অফবিট

যে গোয়েন্দাকে দুই দেশ বিশেষ সম্মান দিয়েছিল

সালটা ১৯৫৬, লুসিয়া বার্নোস্কি নামে এক মহিলা ভিক্টর নামে এক সাংবাদিকের সাথে প্রনয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। লুসিয়া বার্নোস্কি কোন সাধারন মহিলা নন, তিনি তৎকালীন কমিউনিস্ট পোল্যান্ডের সহকারী প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী। বিবাহিত জীবনে উভয়ের মধ্যে প্রায়ই সমস্যা লেগে থাকায় লুসিয়া ভিক্টরের সাথে প্রনয়ে আবদ্ধ হন। পোল্যান্ডের কমিউনিস্ট দলের সহকারী জেনারেল এডওয়ার্ড ওকাবের প্রধান সহকারী ছিল লুসিয়া। পোলিশ কমিউনিস্ট দলের সংবাদ মাধ্যমে কাজ করত ভিক্টর গ্রেভেস্কি যার প্রধান কাজ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপ সম্পর্কে খোঁজ রাখা। ভিক্টর একজন ইহুদি ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি যখন পোল্যান্ডে আক্রমন করে তখন প্রান বাঁচাতে ভিক্টরের পরিবার রাশিয়া চলে যায়। কারন জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদী গনহত্যা করছিল। গ্যাস চেম্বার তৈরি করে সেখানে ইহুদীদের হত্যা করত জার্মানি। ইতিহাসে এই নৃশংস ঘটনা হলোকাস্ট নামে কুখ্যাত। কয়েকবছর পর পরিস্থিতি শান্ত হলে ভিক্টরের পরিবার পোল্যান্ডে ফিরে আসে।

১৯৪৯ সালে ভিক্টরের বাবা মা ও বোন ইসরায়েল চলে যায় কিন্তু ভিক্টর পোল্যান্ডেই থেকে যায়। ভিক্টর প্রথমে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপতি জোসেফ স্তালিনের ভক্ত ছিল। কিন্তু কমিউনিজমের সব বিচার ধারার সাথে সম্মত ছিলনা সে। 

১৯৫৫ সালে ইসরায়েলে যায় ভিক্টর পরিবারের সাথে দেখা করতে তখন থেকেই তার মতাদর্শ পরিবর্তন হতে শুরু করে কারন এমন অনেক জিনিস পোল্যান্ডে ছিলনা যা ইসরায়েলে ছিল। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শীতল যুদ্ধ শুরু হয় যাতে গোটা বিশ্ব দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট বিচারধারা ছড়িয়ে পড়ে, অন্যদিকে পশ্চিম ইউরোপে আমেরিকার গনতন্ত্র প্রভাব বিস্তার করে। পোল্যান্ডের গনতান্ত্রিক পরিবেশ, মনের ভাব প্রকাশের পূর্ন স্বাধীনতা, অর্থায়ন ব্যবস্থায় ব্যাপক প্রভাবিত হয় ভিক্টর। সোভিয়েত ইউনিয়নের ফিরে যাবার আগে ভিক্টর মনস্থির করে ফেলে কিছু বছরের মধ্যেই সে ইসরায়েলে ফিরে আসবে। 

১৯৫৬ সালে একদিন ভিক্টর তার প্রেমিকা লুসিয়ার সাথে দেখা করতে তার অফিসে যায় সেখানে তার চোখে আসে একটি ফাইল যার উপর গোপনীয় লেখা আছে। ভিক্টর সে ব্যাপারে লুসিয়াকে জিজ্ঞেস করলে লুসিয়া জানায় এই ফাইলে সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট দলের অন্যতম সদস্য নিকতা ক্রুশ্চেভের কথা আছে।

আমেরিকার ইনটেলিজেন্স সংস্থা সিআইএ এই ফাইলটা পাবার জন্য কত চেষ্টা করছিল কিন্তু সেই ফাইলই কাকতালীয় ভাবে ভিক্টরের সামনে পড়েছিল। ভিক্টরকে লুসিয়া এতটাই বিশ্বাস করত যে সেই ফাইলের তথ্য পর্যন্ত সে ভিক্টরকে দিয়ে দেয়। ফাইলটিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট দলের সেক্রেটারি জেনারেল নিকিতা ক্রুশ্চেভের জোসেভ স্তালিন সম্পর্কে বক্তব্য ছিল। ২৫ ফেব্রুয়ারী গভীর রাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৪০০ বিশেষ প্রতিনিধির সামনে নিকিতা ক্রুশ্চেভের একটি বক্তৃতা দেবার কথা ছিল যাতে জোসেফ স্তালিনের নৃশংস কার্যকালাপ সম্পর্কে তাদের জানানো হত। এই সভা এতটাই গোপনীয় ছিল যে পুরো হোটেল সভার জন্য খালি করে দেওয়া হয়েছিল। নির্ধারিত দিনে চার ঘন্টা নিকিতা ক্রুশ্চেভ জোসেফ স্তালিনের ব্যাপারে বক্তৃতা দিয়েছিল এই সভায়। জোসেফ স্তালিন অ্যাডলফ হিটলারের থেকে কোন অংশে কম ছিলনা। ডিক্টেটর জোসেফ স্তালিনের কারনে কয়েক লক্ষ্য সোভিয়েত মানুষের মৃত্যু হয়েছিল অনাহারে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা ভ্লাদিমির লেনিন নিজেও জোসেফ স্তালিনকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতায় বসাতে চাইছিল না, কিন্তু ভ্লাদিমির লেলিনের মৃত্যুর পর সুকৌশলে জোসেফ স্তালিন ক্ষমতায় আসে। নিকিতা ক্রুশ্চেভের বক্তৃতা শুনে বহু লোকই কেঁদে ফেলে, কারও কারও হার্ট অ্যাটাক পর্যন্ত হয়ে যায়। এমনকী বক্তৃতা শেষ হতে হতে দুজন লোক আত্মহত্যা করে ফেলে। ওই বক্তৃতায় নিকিতা ক্রুশ্চেভ জানায় ১৯৩৬ ও ১৯৩৭ সালে জোসেফ স্তালিন ১৫ লাখ সোভিয়েত নাগরিককে গ্রেফতার করায় যার মধ্যে প্রায় সাত লাখকে হত্যা করা হয়। কমিউনিস্ট দলের ১৯৬৬ সদস্যের মধ্যে ৮৪৮ জনকেই হত্যা করে স্তালিন। এমনকী কমিউনিস্ট দলের কেন্দ্রীয় দলের ১৩৮ জনের মধ্যে ৯৮ জনকেই হত্যা করা হয়। নিকিতা ক্রুশ্চেভের এই বক্তৃতা অত্যান্ত গোপন রাখা হয় কারন এই কথা প্রকাশ্যে এলে সোভিয়েত ইউনিয়নে বিদ্রোহ শুরু হয়ে যেত।

লুসিয়া ভিক্টরকে ওই ফাইল পড়তে দিয়েছিল এবং জানিয়েছিল বিকেল চারটের আগে ফাইল পৌঁছে দিতে। পুরো ফাইল পড়ার পর ভিক্টর গোপনে স্থানীয় ইসরায়েল দূতাবাসে যায় এবং সেখানে ফাইলের একটি ফটোকপি দিয়ে এসে বিকেল চারটের আগেই লুসিয়াকে ফাইল পৌঁছে দিয়ে আসে। কেউ জানতেও পারেনি ভিক্টর ইসরায়েল দূতাবাসে গিয়েছিল। ১৩ এপ্রিল ইারায়েল দূতাবাস সেই ফাইলের ফটোকপি ইসরায়েলের ইনটেলিজেন্স সংস্থা শাবাকের কাছে পৌঁছে দেয়। শাবাক প্রধান আমোস সেই ফাইল পড়ে সাথেসাথে নিজেই ফাইল নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বেন গ্যারনের কাছে যায়। বেন গ্যারন এবং আমোস দুজনেই রাশিয়ান ভাষা জানতো যার কারনে ফাইল পড়তে কোনো অসুবিধা হয়নি। বেন গ্যারন চিন্তা করে এই ফাইল জনসমক্ষে এলে সোভিয়েত ইউনিয়নে বিদ্রোহ হবে এবং কমিউনিজমের পতন হয়ে গনতন্ত্রের উদয় হবে তাই তিনি এই ফাইল ইসরায়েলের আরেক ইটেলিজেন্স সংস্থা মোসাদের প্রধান ইসার হ্যারেলকে দেয়। ইসরায়েলের আভ্যন্তরীন নিরাপত্তার ব্যাপার দেখে শাবাক এবং বাইরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকে মোসাদ। ইসার হ্যারেল জানত আমেরিকার সিআইএ এই ফাইলটা খুব করে খুঁজছিল, সিআইএ এই ফাইল খুঁজে বের করার জন্য এক মিলিয়ন ডলার পুরস্কারও ঘোষনা করেছিল। মোসাদ এই ফাইল ওয়াশিংটনে সিআইএর ডিরেক্টর অ্যালেন ডুলাসকে পাঠায় এবং অ্যালেন ডুলাস সাথে সাথে সেই ফাইল রাষ্ট্রপতি আইসেনআওয়ারকে দেয়। এই ফাইল দেখে সিআইএ সহ আমেরিকার রাষ্ট্রপতি আইসেনআওয়ার পর্যন্ত অবাক হয়ে যায় কারন যে ফাইলের জন্য আমেরিকার ইনটেলিজেন্স সংস্থা সিআইএ সহ ব্রিটেন ও ফ্রান্সের ইনটেলিজেন্স সংস্থা পর্যন্ত খুঁজে পায়নি সেই ফাইল নতুন গঠিত একটি দেশ ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ কী করে পেল। 

সিআইএ নিউইয়র্ক টাইমসের সাথে ১৯৫৬ সালের ৫ জুন এই তথ্য প্রকাশ করে। এই তথ্য প্রকাশ পেতেই কমিউনিস্ট বিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পায় সব দেশে। বলা হয় পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত কমিউনিস্ট দলের পরাজয়ের পেছনেও এই খবরই দায়ী। এই ঘটনার পর সিআইএ এর সাথে মোসাদের একটি সুসম্পর্ক তৈরি হয়। ভিক্টর গ্রেভেস্কি যে এই ফাইল ইসরায়েলীয় দূতাবাসে পৌঁছে দিয়েছিল তা সম্পূর্ন গোপন করে গিয়েছিল মোসাদ। এই ঘটনার একবছর পর ভিক্টর গ্রেভেস্কি ইসরায়েল চলে যায় পুরোপুরি ভাবে এবং ইসরায়েলের বিদেশ মন্ত্রকে তার চাকরির ব্যাবস্থা করে দেয় মোসাদ। কিছুদিন পর ভিক্টর গ্রেভেস্কির সাথে কিছু সোভিয়েত কুটনীতিবিদের পরিচয় হয় তারা ভিক্টরকে সোভিয়েত ইউনিয়নের গুপ্তচর সংস্থা কেজিবির এজেন্ট হবার প্রস্তাব দেয়। কারন তারা জানত ভিক্টর বহু বছর পোল্যান্ডে ছিল এবং কমিউনিস্ট চিন্তাভাবনা বিশ্বাসী ছিল।

Nikita Sergeyevich Khrushchev

ভিক্টর কিছুদিন সময় চায় এবং সম্পূর্ন তথ্য মোসাদকে জানায়। মোসাদ সাথে সাথে তাকে ডবল এজেন্ট হবার নির্দেশ দেয়। অর্থাৎ ভিক্টর গ্রেভেস্কি মোসাদের মিথ্যা খবর কেজিবিকে দেবে যাতে কেজিবির গোপন তথ্য মোসাদ জানতে পারে। এভাবে বহু বছর কেজিবিকে বোকা বানায় ভিক্টর গ্রেভেস্কি। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিন্দুমাত্র বুঝতে পারেনি ভিক্টরের ডবল এজেন্ট হবার ঘঠনা। তবে ১৯৬০ এর দশকে কেজিবিকে একটি সত্যি খবর দেয় ভিক্টর কিন্তু কেজিবি তা বিশ্বাস করেনি।

১৯৬০ এর দশকে ছয়দিনের যুদ্ধে মিশরের রাষ্ট্রপতি গামাল নাসির সিনাইয়ে তার সেনাবাহিনী মোতায়েন করে কারন তার ধারনা ছিল ইসরায়েল সিরিয়ায় আক্রমন করবে। মোসাদ ভিক্টরের মাধ্যমে কেজিবিকে খবর পাঠায় তাদের এরকম কোন ইচ্ছে নেই, যদি মিশর সেনাবাহিনী না সরায় তাহলে ইসরায়েল মিশরে আক্রমন করবে। কেজিবি ভিক্টরের কথা বিশ্বাস করেনি। মিশরে সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যাপক প্রভাব ছিল। এরপর যা হয় ইতিহাস, মিশর ইসরায়েলের কাছ পরাজিত হয় এবং ছয় দিনের যুদ্ধে জয় লাভ করে। কেজিবি এরপর এক জঙ্গলে ভিক্টরের সাথে দেখা করে তাকে লেনিন মেডেল দেয় এবং তার কথায় অবিশ্বাস করার জন্য ক্ষমাও চায়। কেজিবি ভিক্টরকে মস্কোতে স্থায়ী ভাবে বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য অফার দেয় কিন্তু ভিক্টর গ্রেভেস্কি ইসরায়েলেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭১ সালে এই গুপ্তচর জগত থেকে অবসর নয়ে ভিক্টর গ্রেভেস্কি। ২০০৭ সালে মোসাদ ভিক্টর গ্রেভেস্কিকে ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ন সম্মান দেয় তার অবদানের জন্য। ভিক্টর গ্রেভেস্কি গুপ্তচর দুনিয়ার ইতিহাসে এমন এক ডবল এজেন্ট যাকে দুই দেশই সম্মানে ভূষিত করেছিল। ২০০৭ সালের ১৮ অক্টোবর ৮২ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *