অফবিট

কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রকে এবারে বিশেষ জোর দিয়েছে বিজেপি। তৃতীয় দফা ভোটের প্রাক্কালে রাজ্যে তিনটি সভা করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী

আঠারোতম লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভোটের ময়দানে ব্যস্ত সব রাজনৈতিক দলই। ইতিমধ্যেই দেশের সমস্ত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দাবী ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় এবার আরও বেশী সংখ্যক আসনে বিজয়ী হতে চলেছে বিজেপি। দেশের রাজনৈতিক মহলের দাবী চলতি লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ৩৭০ এর বেশী আসনে জয়ী হবে। যদিও বিজেপি তাদের নির্বাচনী প্রচারে ৪০০ এর বেশী আসনে জেতার লক্ষ্য নিয়েছে। এবারের সাধারন নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে সংগঠনকে মজবুত করতে বেশী জোর দিয়েছে বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব। ইতিমধ্যেই দেশে দুই দফার ভোটগ্রহন হয়ে গিয়েছে এবং আগামী ৭মে তৃতীয় দফায় ভোট হতে চলেছে। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের মধ্যে ১৮টিতে জয়ী হয়েছিল বিজেপি প্রার্থী। এবার সেই পরিসংখ্যান দ্বিগুন করবার লক্ষ্যে মাননীয় শ্রী নরেন্দ্র মোদী একেরপর এক সভা করছে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। 

আগামী ১৩মে দেশে চতুর্থ দফার ভোটগ্রহনে রাজ্যে বোলপুর, কৃষ্ণনগর, বীরভূম, বহরমপুর, রানাঘাট, আসানসোল, বর্ধমান পূর্ব ও বর্ধমান দূর্গাপুর কেন্দ্রে ভোট হবে। এই জন্য গত শুক্রবার বর্ধমান, কৃষ্ণনগর, বোলপুরে জনসভা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। শুক্রবার সকালে প্রথমে বর্ধমান পূর্ব এবং বর্ধমান দূর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থীর সমর্থনে বিশাল জনসভা করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বাংলায় প্রচারের জন্য বৃহস্পতিবার রাতেই কোলকাতা পোঁছে গিয়েছিলেন তিনি। নিয়ম অনুযায়ী কলকাতার রাজভবনেই রাতে থাকেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার জন্য শহর কলকাতাকো নিরাপত্তার চাদরে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই দিন শহরে যানচলাচলও ছিল নিয়ন্ত্রিত। শুক্রবার সকাল দশটা নাগাদ রেসকোর্সের হেলিপ্যাড থেকে প্রধানমন্ত্রী মোদী রওনা দেন বর্ধমানের উদ্দেশ্যে। পূর্ব বর্ধমান জেলার অন্তর্গত তালিতের সাঁই কমপ্লেক্স মাঠে প্রধানমন্ত্রী মোদী সকাল ১০ঃ৫০ নাগাদ হেলিকপ্টারে করে আসেন। এই জনসভায় প্রধানমন্ত্রী মোদী ছাড়াও বর্ধমান পূর্বের প্রার্থী অসীম সরকার, বর্ধমান দূর্গাপুর কেন্দ্রের প্রার্থী দিলীপ ঘোষ এবং রাজ্য বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার সহ বঙ্গ বিজেপি নেতৃত্বের বড় একটি অংশ উপস্থিত ছিল। বক্তৃতার শুরুতেই তিনি জয়মা দূর্গা, জয়মা কালী এবং হরহর মহাদেব বলে উপস্থিত সাধারন মানুষকে বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। 

