অফবিট

উটের মৃত্যুর কারনে ৪০ বছর ধরে যুদ্ধ

মানব ইতিহাসের শুরু থেকেই দুটি গোষ্ঠী বা জাতি, রাজ্য কিংবা দেশের মধ্যে যুদ্ধ হয়ে আসছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পেছনে অনেক কারন থাকে, কিছু যুদ্ধ হয় ভূমি দখলকে কেন্দ্র করে যেমন রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ, কিছু লড়াই হয় প্রাকৃতিক সম্পদের কারনে যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধ হয়েছিল আমেরিকা ও জাপানের মধ্যে, আবার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানের জন্য মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধও হয় যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শীতল যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাসে অদ্ভুত কারনে এমন কিছু যুদ্ধ শুরু হয়েছিল যা সত্যিই অবাক করার মতোন।

১) উটের কারনে যুদ্ধ :— সময়টা তখন ৪৯৪ সাল, সেসময় আরব অঞ্চলে অনেক ছোট ছোট গোষ্ঠী ছিল। অনেক সময় গোষ্ঠীগুলির মধ্যে বন্ধুত্ব হত বা লড়াই হত। এরকমই একটি গোষ্ঠী তাঘলিবের প্রধান ছিল কুলাইব ইবন রাবিয়া। তার স্ত্রী জালাইলা বিন্ট মুরাহ বকর গোষ্ঠীর মেয়ে ছিল। সেসময় প্রত্যেকটি গোষ্ঠী তার এলাকার সীমানা নির্ধারন করতো কোনও গাছ, কোনও পাথুরে এলাকা অথবা নির্দিষ্ট চিহ্ন দিয়ে। কিন্তু রাবিয়া ছিল আলাদা ধরনের। রাবিয়ার তাঁবুর বাইরে একটা কুকুর বাধা থাকতো, রাবিয়া বলতো এই কুকুরের ডাক যতদূর পর্যন্ত শোনা যাবে ততটা এলাকা তার। একদিন রাবিয়ার স্ত্রী জালাইলার ভাই বাসেস ও তার পরিবারের কিছু লোক জালাইলার সাথে দেখা করতে আসে। বাসেস একটি উটে করে তাঘলিব গোষ্ঠীর এলাকায় আসে, তার বোনের তাঁবুর বাইরে উটটি ঘাস খাচ্ছিলো। রাবিয়া এই ঘটনা জানতোনা, সে হঠাৎ লক্ষ্য করে তার এলাকায় অন্য একটি উঠ রয়েছে সাথে সাথে সে তীর চালায় এবং উটটি মারা যায়। বাসেস তার প্রিয় উটের মৃত্যু দেখে প্রতিশোধ নিতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে রাবিয়াকে এবং ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় রাবিয়ার। তবে মৃত্যুর আগে একটি পাথরে নিজের রক্ত দিয়ে রাবিয়া লিখে রেখে যায় বাসেসের উপর ও বকর গোষ্ঠীর উপর প্রতিশোধ নিতে। এরপরে পরবর্তী ৪০ বছর ধরে অর্থাৎ ৪৯৪ সাল থেকে ৫৩৪ সাল পর্যন্ত তাঘলিব গোষ্ঠী ও বকর গোষ্ঠীর মধ্যে ভয়ানক যুদ্ধ হয় বারবার, একে বাসেসের যুদ্ধও বলা হয়। একটি উটের মৃত্যুর কারনে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। 

২)জাহাজের প্রতিযোগিতার কারনে যুদ্ধ :— ১১২০ সালে ব্রিটেনের রাজা ছিল হেনরী প্রথম, তার একমাত্র ছেলে ছিল উইলিয়াম অ্যাডেলিন। যুবরাজ হওয়া সত্বেও উইলিয়ামের মধ্যে রাজত্ব করার কোনও গুন ছিলনা। সেসময় ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে সংঘর্ষ হত প্রায়ই। যার কারনে হেনরী প্রথম ঠিক করে একটি কুটনৈতিক সফরে ফ্রান্স গিয়ে উভয়ে দেশের মধ্যে শান্তি স্থাপন করবে। সেই মতো রাজা হেনরী প্রথম তার মন্ত্রীদের সাথে একদিন রাতের বেলায় ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। উইলিয়ামেরও তার বাবার সাথেই যাবার কথা ছিল। কিন্ত উইলিয়াম অত্যাধিক নেশা করে জাহাজের মধ্যে প্রতিযোগিতা করবার জন্য তার বাবাকে আগে যেতে দেয়। এরপর উইলিয়াম সেসময় ব্রিটেনের সবচেয়ে দ্রুতগামী জাহাজ দি হোয়াইট শিপে গিয়ে তার ক্যাপ্টেনকে নির্দেশ দেয় জাহাজ এতটাই দ্রুত চালাতে যেন সে তার বাবার আগে ফ্রান্স পৌঁছে যায়। জাহাজের ক্যাপ্টেনও সেইমতো জাহাজ চালাতে শুরু করে। কিন্তু রাতের অন্ধকারে পাথরে ধাক্কা খেয়ে উইলিয়াম সহ হোয়াইট শিপের প্রত্যেকেই মারা যায়। ছেলের মৃত্যুর পর হেনরী প্রথম তার মেয়ে ম্যাটিল্ডাকে সিংহাসনে বসায়। প্রথম হেনরীর মৃত্যুর পর ম্যাটিল্ডাকে সিংহাসনে বসতে বাধা দেয় প্রথম হেনরীর ভাইপো স্টিফেন, সে নিজে রাজা হওয়ার চেষ্টা করে। যার কারনে স্টিফেন ও ম্যাটিল্ডার মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। কুড়ি বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চলার পর ম্যাটিল্ডার একটি পুত্র সন্তান জন্মানোর পর তাকে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসানো হয় এবং তখন গৃহযুদ্ধ শেষ হয়। এই ছেলটির নাম ছিল হেনরী দ্বিতীয়। এভাবে জাহাজের প্রতিযোগিতার কারনে ইংল্যান্ডের সিংহাসনের উত্তরাধিকারির মৃত্যুর পর কুড়ি বছর ধরে ব্রিটেনে গৃহযুদ্ধ চলেছিল।

৩) ভুল ব্যক্তির সাথে শত্রুতা করা:— ১২১৮ সালে পূর্ব এশিয়াতে সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য ছিল মোঙ্গল সাম্রাজ্য যার নেতা ছিল চেঙ্গিস খান। মোঙ্গল সাম্রাজ্যকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় একটানা ভূমি বিশিষ্ট সাম্রাজ্য বলা হয়। ইতিহাসের সবচেয়ে বেশী নির্দয়ী ও হিংস্র শাসকদের মধ্যে একজন ছিল এই চেঙ্গিস খান যে নিজের শাসনকালে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছিল। এরকম ব্যক্তির সাথে কোনও মানুষই শত্রুতা করতে চাইবেনা কিন্তু একজন রাজা চেঙ্গিস খানের সাথে শত্রুতা করে এবং তাকে তার মূল্য চোকাতে হয়। মোঙ্গল সাম্রাজ্যের সময় মধ্য এশিয়াতে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য ছিল খাওয়ারজামিন সাম্রাজ্য যার শাসক ছিল মহম্মদ দ্বিতীয়। 

১২১৮ সালে চেঙ্গিস খান ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য খাওয়ারজামিনে তার কিছু দূত পাঠায় কিন্তু মহম্মদ দ্বিতীয় চেঙ্গিস খানের দূতেদের গ্রেফতার করায় তার গভর্নরকে দিয়ে। চেঙ্গিস খান সেসময় চীন অভিযানে গিয়েছিল। এই খবর পেয়ে আবারও কিছু দূত পাঠায় চেঙ্গিস খান। কিন্তু এবার সেই দূতদের গ্রেফতার করে হত্যা করে মহম্মদ দ্বিতীয়। এরপরই চেঙ্গিস খান চীন অভিযান বন্ধ করে এক লাখ সেনাবাহিনী জোগাড় করে খাওয়ারজামিন সাম্রাজ্য আক্রমন করে। খাওয়ারজামিনের একের পর এক শহর চেঙ্গিস খান দখল করে নেয় এবং ভয়ানক নরহত্যা চালায়। মহম্মদ দ্বিতীয় তার রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে যায়। চেঙ্গিস খান তার পেছনে তার কিছু বিশেষ দূত পাঠিয়ে দেয়। এভাবে পালাতে পালাতেই মৃত্যু হয় মহম্মদ দ্বিতীয়র। 

৪) বাইবেলকে পাশে রেখে দেওয়া নিয়ে যুদ্ধ :– ১৫৩২ সালে দক্ষিন আমেরিকার একটি বড় অংশে ইনকা সাম্রাজ্যের শাসন ছিল। তখন ইনকা সাম্রাজ্যের শাসক ছিল আতাহুয়ালপা। ১৫৩২ সালের সময় ইউরোপের বড় বড় শক্তিগুলো বিশেষ করে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও স্পেন সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করেছিল। এই সময় স্পেনের একজন স্প্যানিশ অভিযাত্রী ফ্রান্সিসকো পিজারো পেরুর কাছে পৌঁছায়। পিজারো দুইশো জন সেনাকে তার সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেসময়ের হিসাবে তার সেনার কাছে আধুনিক অস্ত্র ছিল, লোহার তরোয়াল, ঢাল, দুটো ছোট কামানও ছিল। কিছু সময়ের মধ্যেই পিজারো আশেপাশের সমস্ত এলাকা দখল করা শুরু করে। একদিন পিজারোর সাথে পরিচয় হয় আতাহুয়ালপার একজন মন্ত্রীর। তার মাধ্যমে ১৫৩২ সালের ১৬ নভেম্বর আতাহুয়ালপার সাথে সাক্ষাৎ করার দিন ঠিক হয় পিজারোর। তবে পিজারো সরাসরি যাওয়ার আগে তার কিছু দূতকে পাঠিয়েছিল আতাহুয়ালপার কাছে। স্প্যানিশ দূত আতাহুয়ালপাকে বাইবেল উপহার দেয়, আতাহুয়ালপা জীবনে কখনও লিখিত বই দেখেনি যার কারনে সে বইটি পাশে রেখে দেয়। বাইবেল পাশে রেখে দেওয়াকে অপমান হিসাবে মনে করে স্প্যানিশ দূত এবং ফ্রান্সিসকো পিজারো আতাহুয়ালপাকে আক্রমন করে। ইনকান বইয়ে লেখা আছে স্প্যানিশ দূতকে পানীয় দিয়ে সংবর্ধনা করেছিল আতাহুয়ালপা কিন্তু সেই দূত পানীয় ফেলে দেয় জবাবে আতাহুয়ালপাও বই পাশে রেখে দেয়। আতাহুয়ালপার কাছেও সেনাবাহিনী ছিল কিন্তু পিজারোর প্রশিক্ষিত, আধুনিক অস্ত্র যুক্ত সেনার কাছে আতাহুয়ালপা পরাজিত হয় এবং তাকে বন্দী করা হয়। আতাহুয়ালপা মুক্তির জন্য পিজারোকে প্রচুর সোনা, রূপো দেয়। বলা হয় আতাহুয়ালপা প্রায় ২২,০০০ কোটি টাকার সোনা, রূপো দিয়েছিল ফ্রান্সিসকো পিজারোকে। এত ধনসম্পদ দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল পিজারো। ধনসম্পদ পাওয়া সত্বেও আরও সোনার লোভে আতাহুয়ালপাকে বন্দী করে রাখে পিজারো এবং পরে তাকে হত্যাও করে। এই ঘটনার নয় বছর পর ১৫৪১ সালে ফ্রান্সিসকো পিজারোকেও তার বাড়িতে কিছু ডাকাত গলায় ছুরি দিয়ে হত্যা করে। তবে ফ্রান্সিসকো পিজারো দক্ষিন আমেরিকার অনেক অঞ্চল সেসময় দখল করে ফেলেছিল যার কারনে আজও দক্ষিন আমেরিকাতে স্প্যানিশ ভাষার প্রধান্য দেখা যায়।

৫) এক ব্যক্তিকে হত্যার কারনে গোটা বিশ্ব ভয়ানক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে:— ১৯১৪ সালের ২৮ জুন অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের যুবরাজ আর্চ ডিউক ফার্ডিনান্ড ও তার স্ত্রীকে বসিনিয়ার সারাজেভোতে হত্যা করে গ্যাভরিলো প্রিন্সিপ। এরপরেই অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরি সার্বিয়াকে আক্রমন করে। সার্বিয়ার পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয় রাশিয়া, অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরির পক্ষে যোগ দেয় জার্মানি। জার্মানির বিপক্ষে যোগ দেয় ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স। এভাবে গোটা ইউরোপ ভয়ানক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, শেষে আমেরিকাও ব্রিটেনের পক্ষে যোগ দেয়। ইতিহাসে এই যুদ্ধ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নামে পরিচিত। এভাবে একজন ব্যক্তিকে হত্যা করার কারনে পুরো ইউরোপ সহ ইউরোপের উপনিবেশগুলোও মহা বিনাশক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পাঁচ বছর ধরে চলা এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে প্রায় চার কোটি মানুষের  মৃত্যু হয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *