অফবিট

মঙ্গলে বসতি স্থাপনের প্রোজেক্ট সফল করতে কি করা হচ্ছে?

সভ্যতার আদিকাল থেকেই মহাকাশ মানুষের কাছে চির রহস্যময়। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে মহাকাশ অভিযানের চিন্তাভাবনা শুরু হয়। আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নই ছিল এইসব অভিযানের নেতৃত্বে। মানব ইতিহাসে বিগত পঞ্চাশ বছরে বিজ্ঞানের সর্বাধিক উন্নতি হয়েছে, সাথে পাল্লা দিয়ে শক্তিশালী দেশ গুলোর মহাকাশ অভিযানের আগ্রহ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আমেরিকা, রাশিয়া, ভারত, চীন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ইসরায়েল সহ বিশ্বের প্রথম সারির একাধিক দেশ আজ ভিন্ন ভিন্ন মহাকাশ মিশন করছে। এখনও পর্যন্ত মহাকাশ অভিযানে পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সংস্থা হচ্ছে আমেরিকার নাসা। ভারতের মহাকাশ গবেষনা সংস্থা ইসরোর নামেও মহাকাশ অভিযানের ক্ষেত্রে একাধিক কৃতিত্ব আছে। তবে আজ মহাকাশের ইতিহাস কিংবা কোন দেশের মহাকাশ গবেষনা সংস্থা নিয়ে কথা বলা হবেনা বরং মহাকাশে হিউম্যান স্পেস মিশনের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হবে। 

আমেরিকার নাসা এর আগে মঙ্গলের মাটিতে রোভার পাঠিয়েছে। ইসরোও মঙ্গল অভিযান মিশন করেছে এর আগে কিন্ত মঙ্গল গ্রহে আজ পর্যন্ত কোন মহাকাশচারী যেতে পারেনি। মঙ্গলে মহাকাশচারী পাঠানোর প্রথম ধাপ হিসাবে নাসা আর্টেমিস মিশন করছে, ইসরো চাঁদে চন্দ্রযান ৩, চীন ছ্যাঙ্গ এবং রাশিয়া লুনা ২৫ মিশন পাঠাবে। তবে বাকী সবের থেকে নাসার আর্টেমিস প্রজেক্ট অনেকটা আলাদা। এই প্রজেক্টে নাসা চাঁদে মহাকাশচারী পাঠাবে সাথে সাথে নাসা এই প্রজেক্টের মাধ্যমে মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর গেটওয়ে তৈরি করতে চাইছে। মঙ্গল গ্রহে মানুষের কলোনী তৈরি করবার কথা ইতিমধ্যেই জানিয়েছে আমেরিকার স্পেসএক্স সংস্থার মালিক ইলন মাস্ক। ইতিমধ্যেই মহাকাশ গবেষনার ক্ষেত্রে একটি খুব গুরুত্বপূর্ন ধাপ শুরু হয়েছে তা হচ্ছে মহাকাশ ভ্রমন। শুধু চাঁদ, মঙ্গলই নয় অন্যান্য গ্রহে মানুষের বসতি স্থাপনের উপযুক্ত পরিবেশের খোঁজ চলছে প্রতিনিয়ত। তবে এসব মিশন প্রযুক্তিগত ভাবে অত্যন্ত জটিল এবং প্রচুর ব্যায়বহুল। আগামী এক দশকের মধ্যে অন্য কোন গ্রহে মানুষ পাঠানো হয়ত সম্ভব হবে কিংবা মঙ্গলে মানুষের বসতি স্থাপনও অদূর ভবিষ্যতে করা হয়ত সম্ভব হবে কিন্ত বর্তমানে বেশ কিছু সমস্যা আছে মহাকাশ অভিযানে। এই বিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

মহাকাশ অভিযানের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যা আছে। প্রথমত মহাকাশ মিশনের ক্ষেত্রে খরচ একটি বড় সমস্যা। বিশ্বজুড়ে বেশকিছু দেশের মহাকাশ গবেষনায় বাজেট ২০২২-২৩ এ একটু কম হয়েছে কারন ২০১৯ থেকে চলা কোভিড -১৯ এবং সম্প্রতি হওয়া রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্বের আর্থিক ব্যাবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তেলের দাম বেড়েছে এবং মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে যার প্রভাব দেখা গেছে মহাকাশ গবেষনার বাজেটে। তবে আমেরিকা ও চীনের ক্ষেত্রেই ততটা প্রভাব না পড়লেও, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানির মহাকাশ গবেষনায় বাজেট কিছুটা হলেও কমেছে। তবে ইসরোর বাজেট মোটামুটি একই আছে। আমেরিকান কংগ্রেসে সম্ভবত নাসার বাজেট একটু কমাবে। স্পেস স্টেশন আরও একটি প্রধান সমস্যা। এতদিন পর্যন্ত মহাকাশ অভিযানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখত আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন। আইএসএস বা আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন নিম্ন পৃথিবী কক্ষপথে অবস্থিত একটি বড় স্যাটেলাইটের মতো। এটি আয়তনে একটি ফুটবল মাঠের মতোন। বিশ্বের পাঁচটি দেশের মহাকাশ সংস্থা আমেরিকার নাসা, রাশিয়ার রসকসমস, জাপানের জাক্সা, ইউরোপের ইএসএ এবং কানাডার সিএসএ যৌথভাবে এটি তৈরি করেছে। এই পাঁচটি দেশ ছাড়াও আরও পনেরোটি দেশ যুক্ত আছে এতে। তবে চীনকে এখানে যুক্ত করা হয়নি। মহাকাশ অভিযানে যাওয়া মহাকাশচারীদের ঘর এটা। এখানে পদার্থবিদ্যা, মহাকাশ বিজ্ঞান, মেট্রোলজি নিয়ে গবেষনা করার সাথে সাথে ভবিষ্যতে চন্দ্র অভিযান ও মঙ্গল অভিযানের মহাকাশযানের বিভিন্ন প্রযুক্তি পরীক্ষার কাজ করা হয়। 

২০৩১ সালে নাসা আইএসএসকে অবসরে পাঠাবে। প্রশান্ত মহাসাগরের পয়েন্ট নিমো অঞ্চলে এই আইএসএস এর ধ্বংসাবশেষ পড়বে। চীনকে আইএসএস থেকে দূরে রাখার জন্য চীন নিজেই নিজের জন্য স্পেস স্টেশন তৈরি করেছে। চীনের এই স্পেস স্টেশনের নাম তিয়ানগং যাতে গতবছরই তিনজন মহাকাশচারীকে পাঠিয়েছিল চীন। এই কারনে মহাকাশ অভিযানে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। বিংশ শতকে মহাকাশ অভিযান নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে যাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশে প্রথম মানুষ পাঠিয়েছিল ইউরি গ্যাগারিন। আমেরিকা চাঁদে প্রথম মানুষ পাঠিয়েছিল নীল আর্মস্ট্রংকে। যদিও এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেক বিতর্ক আছে। তবে আমেরিকার এই চাঁদে মানুষ পাঠানোর ঘটনাকে বাদ দিলে এই প্রতিযোগিতায় সোভিয়েত ইউনিয়নই বিজয়ী হয়েছিল। একবিংশ শতাব্দীতে আবারও আমেরিকা ও চীনের মধ্যে মহাকাশ অভিযানে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। যদিও নাসার তুলনায় চীনের মহাকাশ সংস্থার বাজেট অনেক কম তবুও প্রযুক্তিগত এবং আর্থিক দিক দিয়ে চীন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। বিভিন্ন দেশের বেসরকারী মহাকাশ সংস্থাও এগিয়ে এসেছে মহাকাশ অভিযানে। আমেরিকার ইলন মাস্কের স্পেস এক্সের স্টারশিপ বিশ্বের প্রথম চাঁদকে প্রদক্ষিন করার মহাকাশ ভ্রমনকারী রকেট। ব্রিটিশ ধনকুবের রিচার্ড ব্রানসনের ভার্জিন গ্যালাকটিকও একটি বেসরকারি মহাকাশ ভ্রমন সংস্থা। তবে ভার্জিন গ্যালকটিকের একবার মহাকাশ ভ্রমনে যাত্রীপতি খরচ ৪,৫০,০০০ ডলার বা ভারতীয় মুদ্রায় তিন কোটি ষাট লাখ টাকা। অ্যামাজনের মালিক জেফ বেজোসের ব্লু অরিজিন নামেও একটি সংস্থা রয়েছে। তবে বিশ্ব আর্থিক মন্দা থেকে বেসরকারী সংস্থা গুলোও বাদ যায়নি। 

২০২২ সালে বেসরকারী সংস্থাগুলোতে বিনিয়োগ কমেছে ৫৮ শতাংশ! ২০২২ সালে বেসরকারী মহাকাশ সংস্থা গুলোতে বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র কুড়ি বিলিয়ন ডলার যা ২০১৫ সালের পর সর্বনিম্ন। মহাকাশ অভিযানে তৃতীয় যে সমস্যা আসতে চলেছে তা হচ্ছে স্পেস ডার্বি বা স্যাটেলাইট, রকেটের ধ্বংসাবশেষ। ব্যাপরটা ভালোভাবে বলা যাক। ২০০০ সালে ৮০০ স্যাটেলাইট লঞ্চ করা হয়, ২০২১ সালে সংখ্যাটা এসে দাঁড়িয়েছে ৫০০০! আগামী কয়েক বছরে আরও কয়েক হাজার স্যাটেলাইট লঞ্চ করা হবে যার কারনে স্যাটেলাইটদের মধ্যে সংঘর্ষ হলে একটার পর একটা স্যাটেলাইট ধ্বংস হতে থাকবে। কেসলার নামে এক বিজ্ঞানী এই কথা প্রথম জানিয়েছিল বলে একে কেসলার সিনড্রোম বলা হয়। একবার স্যাটেলাইট ধ্বংস হয়ে গেলে স্যাটেলাইট ফোন, স্যাটেলাইট ইন্টারনেট, জিপিএস সিস্টেম, আবহওয়ার খবর জানা যাবে না, টিভি দেখা যাবে না। চতুর্থ সমস্যা হচ্ছে আউটার স্পেস আইন। 

১৯৬৭ সালে এই আইন তৈরি হয়েছিল যা এখনও চলছে। কিন্তু এই আইনে বেসরকারি সংস্থা, ধনকুবেরদের সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি, সেজন্য দাবি উঠেছে এই আইন সংশোধন করার। সুতরাং ভবিষ্যতে কোন বড় মহাকাশ অভিযানের ক্ষেত্রে এইসব সমস্যা দূরীকরনে দেশগুলোকে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব দূরে সরিয়ে রেখে একসাথে কাজ করতে হবে। তবেই হয়ত অন্য গ্রহে মানুষ পাঠানো কিংবা মঙ্গলে বসতি স্থাপনের মতন বড় বড় প্রজেক্ট সফল হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *