ইসরায়েলের জামাই যেভাবে ইসরায়েলকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল
সময়টা ১৯৭৩ এর ৫ অক্টোবর, রাত একটার সময় কায়রো থেকে ইসরায়েলে তেল আভিবে মোসাদের হেড অফিসে ফোন আসে একটি। ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা ব্যাক্তিটি নিজেকে এঞ্জেল হিসাবে পরিচয় দেয়, যা ব্যাক্তিটির সাংকেতিক নাম ছিল। ফোনে এঞ্জেল একটি কথা বলেন রাসায়নিক, এই শব্দটা শুনেই চমকে যান মোসাদ ডিরেক্টর জুই জামির এবং তিনি তৎক্ষনাক তার সহকারী ফ্রেডি ইনিকে জানান, যত শীঘ্র সম্ভব তাকে লন্ডন যেতে হবে। জুই জামির বুঝে গিয়েছিলেন তাকে যত দ্রুত সম্ভব লন্ডনে পৌঁছাতে হবে। এই সাংকেতিক শব্দ রাসায়নিকের অর্থ ইসরায়েলের উপর খুব শীঘ্রই আক্রমন হতে চলেছে এবং এই ঘটনার পেছনে রয়েছে মিশর। কারন কিছুদিন আগেই ইসরায়েলের গোপন বন্ধু জর্ডানের রাজা হুসেন ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ারকে সিরিয়া ও মিশর দ্বারা ইসরায়েলে সম্ভাব্য আক্রমনের সংবাদ দেন। কিন্ত সেসময় গোল্ডা মেয়ার আসন্ন সাধারন নির্বাচনের প্রস্ততিতে ব্যস্ত ছিল তাই রাজা হুসেনের এই খবরকে এতটা গুরুত্ব দেননি। অ্যাঞ্জেলের ফোন পাওয়ার কিছু ঘন্টা পরেই লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা হন জুই জামির।
লন্ডনেই পৌঁছেই তিনি মোসাদের গোপন আস্তানায় ওঠেন, সেখানে আগে থেকেই মোসাদের দশ এজেন্ট মজুত ছিল। এদের মধ্যে একজন অ্যাডলফ হিটলারের সহকারী ইহুদি গনহত্যার কারিগর অ্যাডলফ আইখম্যানকে ধরতে সাহায্য করেছিল মোসাদকে। লন্ডনের সেই নির্দিষ্ট জায়গায় রাত এগারোটা থেকে একটা অবধি গোপন বৈঠক হয় এঞ্জেল ও জুই জামিরের। বৈঠক শেষে এই গুরুত্বপূর্ন সংবাদের জন্য অ্যাঞ্জেলকে এক লাখ ডলার দেয় মোসাদ। এরপরই মোসাদ হেডকোয়ার্টারে সংবাদ পাঠান জুই জামির এবং ফ্রেডি ইনিকে নির্দেশ দেন যত দ্রুত সম্ভব ইসরায়েলের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বদের সেখানে নিয়ে আসতে। কিছুক্ষনের মধ্যে সবাই উপস্থিত হলে জুই জামির জানান আগামী ইওম কিপুর দিবসের দিন সিরিয়া ও মিশরের সেনা ইসরায়েলে আক্রমনের পরিকল্পনা করেছে। ইওম কিপুর ইহুদিদের একটি পবিত্র উৎসব। এই দিন ইসরায়েলের সমস্ত সংবাদমাধ্যম, রেডিও বন্ধ থাকে, শত্রু সেই সুযোগেই ইসরায়েলে আক্রমন করার পরিকল্পনা করেছে৷ তবে জুই জামিরের এই সংবাদকে বিশ্বাস করেননি ইসরায়েল মিলিটারি ইনটেলিজেন্সের জেনারেল অ্যালি জারে সহ বেশ কিছু ব্যাক্তি। অ্যালি জারে জানান এর আগেও অ্যাঞ্জেল ইসরায়েলে আক্রমনের খবর দিয়েছিল যাতে পুরো সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল সীমান্তে কিন্তু আক্রমন হয়নি, যার কারনে প্রায় সাড়ে ৩৪ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল ইসরায়েলের। তবে শেষপর্যন্ত বৈঠকে ঠিক হয় অর্ধেক অতিরিক্ত সেনা সীমান্তে মোতায়েন করা হবে। ইওম কিপুর দিবসের সকালে ইসরায়েলে আক্রমন হতে পারে বলে জানিয়েছিল অ্যাঞ্জেল কিন্তু সকাল থেকে দুপুর হয়ে গেল তবুও ইসরায়েল সীমান্তে আক্রমনের কোন সম্ভবনা দেখা যায়নি। জেনারল অ্যালি জারে ভেবে নিয়েছিল এবারেও হয়ত খবর ভুল আছে কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যেই হঠাৎ ইসরায়েলে যুদ্ধকালীন সাইরেন বেজে ওঠে এবং আকাশে ইসরায়েল বায়ুসেনার যুদ্ধবিমানের যাতায়াত শুরু হয়ে যায়। ইওম কিপুর যুদ্ধ ৬ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর, ১৯৭৩ অবধি চলে।
আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে এটা চতুর্থ যুদ্ধ ছিল। মূলত সুয়েজ খালের পূর্ব দিলে, গোলান হাইটস এবং সিনাই পেনিনসুলা অঞ্চলে এই যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধে ইসরায়েল বিজয়ী হয় তবে ইসরায়েলের প্রায় ২৮০০ জন সেনা শহীদ হয় এবং ৮,৮০০ সেনা আহত হয়। অন্যদিকে বিপক্ষের প্রায় ১৯,০০০ সেনা নিহত হয়, প্রায় ৮,৭৮৩ সেনা গ্রেফতার হয় ইসরায়েলের হাতে এবং ৩৫,০০০ সেনা আহত হয়। এই যুদ্ধে ইসরায়েলের প্রায় ৪০০ ট্যাঙ্ক, ৪০৭ আর্মড ভ্যেইকল এবং প্রায় ৩৮৭ টি বিমান ধ্বংস হয়ে যায় অন্যদিকে বিপক্ষের ২৩০০ ট্যাঙ্ক, ৫১৪ বিমান এবং ১৯ টি জাহাজ ধ্বংস হয়ে যায়। এই যুদ্ধে ইসরায়েলের বিজয় হলেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারনে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এবং জুই জামিরের দেওয়া তথ্য সঠিকভাবে না মানার কারনে জেনারেল অ্যালি জারে সহ বেশ কয়েকজনকে জবাবদিহি করতে হয়। কিন্তু রহস্যময় এজেন্ট এঞ্জেল কে!! তার খবরের উৎস কী ছিল?
সালটা ১৯৬৫, মোনা নামে এক মিশরীয় সুন্দরী মহিলার সাথে পরিচয় হয় আশরাফ মারওয়ান নামে মিশরীয় সেনাবাহিনীর এক উচ্চপদস্থ অফিসারের। খুব শীঘ্রই উভয়ে প্রনয়ে আবদ্ধ হন। এই মোনা হচ্ছে মিশরীয় রাষ্ট্রপতি গামাল আবদেল নাসেরের মেয়ে। কিছুদিনের মধ্যেই উভয়ের বিয়েও হয়। ১৯৬৮ সালে আশরাফ মারওয়ানকে উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডনে পাঠায়। সেখানে গিয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে আশরাফ। সেখানে তার সাথে সম্পর্ক তৈরি হয় এক ধনী কুয়েতি ব্যাবসায়ীর স্ত্রী সাথে। এই খবর জানতে পেরে গামাল আবদেল নাসের আশরাফকে মিশরে ফিরিয়ে আনে। আশরাফকে শুধু গবেষনার কাগজ জমা দেবার জন্যই লন্ডনে যাবার অনুমতি দেওয়া হয়। ১৯৬৯ সালে আবারও লন্ডন আসে আশরাফ শুধু পড়ার জন্য। এইবার তার অপমানের বদলা নেবার জন্য আশরাফ সোজা ইসরায়েলি দূতাবাসে ফোন করে নিজের পরিচয় জানায় এবং ইসরায়েলের হয়ে কাজ করার কথা বলে। মোসাদ খুব ভালো করেই জানতো মিশরে আশরাফের ক্ষমতা কতটা যার কারনে মোসাদ সাথে সাথে রাজি হয়ে যায়। কিছুদিন পর মোসাদের সাথে আশরাফের বৈঠক হয়, আশরাফ তার এক একটি তথ্যের জন্য এক লাখ ডলার করে দাবি করে। তবে মোসাদ প্রথমে সন্দেহ করছিলো আশরাফ হয়ত ডবল এজেন্ট হতে পারে কিন্তু আশরাফ জানায় সে খুব শীঘ্রই ইসরায়েলের জন্য গুরুত্বপূর্ন খবর দেবে। এর কিছুদিন পরেই ১৯৭০ সালের ২২ জানুয়ারি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মিশরের মধ্যে হওয়া অস্ত্র চুক্তির ব্যাপারে যাবতীয় তথ্য দেয়।
মোসাদ বুঝতে পারে আশরাফ তাদের একজন সঠিক এজেন্ট। ১৯৭০ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর গামাল আবদেল নাসেরের মৃত্যুর পর মিশরের নতুন রাষ্ট্রপতি হয় আনোয়ার সাদাত, যাকে মিশরের দুর্বল রাষ্ট্রপ্রধান বলা হয়। এই সময় আশরাফ মারওয়ানি আনোয়ার সাদাতের চোখে ভালো হবার চেষ্টা শুরু করে। আনোয়ার সাদাতের বিরুদ্ধে বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতা দলবদ্ধ হয় এবং আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে হত্যারও চেষ্টা করা হয় কিন্তু আশরাফের চেষ্টায় প্রানে বেঁচে যায় আনোয়ার সাদাত। এরপর আনোয়ার সাদাতের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি হয় আশরাফ মারোয়ানির এবং তাকে রাষ্ট্রপতির সেক্রেটারি করে দেওয়া হয়।
আশরাফ রাষ্ট্রপতির সাথে বেশ কয়েকবার মস্কো যায় সেখানে মিশরের জন্য অস্ত্র চুক্তিতে উপস্থিত থাকে সে, মিগ ২৫ যুদ্ধবিমান কেনবার কথাও হয়। এইসব তথ্যই আশরাফ মোসাদকে বিস্তারিত ভাবে পাঠাতে থাকে। আশরাফ শুধু মোসাদ না ইটালির গুপ্তচর সংস্থা এবং ব্রিটেনের গুপ্তচর সংস্থা এমআই ৬ কেও তথ্য সরবরাহ করতো। এরই মধ্যে আশরাফ মোসাদকে জানায় লিবিয়ার রাষ্ট্রপতি গদাফফি প্যালেস্তাইন সন্ত্রাসীদের সাহায্য করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে মিশরও সাহায্য করবে। পরিকল্পনা করা হয়েছে ইটালির বিমানবন্দর থেকে একটি বিমানে বিস্ফোরক নিয়ে ইসরায়েলের কোন বড় শহরে আক্রমন করা হবে। এরজন্য মিশর আশরাফকে দুটি মিসাইল দেয় সন্ত্রাসীদের পৌঁছে দিতে। আশরাফ মিসাইল পৌঁছে দিয়েই সমস্ত তথ্য মোসাদ ও ইটালিকে জানায়। সাথে সাথে ইটালি বিশেষ কম্যান্ডো বাহিনী নির্দিষ্ট জায়গায় অভিযান করে মিসাইল বাজেয়াপ্ত করে এবং সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করে। এভাবে মোসাদকে বারবার সাহায্য করতে থাকে আশরাফ।
মোসাদের হয়ে কাজ করবার পাশাপাশি আশরাফ নিজের ব্যাবসায়িক ক্যারিয়ার তৈরি করারা চেষ্টা করে যাতে সে সফলও হয়।
১৯৮১ সালে মিশরের রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাতের হত্যার পর আশরাফ মিশর ছেড়ে লন্ডনে চলে আসে এবং পুরোদস্তুর সফল ব্যবসায়ী হয়ে যায়। আশরাফ মোসাদকে জানিয়ে দেয় তার অবসরের কথা। ২০০২ সালে ইসরায়েলি লেখক অ্যারন ব্রাগম্যান দি হিস্ট্রি অফ ইসরায়েল বই লেখে, যেখানে ইওম কিপুর যুদ্ধের কথা উল্লেখ করা হয়। এই বইয়ে তিনি একজন গুপ্তচরের কথা উল্লেখ করেন যার নাম দেন দি সন ইন ল যা স্পষ্ট প্রাক্তন মিশরীয় রাষ্ট্রপতি গামাল আবদেল নাসেরের জামাই আশরাফ মারওয়ানির দিকে ইঙ্গিত করছিল। এর পর আশরাফ মারওয়ানির সাথে বিবাদ হয় অ্যারন ব্রাগম্যানের। সমস্ত মিডিয়ায় চলে আসে আশরাফ মারওয়ানির নাম। জুন, ২০০৭ সালে ইসরায়েলের কোর্ট স্বীকার করে নেয় আশরাফ মারওয়ানিকে ইসরায়েলের গুপ্তচর হিসাবে স্বীকার করে নেয়। এই ঘটনার দুই সপ্তাহ পরেই আশরাফ মারওয়ানির মৃত্যু হয়, মিশরের গুপ্তচর সংস্থা এর জন্য দায়ী ছিল বলে মনে করা হয়।