তীব্র গরম উপেক্ষা করে আসা মা বোনদের উদ্দেশ্যেও প্রনাম জানান তিনি। সভায় আসা মানুষদের প্রধানমন্ত্রী মোদী তার পরিবার বলে ঘোষনা করে জানান তার উপর ইশ্বররূপী জনতার এতটাই ভালবাসা ও আশীর্বাদ রয়েছে যে সমগ্র বিশ্বে কেউ তার কল্পনাও করতে পারবেনা। মঞ্চ থেকে তিনি ভারতবর্ষের মানুষের দারিদ্র্যতা দূরীকরনের সংকল্প করেন। প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন দারিদ্র্যতা, কষ্ট তিনি খুব ভালোভাবেই জানেন কারন ছোটবেলা থেকে তিনি তা সহ্য করেছেন। গত দশবছরে অন্তত ২৫ কোটি ভারতবাসী দারিদ্র্যতা থেকে মুক্তি পেয়েছে, আগামী পাঁচ বছরে আরও বেশী মানুষকে দারিদ্র্য সীমা থেকে তুল আনার অঙ্গীকার করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। সাধারন মানুষের উদ্দেশ্য তিনি জানান তার কোনও উত্তরাধিকার নেই, ভারতবর্ষের প্রত্যেক পরিবারই তার উত্তরাধিকার সেজন্য জনতার চরন ধুলো মাথায় নিয়ে সর্বদা ভারতমাতার সেবা করে যাবেন তিনি। শস্যভান্ডার হিসাবে বর্ধমানের পুনরুত্থান ও পুরো বিশ্বের মধ্যে শিল্পাঞ্চল হিসাবে দূর্গাপুরের নাম হওয়ার আশাপ্রকাশ করেন শ্রী নরেন্দ্র মোদী। সভা থেকে শাসকদল তৃনমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস এবং বামপন্থী দলগুলোর তীব্র সমালোচনা করে তিনি জানান এই সমস্ত দল যে যে রাজ্যে গেছে সেসব রাজ্যের বিকাশ বন্ধ হয়ে গেছে। উদাহারন হিসাবে তিনি পশ্চিমবঙ্গের পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা রাজ্যের কথা বলেন যেখানে ৩৫ বছরের বাম শাসনে সাধারন মানুষ জর্জরিত হয়ে গিয়েছিল এবং মাত্র পাঁচবছরে বিজেপির শাসনে ত্রিপুরাতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। সন্দেশখালির ঘটনার কথা তুলে তিনি বাংলার মহিলাদের উপর হওয়া অত্যাচারের প্রসঙ্গে বলেন এত অত্যাচারের পরেও শাসকদল শেখ শাহজাহানকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। বর্ধমানের জনসভা থেকে তিনি নাম না করে মুর্শিদাবাদের তৃনমূল নেতার সমালোচনা করে।  শাসকদল তৃনমূল কংগ্রেসের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী মোদী বাংলার হিন্দুদের অবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন, তিনি বলেন রামমন্দির নির্মানে, রামনবমী শোভাযাত্রায় তাদের আপত্তি রয়েছে, জয় শ্রীরাম আওয়াজ শুনলে তাদের জ্বর চলে আসছে। রাজ্যের শাসকদলের বিরুদ্ধে তোষনের রাজনীতি এবং হিন্দুদের পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক করে রাখার অভিযোগ তোলেন প্রধানমন্ত্রী। সভা থেকে দলিত, আদিবাসী ও ওবিসিদের উদ্দেশ্যে তিনি জানান কংগ্রেস সংবিধানে সংশোধন করে তাদের সংরক্ষনের কোটা কমিয়ে ধর্মের নামে সংরক্ষন দিতে চাইছে যা ভারতবর্ষের নীতির বিরোধী। 

প্রধানমন্ত্রী মোদী জানান বাবা সাহেব আম্বেদকর ধর্মের নামে সংরক্ষনের বিরোধী ছিলেন সর্বদা। এজন্য তিনি দলিত, আদিবাসী ও ওবিসিদের বিজেপি বিরোধী কংগ্রেসের ইন্ডিয়া জোটে ভোট না দেওয়ার আবেদন জানান। পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের উদ্দেশ্য তিনি বলেন গত দশ বছর ধরে ভারত সরকারের নেতৃত্বে বাংলায় ৩৮ লাখের বেশী পাকাবাড়ি তৈরি করা হয়েছে, ছয় কোটি মানুষকে বিনামূল্যে রেশন দেওয়া হচ্ছো, প্রায় ৮০ লাখ মানুষের বাড়িতে পানীয় জল সরবরাহ করা হয়েছে, পিএম জীবনজ্যোতি যোজনায় গরীব মানুষদের নাম মাত্র মূল্যে বীমা করে দেওয়া হয়েছে, শুধুমাত্র বর্ধমানের কয়েক লাখ কৃষককে পিএম কৃষক সম্মাননিধির আওতায় পাঁচশো কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন বিরোধীরা দেশকে ভাগ করার জন্য ভোটে লড়ছে, বিশেষকরে তৃনমূল কংগ্রেসের তোলাবাজরা সাধারন মানুষের কাছ থেকে টাকা লুঠ করেছে। সম্প্রতি রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগ দূর্নীতির কথাও শোনা গেল মোদীর সভায়। তিনি রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বকে বিশেষ আইনি সেল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তৈরির নির্দেশ দেন যাতে যোগ্য প্রার্থীরা আইনি সুবিধা পায়। প্রধানমন্ত্রী মোদী সভা থেকে নিশ্চয়তা দেন যারা যোগ্য এবং সৎ তাদের পাশে বিজেপি রয়েছে। মঞ্চ থেকে বলিষ্ঠ কন্ঠে তিনি ঘোষনা করেন টিএমসির তোলাবাজি চলতে দেওয়া হবেনা, এটা মোদীর গ্যারান্টি। বিকশিত ভারত ও আত্মনির্ভর ভারত গঠনের জন্য সভা শেষে মানুষের কাছে বিজেপিকে ভোট দেওয়ার অনুরোধ করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বর্ধমানের জনসভা সম্পূর্ন হওয়ার পরেই তিনি রওনা দেন কৃষ্ণনগরের তেহট্টের শ্যামনগর ফুটবল মাঠের উদ্দেশ্যে। রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী জগন্নাথ সরকার এবং কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী অমৃতা রায়ের উপস্থিতিতে একটি নির্বাচনী প্রচার সভায় যোগদেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। কৃষ্ণনগর কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী অমৃতা রায় কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের সদস্য। 

এখান থেকে তিনি ঘোষনা করেন পুরো দেশে তৃনমূল কংগ্রেস ১৫টি আসনও পাবেনা। সদ্য পাশ হওয়া সিএএ আইনকে ঘিরে তৃনমূলের বিরোধীতা নিয়ে মোদী জানান তিনি বাংলার মতুয়া সমাজকে তাদের নায্য অধিকার দিতে চান যার বিরোধীতা করছে রাজ্যের শাসকদল তৃনমূল কংগ্রেস। কৃষ্ণনগরের সভাতেও প্রধানমন্ত্রী মোদী রেশন দূর্নীতি, সন্দেশখালিতে অস্ত্র উদ্ধার সহ তৃনমূলের একাধিক দূর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হন। কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রকে এবারে বিশেষ জোর দিয়েছে বিজেপি যার জন্য এক মাসের ব্যবধানে কৃষ্ণনগরে দুবার সভা করলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। কৃষ্ণনগরের জনসভার পর তিনি বোলপুরের আমোদপুর মেলার মাঠে প্রচারে যান। বীরভূমের বিজেপি প্রার্থী দেবতানু ভট্টাচার্য এবং বোলপুরের প্রার্থী পিয়া সাহার সমর্থনে বিশাল জনসভায় চলতি লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে জয়ী করবার আহ্বান জানান সাধারন মানুষের কাছে। তবে এদিন তিনদফা কর্মসূচির পর বিশ্রাম না নিয়েই প্রধানমন্ত্রী মোদী ঝাড়খন্ডে সভার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। নির্বাচন কমিশনের ভোট ঘোষনার আগে থেকেই প্রধানমন্ত্রী মোদী পশ্চিমবঙ্গে বেশ কশেকটি সভা করে গেছেন ইতিমধ্যেই। গত দুই দফা ভোটের আগেও তিনি দুইবার বাংলায় এসেছিলেন ভোট প্রচারে। আগামী ৭ মে তৃতীয় দফা ভোটের আগে পুনরায় আরও একবার পশ্চিমবঙ্গে এলেন প্রধানমন্ত্রী। এর থেকে এটা স্পষ্ট যে লোকসভা নির্বাচনে গত দুইবারের মতো এবারেও বিজেপি সব আসনে নরেন্দ্র মোদীকেই সামনে রেখে নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *