জানেনকী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বেশীরভাগ নাজি যুদ্ধপরাধীরা কোন দেশে পালিয়ে গিয়েছিল?
দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ হলে অনেক সময় যুদ্ধের শেষে পরাজিত দেশের গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তিরা, সেনাপ্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। সাধারনত এসব সেনাপ্রধানরা আশেপাশের দেশেই পালিয়ে যায়। যেমন কখনও ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ হলে পাকিস্তান পরাজিত হওয়ার পর পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিরা আশেপাশের দেশ যেমন চীন, আফগানিস্তান, ইরানে পালিয়ে যাবে কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে সম্পূর্ন বিপরীত ঘটনা ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি, জাপান পরাজিত হয় মিত্রশক্তির কাছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানির নাজি সেনা ব্রিটেন বাদে প্রায় সমস্ত ইউরোপ দখল করে নিয়েছিল। নাজি সেনা এইসময় পরাজিত দেশের নাগরিকদের উপর বিশেষ করে ইহুদিদের উপর যে নরাকীয় অত্যাচার করেছিল তা আজও মানুষ ভুলতে পারেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হার আসন্ন জেনে হিটলার আত্মহত্যা করে কিন্তু নাজি যুদ্ধাপরাধীরা মিত্রশক্তির হাত থেকে বাঁচতে জার্মানি ছেড়ে পালিয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল পূর্ব জার্মানির নিয়ন্ত্রন চলে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে এবং পশ্চিম জার্মানি আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রনে থাকে। এরকম পরিস্থিতিতে নাজি সেনাপ্রধানরা, হিটলারের একসময়ের সহযোগীরা জার্মানিতে থাকার ঝুঁকি নিতে চায়নি। কিন্ত বেশীরভাগ নাজিরা জার্মানির প্রতিবেশী দেশগুলো যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স, ইতালি, ব্রিটেন এসব দেশে যায়নি বরং তারা আটলান্টিক মহাসাগর অতিক্রম করে দক্ষিন আমেরিকার একটি দেশ আর্জেন্টিনা পালিয়ে যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ১৯৩৯ সালে কিন্তু তার বহু বছর আগে থেকেই ইউরোপ থেকে লোক আর্জেন্টিনা যাওয়া শুরু করেছিল। ভারত যেমন ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল একটা সময়, ঠিক তেমন আর্জেন্টিনা স্পেনের উপনিবেশ ছিল। সেজন্য স্পেনের সংস্কৃতির প্রভাবে স্পেন থেকে বহু মানুষ গিয়ে আর্জেন্টিনায় থাকা শুরু করেছিল। এছাড়া ইউরোপের আরও শক্তিশালী দেশ যেমন জার্মানি ও ইতালি থেকেও লোক গিয়ে আর্জেন্টিনায় থাকা শুরু করেছিল। এই তিনটি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল ছিল এই তিনটি দেশই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একই পক্ষে থেকে অক্ষশক্তি তৈরি করেছিল। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি, জাপান ও ইতালিই অক্ষশক্তিতে ছিল, সরকারি ভাবে স্পেন অক্ষশক্তিতে ছিলনা কিন্তু ইউরোপে সবাই জানতো স্পেন অক্ষশক্তিকে সমর্থন করে।
১৯৩৬ সাল থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে স্পেনে একটি গৃহযুদ্ধ হয় যেখানে একদিকে ছিল ন্যাশানালিস্টরা এবং আরেকদিকে ছিল রিপাবলিকানরা। এই গৃহযুদ্ধে ন্যাশনালিস্টদের নেতা ছিল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো। স্পেনের গৃহযুদ্ধে ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোকে সহায়তা করতে অ্যাডলফ হিটলার তার বায়ুসেনা পাঠিয়েছিল যার জন্য ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো জয়ী হয়। এজন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে স্পেন অক্ষশক্তিকে সমর্থন করতো। সেসময় আর্জেন্টিনার সাথে স্পেনের কুটনৈতিক সম্পর্ক ভালো থাকায় জার্মানি থেকে বহু মানুষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও আর্জেন্টিনা গিয়ে বসতি স্থাপন করে। সেজন্য আর্জেন্টিনাতে আজও একটি বড় জনসংখ্যা জার্মান বংশোদ্ভূত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইতালিতে আর্জেন্টিনার মিলিটারির প্রতিনিধি ছিল জুয়ান ডোমিঙ্গ পেরন। ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত ইতালিতে থাকা অবস্থায় জুয়ান পেরন বেনিটো মুসোলিনী ও তার ফ্যাসিবাদের উপর ব্যাপক প্রভাবিত ছিল। ১৯৪৪ সালে আর্জেন্টিনার সহকারী রাষ্ট্রপতি হয় জুয়ান পেরন এবং ১৯৪৬ সালে আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রপতি হয় জুয়ান পেরন। পুরো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আর্জেন্টিনা নিরপেক্ষ ছিল কিন্তু আমেরিকার চাপে যুদ্ধ শেষ হওয়ার একমাস আগে মিত্রশক্তিতে যোগদান করে আর্জেন্টিনা। কিন্তু জুয়ান পেরনের সাথে নাজি সেনার যোগাযোগ ছিল, জুয়ান পেরন নাজিদের আশ্বাস দিয়েছিল জার্মানি থেকে আর্জেন্টিনা নিয়ে আসার। ১৯৪৫ সালের মে মাসে জার্মানি আত্মসমর্পন করে এবং তারপরেই ইউররোপ জুড়ে নাজি কর্মকর্তাদের গ্রেফতারি শুরু হয়। এইসময় বহু নাজি কর্মকর্তা জার্মানি থেকে ফ্রান্স ও স্পেন পৌঁছায় এবং সেখান থেকে জাহাজে করে আটলান্টিক মহাসাগর পেরিয়ে আর্জেন্টিনা চলে যায়। নাজিদের জার্মানি থেকে আর্জেন্টিনা নিয়ে আসার জন্য অনেক ভিসা, নকল পরিচয়পত্র তৈরি করা হয়, এসব কিছুর দায়িত্বে ছিল জুয়ান পেরন। জার্মানি থেকে যেসব গোপন পথে নাজিরা আর্জেন্টিনা পৌঁছেছিল তাদের রেটলাইন বলা হয়। নাজিরা শুধু আর্জেন্টিনাই যায়নি বরং আরও দক্ষিন আমেরিকান দেশেও পালিয়ে গিয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন নাজি সেনাপ্রধানরা জার্মানি সহ পুরো ইউরোপ জুড়ে ইহুদি গনহত্যা চালায়। এসব ইহুদিদের পুরো সম্পত্তি নাজিদের কাছে ছিল। ১৯৪৪ সাল থেকেই নাজি কর্মকর্তারা বুঝে যায় যুদ্ধে তারা হারতে চলেছে। সেজন্য তারা তখন থেকেই সমস্ত সম্পত্তি সুইজারল্যান্ড সহ বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দিতে শুরু করে। আর্জেন্টিনা সরকার জানতো নাজিরা তাদের দেশে এলে প্রচুর সোনা, মূল্যবান ধাতু সহ সম্পত্তি নিয়ে আসবে সেজন্য জুয়ান পেরন নাজিদের দেশে স্বাগত জানায়। এছাড়া জুয়ান পেরনের ধারনা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে। সেজন্য জুয়ান পেরন শীর্ষস্থানীয় নাজি কর্মকর্তাদের আর্জেন্টিনায় আশ্রয় দেয় যাতে ভবিষ্যতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাজি কর্মকর্তাদের সাহায্যে আর্জেন্টিনা সুপার পাওয়ার হয়ে উঠতে পারে। শুধু আর্জেন্টিনা নয় আমেরিকা, ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়নও নাজি বিজ্ঞানীদের গোপন অপারেশনের মাধ্যমে তাদের দেশে নিয়ে যায় যাতে তাদের সাহায্যে অত্যাধুনিক অস্ত্র তৈরি করতে পারে, মহাকাশ গবেষনায় আরও উন্নতি করতে পারে।
আমেরিকা অপারেশন পেপারক্লিফ, ব্রিটেন অপারেশন সার্জনের মাধ্যমে নাজি বিজ্ঞানীদের দেশে নিয়ে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নও একাধিক অপারেশনের মাধ্যমে নাজি বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার ও ডাক্তারের দেশে নিয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর দক্ষিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর নাজিদের গ্রেফতার করে ইউরোপে আনা হয় বিচারের জন্য। এরকমই একজন কুখ্যাত নাজি কর্মকর্তা হচ্ছে অ্যাডলফ আইখম্যান। অ্যাডলফ হিটলারের সবচেয়ে কাছের ব্যক্তি অ্যাডলফ আইখম্যানের নেতৃত্বেই ইহুদিদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ১৯৬০ এর দশকে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ আর্জেন্টিনা থেকে আইখম্যানকে গ্রেফতার করে ইসরায়েল নিয়ে যায় এবং বিচারে তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। তবে বহু নাজি যুদ্ধপরাধী আর্জেন্টিনা সহ দক্ষিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশেই তাদের বাকী জীবন কাটিয়ে দেয়, তাদের কখনও গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।