অফবিট

বিশ্বের প্রাচীন দশটি শহর যা লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল

যার উত্থান আছে তার পতনও নিশ্চিত, ইতিহাসে সমস্ত বড় সাম্রাজ্য বা উন্নত সভ্যতা কালের বিবর্তনে ধ্বংস হয়ে গেছে। সিন্ধু সভ্যতা, মায়া ইনকা সভ্যতার মতোন উন্নতা সভ্যতা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। এককালের দোর্দন্ডপ্রতাপ রাজপ্রাসাদ আজ ধ্বংসস্তূপ হয়ে পড়ে রয়েছে। ঠিক তেমনি বর্তমানে আধুনিক বিজ্ঞানের যে এত অগ্রগতি, এত অসাধারন স্থাপত্যশিল্প হয়ত কয়েক হাজার বছর পর এগুলোও অতীতের সভ্যতাগুলোর মতোন ধ্বংসস্তূপ হয়ে পড়ে থাকবে। তখন হয়ত নতুন কোনও যুগের সূচনা হবে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আগামী কয়েকশো বছরের মধ্যে বিশ্বের বহু এলাকাই জলমগ্ন হয়ে যাবে। ইতিহাসেও বহু শহর এভাবে জলমগ্ন হয়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। প্রত্নতত্ত্ববিদরা ইতিহাসে হারিয়ে যাওয়া এরকম দশটি শহর খুঁজে পেয়েছে যেগুলো একসময় উন্নত সভ্যতার পরিচয় বহন করতো। 

১) টিকাল, গুয়াতেমালা :—- মধ্য আমেরিকার দেশ গুয়াতেমালার গভীর জঙ্গলে অবস্থিত ছিল এই প্রাচীন শহর টিকাল। উত্তর গুয়াতেমালার এই টিকাল শহর প্রাচীন মায়া সভ্যতার গুরুত্বপূর্ন শহর ছিল। ২০০ থেকে ৯০০ এডিতে টিকাল মায়া সভ্যতার সবচেয়ে বড় শহর ছিল। এই শহরে সেসময় অসাধারন সব মন্দির, বড় বড় বাড়ি ছিল যার ধ্বংসাবশেষ বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে। ১৯৫০ সালে এখানে টিকাল জাতীয় উদ্যান তৈরি করা হয় যার মধ্যেই এই প্রাচীন শহারের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। ১৯৭৯ সলে টিকাল জাতীয় উদ্যান ইউনেস্কোর সংরক্ষিত এলাকার স্বীকৃতি পায়। টিকালার বিশাল ধ্বংসাবশেষের মধ্যে বিশ্ব প্রসিদ্ধ মুন্ড পারদিদো পিরামিড, জাগুয়ার মন্দির রয়েছে। 

২) মাচু পিচু পেরু:—- সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২,৪৩০ মিটার বা প্রায় ৮০০০ ফুট উচ্চতায় পেরুর উরুবাম্বা অঞ্চলে অঞ্চলে অবস্থিত এই মাচু পিচু বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে একটি। মাচু পিচু প্রাচীন ইনকা সভ্যতার অসাধারন নিদর্শন। ১৯১১ সালের ২৪ জুলাই আমেরিকার ইয়ালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক হিরাম বিংহাম ইনকা সভ্যতার এই লুপ্ত শহরটির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন। এই শহরটিকে ওল্ড পিকও বলা হয়। অনুমান করা হয় ১৪৫০ সালে এই পাথরের শহর তৈরি করা হয়েছে। এই শহরে ২০০ বাড়িতে অন্তত ৭৫০ জন মানুষ থাকতো। এখানে সূর্য দেবতার মন্দির রয়েছে। মাচু পিচু শহর কেন নির্মান করা হয়েছিল তা আজও রহস্যময়। বলা হয় এখানে মানুষদের বলি দেওয়া হত কারন এখানে প্রত্নতত্ত্ববিদরা অনেক মানুষের কঙ্কাল খুঁজে পেয়েছে যাদের মধ্যে বেশীর ভাগ কঙ্কাল মহিলাদের। শহর তৈরির ১২২ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৫৭২ সালে এই শহর অজানা কারনে পরিত্যক্ত করে দেওয়া হয়। মাচু পিচু নিয়ে এটাও বলা হয় যে এই শহর ভীনগ্রহের প্রানীরা নির্মান করেছিল। 

৩) ক্যালাকমুল ক্যামপেচে :—- মেক্সিকোর ক্যামপেচে নামক এলাকায় মায়া সভ্যতার এই প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। মায়া সভ্যতার সবচেয়ে শক্তিশালী শহরগুলোর মধ্যে একটি ছিল এই ক্যালাকমুল শহর। গুয়াতেমালা থেকে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই শহর। বর্তমানে এই অঞ্চল ইউনেস্কোর সংরক্ষিত অঞ্চলের খেতাব পেয়েছে। 

৪) সিগিরিয়া :—- ১৮৩১ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মেজর জোনাথন ফোর্বস মধ্য শ্রীলঙ্কার ঘন জঙ্গলে একটি পৌরানিক লুপ্ত শহর আবিষ্কার করেন। এই শহরের নামই সিগিরিয়া যার অর্থ সিংহ। এই শহরের প্রবেশমুখে একটি বিশাল সিংহের মূর্তি রয়েছে তবে সিংহের মুখ ভেঙ্গে গেছে। জঙ্গল থেকে ৬৫০ ফুট উচ্চতায় একটি পাহাড়ের মাথায় এই শহর তৈরি করা হয়েছিল। প্রথমদিকে এখানে বৌদ্ধমঠ ছিল। পরবর্তীকালে রাজা কাশ্যপ এখানে রাজপ্রাসাদ তৈরি করেন। নীচে থেকে সিগিরিয়া পোঁছাতে ১২০০ সিঁড়ি অতিক্রম করতে হয় যাতে এক ঘন্টা সময় লেগে যায়। ১৯৮২ সালে ইউনেস্কো এই  শহরকে সংরক্ষিত অঞ্চলের তকমা দেয়। 

৫) স্কারা ব্রে:—- স্কটল্যান্ডের অর্কিনি দ্বীপে অবস্থিত পাথরের তৈরি এই শহর মিশরের গ্রেট পিরামিডের থেকেও পুরোনো। ১৮৫০ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে এই লুপ্ত শহর আবিষ্কার করা হয়। ১৮৫০ সালের শীতকালে স্কটল্যান্ডে এক বিশাল সামুদ্রিক তুফান আসে যাতে ২০০ মানুষের মৃত্যু হয়। সামুদ্রিক তুফানের কারনে অর্কিনি দ্বীপে একটি বড় পাথর খন্ড ফেটে যায় এবং এরপরেই ওই প্রস্তরখন্ডের নীচে থাকা এই পাথরের ঘরগুলো খুঁজে পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে আরও খননকার্যের ফলে একটি পরিপূর্ন শহরই পাওয়া যায় এখানে। ১৯৯৯ সালে স্কারা ব্রেকে সংরক্ষিত অঞ্চলের মর্যাদা দেয় ইউনেস্কো। 

৬) মহেঞ্জোদারো :—- প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার গুরুত্বপূর্ন অঞ্চল মহেঞ্জোদারো। মহেঞ্জোদারো শব্দের অর্থ মৃতের স্তূপ। বর্তমানে এই মহেঞ্জোদারো পাকিস্তানের অংশ। পাকিস্তানের সিন্ধ অঞ্চলের লারকানা জেলায় মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। ২৬০০ বিসিইতে সিন্ধু নদীর তীরে এই মহেঞ্জোদারো সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। ১৯০০ বিসিইতে এই শহর পরিত্যক্ত হয়ে যায়। মহেঞ্জোদারোর ধ্বংস নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো কারন জানা যায়নি। ঐতিহাসিকরা মনে করেন সম্ভবত অধিক জনসংখ্যার কারনে কিংবা যুদ্ধের কারনে এই সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায়। 

৭) মেসা ভারডে:—- ১৯৮৮ সালে আমেরিকার কলোরাডো প্রদেশের দক্ষিন পশ্চিমে এই শহর আবিষ্কৃত হয়। মেসা ভারডেতে প্রায় ৪,৭০০ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান রয়েছে যার মধ্যে ৬০০টি পাহাড়ি আবাসস্থলও রয়েছে। সাতশো বছর ধরে পুয়েবলো উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষজন এখানে তাদের বাসস্থান তৈরি করেছিল। ১২৭৭ সালে একটি ভয়াবহ খরার কারনে এখনকার মানুষজন দক্ষিনে নিউ মেক্সিকো ও অ্যারিজোনাতে চলে যেতে বাধ্য হয়। আমেরিকা মেসদ ভারডেকে জাতীয় উদ্যান আকারে সংরক্ষিত করে রেখেছে। ১৯৭৮ সালে ইউনেস্কো এই অঞ্চলকে সংরক্ষিত অঞ্চলের তকমা দেয়। 

৮) টেরাকোটা সেনা :—- ১৯৭৪ সালের ২৯ মার্চ চীনের সিয়ান প্রদেশের অন্তর্গত শানসি শহরের লিন্টং নামক জায়গায় এক কৃষক কুয়ো খুঁড়তে গিয়ে কয়েক হাজার পোড়া মাটির ছোট ছোট সেনা আবিষ্কার করে। পরবর্তীকালে ২০০৭ সালে ওই অঞ্চলে ব্যাপক খননকার্যের পর তিনটি প্রধান অংশে প্রায় ৮০০০ এর বেশী পোড়ামাটির সেনা, ৫২০টি ঘোড়া, ১৫০টি অশ্বারোহী সেনা ও ১৩০টি রথ পাওয়া যায়। এসব পোড়ামাটির সেনাকে চীনের টেরাকোটার সেনাবাহিনী বলা হয় যা সিয়ান শহরের মিউজিয়ামে রাখা হয়েছে। চীনের প্রথম সম্রাট কিন শু হুয়াং মৃত্যুর আগে জানায় তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় এই পোড়ামাটির সেনাবাহিনী দিতে তার মৃতদেহের সাথে। এই পোড়ামাটির সেনাবাহিনী তাকে মৃত্যুর পর রক্ষা করবে। এইজন্য ২১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কিন শু হুয়াং এর মৃতদেহের সাথে এই টেরাকোটা বাহিনীকে সমাধিস্ত করা হয়। 

৯) ডেরিঙ্কু শহর:—- তুরস্কের নেভসেহির প্রদেশে আধুনিক ডেরিঙ্কু শহরের কাছে মটির নীচে কয়েকতলা বিশিষ্ট অতীতের ডেরিঙ্কু শহর ছিল। এই শহরকে এলেন গুবু নামেও ডাকা হয়। ১৯৬৩ সালে তুরস্কের এক ব্যক্তি তার ঘরের নীচে হঠাৎই একটি গোপন রাস্তা খুঁজে পায়। তখন সে খননকার্য শুরু করে এবং মাটির নীচে এই ডেরিঙ্কু শহরকে আবিষ্কার করে। মাটির তলায় আাঠারো তলা যুক্ত এই শহরে অতীতে ২০,০০০ মানুষ ও তাদের খাদ্য মজুত করার ব্যবস্থা ছিল। তুরস্কের অন্যাটোলিয়া অঞ্চলের ক্যাপাডোকিয়া নামক জায়গায় ডেরিঙ্কু শহরের মতোন আরও অনেক ভূগর্ভস্থ শহর পাওয়া গেছে। ৭৮০ থেকে ১১৮০ সালের মধ্যে আরব বাইজেনটিয়ান যুদ্ধের সময় শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই শহর তৈরি করা হয়েছিল। ডেরিঙ্কু শহরের সাথে প্রায় নয় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কায়মাকলি নামে আরও একটি ভূগর্ভস্থ শহরের সাথে সূড়ঙ্গপথে যোগাযোগ ছিল। 

১০) পেত্রা:—- দক্ষিন জর্ডানের এক অসাধারন স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন এই পেত্রা শহর। পাথর কেটে নির্মান করা অসাধারন স্থাপত্যকার্য ও জল সংযোগ ব্যবস্থার কারনে এই শহর বিখ্যাত। পেত্রাকে রোস সিটিও বলা হয় কারন এই শহরের স্থাপত্য নির্মানে লাল বর্নের বেলেপাথর ব্যবহার করা হয়েছে। সর্বপ্রথম ১৮১২ সালে এই শহরকে খুঁজে পাওয়া যায়।  অতীতে জর্ডান একটি গুরুত্বপূর্ন বানিজ্যকেন্দ্র ছিল। সেসময় জর্ডানকে নিয়ন্ত্রন করতো নবাটাইন সাম্রাজ্য। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো পেত্রা শহরকে সংরক্ষিত অঞ্চলের স্বীকৃতি দেয়। ২০০০ সালের শুরুর দিকে পেত্রা শহরকে বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যে যুক্ত করা হয়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *