অফবিট

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জপানি যুদ্ধপরাধীদের কিভাবে বিচার হয়েছিল?

৬ আগস্ট, ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা শহরে মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পরমানু বোম্ব বিস্ফোরন ঘটায় আমেরিকা। পরমানু বোম্বের ভয়বহতা সেই প্রথম বিশ্ব দেখতে পায়। সবাই ভেবেছিল এবার জাপান আত্মসমর্পন করবে। কিন্ত জপান আত্মসমর্পন করেনি। ৮ আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন মাঞ্চুরিয়াতে থাকা জাপানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমন করে। তবে তারপরেও জাপান আত্মসমর্পন করেনি। ৯ আগস্ট জাপানের নাগাসাকি শহরে দ্বিতীয় বারের মতোন পরমানু বোম্ব বিস্ফোরন করে এই বোম্ব হিরোশিমা ফেলা পরমানু বোম্বের থেকেও শক্তিশালী ছিল। এই ঘটনার ছয়দিন পর ১৫ আগস্ট জাপানের সম্রাট জানায় তারা আর যুদ্ধ করবেনা এবং সেপ্টেম্বরে জাপান সরকারি ভাবে আত্মসমর্পন করে। এভাবেই ১৯৩৯ সাল থেকে চলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পূর্ন রূপে শেষ হয় কারন জার্মানি মে মাসেই আত্মসমর্পন করেছিল। জাপানের আত্মসমর্পন পরেই জাপানের সামরিক নেতৃত্ব, রাজনৈতিক নেতৃত্বর বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া চালায় মিত্রশক্তি, এই ঘটনাকে ইতিহাসে টোকিও ট্রায়াল বলা হয়। ইউমা টোটানির লেখা দি টোকিও ওয়ার ক্রাইম ট্রায়াল বইয়ে এই ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। 

১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর জাপানের সম্রাট আত্মসমর্পন চুক্তিতে সাক্ষর করে এবং সরকারিভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। এর ঠিক একসপ্তাহ পর জাপানী অঞ্চলে যুদ্ধ করা মিত্রশক্তির প্রধান কম্যান্ডার ডগলার ম্যাকার্থার সেনাবাহিনীকে আদেশ দেয় জাপানের উচ্চপদস্থ সামরিক নেতা ও রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করতে। জাপানের সামরিক নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ছিল হিডেকি তোজো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ও যুদ্ধের সময় জাপানের সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ন জেনারেল হিডেকি তোজো জাপানের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিল। জার্মানিতে নাজি যুদ্ধপরাধীদের নুরেমবার্গ ট্রায়ালের মাধ্যমে যেভাবে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল ঠিক সেভাবে বিচারের মাধ্যমে জাপানি যুদ্ধপরাধীদেরও শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। 

ভারত, আমেরিকা, ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স, চীন, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, ফিলিপিন্স, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড সহ এগারোটি দেশের বিচারকরা এই বিচার প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছিল। ১৯ জানুয়ারি, ১৯৪৬ সালে আন্তর্জাতিক বিচার সংস্থা গঠন করা হয়। নুরেমবার্গ ট্রায়ালের মতোই জাপানেও মানবতা বিরোধী, শান্তি বিরোধী ও যুদ্ধের নিয়ম বহির্ভূত অপরাধের জন্যই শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জাপানের টোকিও শহরের জাপনি যুদ্ধমন্ত্রকের বিল্ডিংএ এই বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই কারনে একে টোকিও ট্রায়াল বলা হয়। জাপানি যুদ্ধমন্ত্রকের এই বিল্ডিংএ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সমস্ত পরিকল্পনা করা হত। ১৯৪৬ সালের ৩ মে এই বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই বিচার প্রক্রিয়ায় আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য জাপানি যুদ্ধপরাধীদের একশোর বেশী আইনজীবি দেওয়া হয়েছিল এদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ জাপানি আইনজীবী ছিল এবং বাকী ২৫ শতাংশ আমেরিকান ছিল। ১৯২ দিন ধরে মিত্রশক্তির আইনজীবিরা জাপানি যুদ্ধপরাধীদের অপরাধের প্রমান দেয় আদালতে। এর বিরুদ্ধে ১৯৪৭ সালের ২৭ জানুয়ারি থেকে বিপক্ষ আইনজীবীরা ২২৫ দিন ধরে তাদের রিপোর্ট দেয় আদালতে। জাপানের পক্ষের আইনজীবীদের মূলত দুটো বক্তব্য ছিল প্রথমত মিত্রশক্তি যেসব অপরাধে জাপানি যুদ্ধপরাধীদের শাস্তি দোওয়ার কথা বলছে সেসব আইন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তৈরি হয়েছিল এবং দ্বিতীয়ত জাপানি সেনারা আত্মরক্ষার্থে যুদ্ধ করেছিল। পুরো বিচার প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশী নজর ছিল হিডেকি তোজোর বিরুদ্ধে। হিডেকি তোজো গ্রেফতারের আগে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। তোজো নিজের বুকে গুলি করেছিল কিন্তু তার মৃত্যু হয়নি। মিত্রশক্তির ডাক্তাররা তাকে বাঁচিয়ে নিয়েছিল। আদালতে দাঁড়িয়ে হিডেকি তোজো জানায় তারা যুদ্ধে যা করেছে তা সবই জাপানের সম্রাট হিরোহিটোর আদেশে। এই কথায় সমস্ত আদালত চত্বর নিশ্চুপ হয়ে যায় কারন এই কথার উত্তর কারো কাছে ছিলনা, বিচারকরাও ঘাবড়ে যায়। মজার ব্যাপার পুরো টোকিও ট্রায়ালে জাপানের সম্রাট হিরোহিটোকে ডাকাই হয়নি। কেন টোকিও ট্রায়ালে জাপানি সম্রাটকে ডাকা হলনা তা আজও বিতর্কিত বিষয়, কারন কোনও সাম্রাজ্যে সরকারি অফিসাররা সম্রাটের আদেশ ছাড়া কোনও কাজই করেনা। পরে অবশ্য হিডেকি তোজো তার বয়ান বদল করে জানায় সম্রাটের কোনও দোষ নেই যা অপরাধ করেছে তার জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। টোকিও ট্রায়ালের আরও একটি বড় বিতর্ক ছিল তা হল টোকিও ট্রায়ালে ইউনিট ৭৩১কে কেন ডাকা হয়নি। জপানি সেনাবাহিনীর বিশেষ একটি বিভাগ হচ্ছে এই ইউনিট ৭৩১ এখানে জাপানের ডাক্তাররা ছিল। জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যেসব অঞ্চল জিতছিলো সেখানকার বন্দীদের উপর নৃশংসভাবে অসংখ্য ডাক্তারি পরীক্ষা করে ইউনিট ৭৩১ যার বিরুদ্ধে প্রমানও ছিল মিত্রশক্তির কাছে কিন্তু তাসত্বেও তাদের বিরুদ্ধে কোনও বিচার হয়নি। বলা হয় মিত্রশক্তির শক্তিশালী দেশগুলোর ইউনিট ৭৩১ এর সদস্যদের সাথে তাদের ডাক্তারি পরীক্ষার ফলাফল ব্যাপারে সমস্ত তথ্য বিনিময়ের চুক্তি করেছিল যার জন্য তাদের বিরুদ্ধে কোনও বিচার হয়নি। অবশেষে দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার শেষে ৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭ সালে বিচারকরা তাদের সিদ্ধান্ত শোনায়। হিডেকি তোজো সহ সাতজন প্রধান অপরাধীকে ফাঁসির সাজা দেওয়া হয়। নুরেমবার্গ ট্রায়ালের শেষে যেমন আরও অনেকবার বিচার প্রক্রিয়া হয়েছিল ঠিক তেমনি টোকিও ট্রায়ালের শেষেও পুরো এশিয়া জুড়ে বিভিন্ন দেশে বিচার প্রক্রিয়া চলেছিল। ১৯৫১ সালে শেষ বিচার প্রক্রিয়া হয়েছিল। টোকিও ট্রয়াল নামে নেটফ্লিক্সে একটি সিনেমাও রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *