাইন তৈরি করা হচ্ছে, দ্বিতীয় ধাপে শোখুভি থেকে খাইবাঙ্গ অবধি ৩০ কিলোমিটার লম্বা রেললাইন তৈরি করা হবে এবং তৃতীয় ধাপে খাইবাঙ্গ থেকে জুব্জা পর্যন্ত ৪৫ কিলোমিটার লম্বা রেললাইন তৈরি করা হবে। ২০২৬ সালের মার্চ মাসের মধ্যে পুরো প্রজেক্ট সম্পূর্ন হয়ে যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *