অফবিট

মধ্যযুগের মানুষ কেন চাইত তাদের গেঁটেবাত রোগ হোক?

কোন মানুষই অকারনে অসুখ চায় না। কারণ অসুস্থ মানেই বিশ্রাম, সকল ইচ্ছামূলক কাজের থেকে বিরতি এবং এক ঝাঁক ওষুধের পালা শুরু। তাই সুস্থ থেকে নিজের মনের মত কাজ করার মজাটাই আলাদা। তবে মধ্যযুগের ইউরোপে এমন এক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল যে রোগ চাইতো সকল সাধারন মানুষ। অর্থাৎ এক কথায় বলতে গেলে সাধারণ অসুস্থ মানুষ রোগের থেকে পালানোর চেষ্টা করে অথচ তখনকার দিনের রোগকে নিজেদের কাছে রাখতো বেশ কয়েকজন মানুষ। কারণ শুনলে অবাক হয়ে যাবে সকলে। সেই রোগটির নাম হল গেঁটেবাত। তখনকার দিনে মনে করা হতো যাদের এই রোগ হয়েছে তারা রাজকীয় ব্যক্তি। তাহলে একটু পরিষ্কার করেই খুলে বলা যাক।

মধ্যযুগের ইউরোপে গেঁটেবাত রোগটি একটি ঐতিহ্যবাহী  ও সম্ভ্রান্ত রোগে পরিণত হয়েছিল। ফ্রান্সের ভার্সাই শহরের অনেক মানুষ এই রোগ হওয়ার ভান করত। কারণ তখনকার দিনে যে ব্যক্তির এই রোগ হতো তাকে রাজকীয় ভাবে অন্য দৃষ্টিতে দেখা হতো। কারণ গেঁটেবাত মূলত সেই সব ব্যক্তিদের হতো যারা অত্যাধিক চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ করে এবং অত্যাধিক জল খায়। সে ক্ষেত্রে অত্যাধিক চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়ার ক্ষমতা ছিল একমাত্র ধনী ব্যক্তিদের। এমনকি অনেক ধনী ব্যক্তিও এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বিশেষ করে রাজা অষ্টম হেনরি গেঁটেবাত রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকেই এই রোগের গুরুত্ব অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল।

** এবার সকলের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে গেঁটেবাত রোগ আসলে হয় কেন!

বিশেষত পুরুষদের ক্ষেত্রে ৩০ বছর হয়ে গেলে এবং বৃদ্ধ বয়স্ক মহিলা ও পুরুষের ক্ষেত্রে এই রোগ বেশি দেখা যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে মহিলাদের থেকে পুরুষদের শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেশি থাকে। তাই এই রোগ পুরুষদেরই বেশি দেখা যায়। এছাড়াও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি কোন ব্যক্তির দেহের চর্বি বৃদ্ধি হতে থাকে তাহলে তার শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে যাবে। আর তখনই এই গেঁটেবাতের রোগ দেখা দেবে। তবে এক থেকে দুই শতাংশ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়। আক্রান্তকারীদের মধ্যে পাঁচ গুণ বেশি থাকে পুরুষ। তবে শুধুমাত্র যে বয়স্ক মহিলা এবং পুরুষদের ক্ষেত্রেই হবে সেটা নয়। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রজাতি ভিত্তিকও এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এথনিক গ্রুপ যেমন মাউরি উপজাতি ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপের জনগোষ্ঠী এদের রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেশি থাকে। তাদের বলা হয় হাইপারইউরিসেমিয়া। এটা আঞ্চলিক ভিত্তিক ক্ষেত্রে মাঝে মধ্যে দেখা যায়। চিকিৎসকের ভাষায় বলতে গেলে একজন পুরুষের ক্ষেত্রে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা থাকে  ২.০-৭.০ mg/dL ও মহিলাদের ক্ষেত্রে থাকে ২.০-৬.০ mg/dL।

** গেঁটেবাত সম্বন্ধে কি লেখা রয়েছে ইতিহাসে!

বর্তমান দিনে বাতের অনেক ওষুধ এবং চিকিৎসা বেরোলেও আগেকার দিনের চিকিৎসকেরা নানান উৎকট পন্থা অবলম্বন করতেন। কারণ আগেকার দিনে মনে করা হতো অধিক ভোজনশীল ব্যক্তি এবং ধনী ব্যক্তিদের এই রোগ হয়। সেক্ষেত্রে ১৫৭৮ সালে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা পত্রে বিজ্ঞানী লরেঞ্জ ফ্রাইস জানিয়েছিলেন যে কোন ব্যক্তি বাতের রোগে আক্রান্ত হলে তাকে কাঁটা বিড়াল ছানাকে শুকরের চর্বি মাখিয়ে আটায় মেখে ভেজে খাওয়ালে রোগ নিরাময় হবে। শুধুমাত্র খাওয়া নয় পাশাপাশি জয়েন্ট অর্থাৎ ব্যথা জায়গাতেও লাগাতে হবে।

অবাক করা বিষয় হল যারা এই রোগে আক্রান্ত হতেন তারা নিরাময় কামনা করতেন এবং যারা সুস্থ ছিলেন তারা এই রোগ আসার কামনা করতেন। কারণ সেই সময় অনেকে মনে করতেন যে গেঁটেবাত হলে অন্যান্য রোগ ধারে কাছেও আসবেনা। এছাড়াও একজন ইংরেজ লেখক হোরেস ওয়ালপোলের অষ্টাদশ শতাব্দীতে একটি বই লিখেছিলেন। যেখানে তিনি উল্লেখ করেছিলেন মানুষের জ্বর, পক্ষাঘাত এবং অ্যাপোলেক্সি এর মত রোগ রোধ করতে পারে শুধুমাত্র গেঁটেবাত। সেক্ষেত্রে একটা রোগ যদি মানুষের হয় তাহলে ক্ষতি কি! এই রোগ মানুষকে দীর্ঘায়িত করতে সাহায্য করে। এছাড়াও তখনকার সময় ধনী ব্যক্তিরা শুধুমাত্র বাতের রোগে আক্রান্ত হতেন। তাই ইউরোপীয় ব্যক্তিরা এইটা বিশ্বাস করে নিয়েছিলেন যে গেঁটেবাত হলে অন্যান্য রোগ হয় না। আবার অনেকে ধারণা জন্মেছিল বাত হলে শরীরের শক্তি এবং যৌন চাহিদা বৃদ্ধি পায়।

মূলত ১৬ থেকে ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময় অর্থাৎ ১৫৮৮ সালে মিশেল ডি মন্টেইগনে নামে একজন লেখক তার লেখায় উল্লেখ করেছিলেন যে ” যখন কোন ব্যক্তির পা ফুলে যায় এবং ব্যথা করে তখন সেই ব্যক্তির যৌন অঙ্গগুলির শক্তি বৃদ্ধি পায়”। এই গেটে বাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন  একজন লেখক তথা বিজ্ঞানী ও রাজনৈতিকবিদ বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন, সপ্তম হেনরি ও অষ্টম হেনরি।

ইতিহাসের পাতা উল্টালে জানা যায় যে রাজা অষ্টম হেনরি নিজের উত্তরাধিকারী পাওয়ার জন্য বহু স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ করেছিলেন। তবে তিনি ইতিহাসে পরিচিত রয়েছেন গেঁটেবাতে আক্রান্তের জন্য। তিনি এক সময় ষোড়শ শতাব্দীতে ক্যাথলিক চার্চ ত্যাগ করেছিলেন। শুধুমাত্র রাজা হেনরি নয় ফ্লোরেন্সের মেডিসি রাজাও এই বাতের রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তার অবস্থা এতটাই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল যে সকলে তাকে “পিয়েরো দ্য গাউটি” বলে ডাকতেন।

তবে বলতে গেলে গেঁটেবাত শুধুমাত্র অভিজাতদের হবে সেরকম কোন কথা ছিল না। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিংও এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি এতটাই পিড়িত ছিলেন যে ১৭৮০ সালে তিনি নিজেই স্ত্রীকে একটি চিঠিতে জানিয়েছিলেন “কোন পাপের ফলে আজকে তাকে এই দুর্দশা ভোগ করতে হচ্ছে! “

** গেঁটে বাতের রোগের চিকিৎসা এবং প্রতিরোধক কি ছিল!

এই রোগ কমাতে গেলে প্রথমে ওজন কমাতে হবে। তবে সেটা অবশ্য খাওয়া-দাওয়া ত্যাগ করে নয়। চর্বি এবং পিউরিন ছাড়া খাবার খেতে হবে। যে খাওয়ার গুলি খেতে নিষেধ করা হত যেমন- বিভিন্ন ধরনের ডাল বিশেষ করে মসুর ডাল ও মটর ডাল। শিম, শিমের বিচি, বরবটি, মটরশুঁটি , কড়াইশুঁটি, পুঁইশাক, পালংশাক, অ্যাসপ্যারাগাস, ফুলকপি, মাশরুম, কচু, ইস্ট, লাল মাংস যেমন গরু, খাসি, ভেড়া, হরিণ, সব ধরনের হাঁসের মাংস যেমন- রাজহাঁস, জংলি হাঁস ও পাতিহাঁস; গরু ও খরগোসের মাংস, বড় পাখির বা তুর্কি মোরগের মাংস, কবুতর ও তিতির পাখির মাংস। মগজ, কলিজা, বৃক্ক, যকৃৎ, অগ্ন্যাশয়, জিহ্বা, বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ ও মাছের ডিম, সামুদ্রিক খাবার, কাঁকড়া, চিংড়ি, শামুক ইত্যাদি।

উপরিউক্ত খাবারগুলি খেলে যে কোন মানুষের শরীরে ১ mg/dL ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধি পাবে। সেক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে খাবারের প্রতি সংযমী হওয়ার প্রয়োজন নেই। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের সবুজ শাকসবজি এবং ভিটামিন সি যুক্ত খাবার খেতে হবে। ভিটামিন সি এর খাবারের তালিকায় রয়েছে – পেয়ারা, বাতাবী লেবু, কামরাঙা, কমলা, আমড়া, বাঁধাকপি, টমেটো, আনারস, কাঁচা মরিচ, আমলকী, তাজা শাকসবজি ইত্যাদি। এছাড়াও বিভিন্ন দুগ্ধজাত খাবার যেমন – দুধ ,ঘি, মাখন, পনির, লেটুস, পাস্তা, সাগু, ময়দা ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। এছাড়া প্রতিদিন দু লিটার কিংবা তার অধিক জল খেতে হবে কারণ যত জল খাওয়া যাবে তত প্রস্রাব হবে এবং তার মধ্যে দিয়ে ইউরিক অ্যাসিড নির্গত হবে। এছাড়াও অতিরিক্ত জল খাওয়ার কারণে ইউরিনারি ট্রাক্টে ইউরেট জমে পেটে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। অন্যদিকে যেসব ওষুধ ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বৃদ্ধি করে যেমন থিয়াজাইড ডাইউরেটিকস্, অ্যাসপিরিন, নিয়াসিন ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে হবে।

আবার যদি চিকিৎসা ক্ষেত্রে অর্থাৎ মেডিসিনের কথা বলা হয় তাহলে NSAID যেমন ন্যাপ্রক্সেন, আইবুপ্রফেন,ইনডোমেথাসিন খুবই কার্যকর। এছাড়াও ব্যাথা জায়গায় বরফ লাগালে কিছুটা উপশম পাওয়া যায়। কোলচিসিন একটি কার্যকরী ঔষধ তবে এটি বমি ও ডায়রিয়া করতে পারে। কর্টিকোস্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ রোগের তীব্রতা কমাতে খুব ফলপ্রসূ। সেক্ষেত্রে ইনজেকশন প্রয়োগ করলে বেশি উপকার হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *