অফবিট

ভারত রাশিয়াকে বাদ দিয়ে কেন আমেরিকার থেকে পরমানু চুল্লী প্রযুক্তি নিতে চলেছে?

আন্তর্জাতিক সমীকরনের ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী বন্ধু বা চির শত্রু কথাটা প্রযোজ্য নয়। কোন একটি দেশের স্বার্থ যদি অন্য কোন দেশের সাথে জড়িত থাকে তাহলে সেই মহূর্তে দুটি দেশের মধ্যে কুটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হয়। সম্প্রতি হওয়া জি-২০ সম্মলনে এমনই এক ব্যাপার দেখা গেছে। জি-২০ সম্মলনে ভারতীয় প্রতিনিধি অমিতাভ কান্থ জানান ভারত ছোট পরমানু চুল্লী আমেরিকার থেকে নেবে। এরপর থেকেই পশ্চিমা মিডিয়া বলতে শুরু করে এটার অর্থ ভারত রাশিয়াকে সরিয়ে আমেরিকার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের পরিস্থিতিতে গোটা বিশ্বের অধিকাংশ দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে, ভারত চীনের মতোন গুটি কয়েক দেশের সাথে এখনও রাশিয়ার বানিজ্য চলছে। এরকম পরিস্থিতিতে ভারতের এই বক্তব্যে কুটনৈতিক ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন বলে মনে করছে পশ্চিমা বিশ্ব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ভারতে পরমানু চুল্লী তৈরী করাকে কেন্দ্র করে আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে একটি মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ রয়েছে। 

ভবিষ্যতের বিশ্বে মানবজাতির অস্তিত্ব রাখতে গেলে কার্বনের ব্যবহার শূন্য হওয়া প্রয়োজন। যার কারনে বিশ্বের প্রতিটি দেশ একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কার্বনের ব্যবহার কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারত ২০৭০ এর মধ্যে কার্বনের ব্যবহার শূন্য করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানির অন্যতম প্রধান বিকল্প হচ্ছে পরমানু বিদ্যুৎ। পরমানু চুল্লীর প্রযুক্তি অত্যন্ত জটিল, পৃথিবীর গুটিকয়েক দেশের কাছেই এই প্রযুক্তি রয়েছে। ইতিমধ্যেই হিটাচি, রাশিয়ার রোসাটোম সহ ফ্রান্সের একটি সংস্থার সাথে ভারতের চুক্তি হয়েছে পরমানু চুল্লীর প্রযুক্তির জন্য। পরমানু বিদ্যুৎ তৈরির প্রধান উপকরন হচ্ছে ইউরেনিয়াম। প্রকৃতিতে ইউরেনিয়ামের দুটি প্রধান আইসোটোপ ইউ ২৩৫ ও ইউ ২৩৮ পাওয়া যায় বিভিন্ন দেশে। তবে ইউ ২৩৫ আইসোটোপই সবচেয়ে কার্যকারী। প্রকৃতিতে ইউ ২৩৫ মাত্র ০.৭ শতাংশ পাওয়া যায়, বাকী ৯৯.৩ শতাংশ হচ্ছে ইউ ২৩৮. সেজন্য ইউ ২৩৫ সমৃদ্ধকরন বা এনরিচমেন্ট করার অর্থ যার অর্থ কৃত্রিম পদ্ধতিতে ইউ ২৩৫ এর পরিমান বাড়ানো হয়। ৫-২০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামকে কম সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ান বলা হয়। সাধারনত পরমানু চুল্লীতে ২০ শতাংশের নীচে ইউ ২৩৫ ব্যাবহার করা হয়। পরমানু অস্ত্র তৈরিতে ২০ শতাংশের বেশী সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ব্যবহার করা হয়। একে উচ্চসমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম বলা হয়। পরমানু বোম্ব তৈরিতে ৯০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউ ২৩৫ ব্যাবহার করা হয়। ৫ শতাংশ এর কম সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম দিয়ে অস্ত্র তৈরি করতে অন্তত ৩৬০০ কেজি আফ্রিকান মহিলা হাতির সমান ওজন প্রয়োজন, সেখানে ৯৩ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম দিয়ে মাত্র তৈরি করতে ৭০ সেন্টিমিটার ওজন প্রয়োজন। 

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের উপর পরমানু বোম্বের প্রয়োগের পর বিশ্বজুড়ে আমেরিকার সমালোচনা হয়। যার কারনে আমেরিকা পরমানু নিরস্ত্রীকরন চুক্তি তৈরি করে যাতে ভবিষ্যতে আর কোনও দেশ পরমানু বোম্ব তৈরি করতে পারবে না, জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইংল্যান্ড, চীন, ফ্রান্স এই পাঁচটি দেশের কাছেই পরমানু বোম্ব থাকবে। তবে তার আগে থেকেই ভারতে পরমানু বিদ্যুৎ এর উপর গবেষনা চলছিল। মেঘনাদ সাহা, হোমি জাহাঙ্গীর ভাবার মতোন প্রখ্যাত পরমানু বিজ্ঞানী ভারতে বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজ করছিলো। টাটার মতোন বেসরকারী সংস্থা এসব প্রজেক্টে বিনিয়োগ করছিলো। সোভিয়েত ইউনিয়ন এসমসয় ভারত সরকারকে প্রস্তাব দেয় ভারতীয় বিজ্ঞানীদের পরমানু বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরীর জন্য প্রশিক্ষন দেবে। এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়েছিল যার কারনে আমেরিকাও ভারত সরকারকে প্রস্তাব দেয় ভারতীয় বিজ্ঞানীদের প্রশিক্ষন দেওয়ার। এরই মধ্যে ১৯৬৮ সালে আমেরিকা ভারতকে জানায় পরমানু নিরস্ত্রীকরন চুক্তিতে সই করতে তাহলে ভারতকে পরমানু চুল্লীর প্রযুক্তি দেবে। কিন্ত ভারতের পাকিস্তান ও চীনের মতোন প্রতিবেশী থাকায় ভারত সরাসরি এই চুক্তি প্রত্যাখান করে দেয়। 

১৯৭৪ সালে অপারেশন স্নাইলিং বুদ্ধার মাধ্যমে রাজস্থানের পোখরানে ভারত প্রথম পরমানু বোম্ব পরীক্ষা করে। এরপরই আমেরিকা তাদের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএকে দায়িত্ব দেয় ভারতের উপর নজর রাখতে। আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিন্টন ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। নিউক্লিয়ার সাপ্লাই গ্রুপ বা এনএসজিতে ভারতকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এইসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে সহায়তা করেছিলো। কিন্তু ২০০৩, ২০০৪ সাল থেকে পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে শুরু করে। ২০০৮ সালে আমেরিকান রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা ও তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এর মধ্যে সিভিল নিউক্লিয়ার চুক্তি হয়। এমনকী আমেরিকা ভারতকে এনএসজির সদস্য পদে সমর্থন পর্যন্ত করে। আসলে আমেরিকা বুঝতে পরেছিল ভবিষ্যতে পরমানু বিদ্যুৎ কেন্দ্রর বাজার ৪০০ বিলিয়ন ডলারের হবে, এক্ষেত্রে ভারত তাদের সবচেয়ে বড় বাজার। আমেরিকান সংস্থা গুলো সরকারকে ভারতের সাথে চুক্তি করতে চাপ সৃষ্টি করে। আমেরিকা এটাও বুঝতে পারে দক্ষিন এশিয়ায় চীনকে প্রতিরোধ করতে ভারতের সাহায্য লাগবে তাদের, পাকিস্তানের প্রতি মোহভঙ্গ হয়েছিল আমেরিকার। আমেরিকা ছাড়াও ফ্রান্স, ব্রিটেন ও জাপানের সাথে ভারতের পরমানু চুক্তি হয়। 

২০১০ সালে ভারত সরকার একটি আইন তৈরি করে যাতে বলা হয় যেসব বিদেশী সংস্থা ভারতে পরমানু প্রযুক্তি দেবে তাতে কোন সমস্যা হলে এবং তার কারনে হওয়া দুর্ঘটনার জন্য সেই সংস্থাটিই দায়ী থাকবে। এই আইন পাশের পরই আমেরিকান সংস্থা গুলো পিছিয়ে আসে এবং ভারত সরকারের সাথে তাদের কথাবার্তা চলতে থাকে। এদিকে ভারত রাশিয়ার প্রতি এমন কোন শর্ত রাখেনি কারন সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৬০ সাল থেকে ভারতকে সহায়তা করছে পরমানু বিদ্যুৎ প্রযুক্তিতে। ভারত রাশিয়ার থেকে অধিকাংশ অস্ত্র কেনে যার কারনে রাশিয়ার সাথে ভারতের আলাদা চুক্তি রয়েছে। ১৯৭৪ সালে পরমানু বোম্ব পরীক্ষার পর ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরও ভারতে কানাডিয়ান পরমানু চুল্লীর জন্য ভারী জল সরবরাহ করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, ১৯৮০, ১৯৯০ এর দশকেও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে সহায়তা করেছিল। তাহলে এবার মনে হতে পারে তাহলে ভারত কেন হঠাৎ করে রাশিয়াকে সরিয়ে আমেরিকার থেকে পরমানু চুল্লী প্রযুক্তি নেবার কথা জানিয়েছে। 

রাশিয়া বরবারই ভারতের পরমানু বিদ্যুৎ প্রযুক্তির বাজারে আমেরিকার থেকে অনেকটাই এগিয়ে। ২০১৮ সালেও রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে ছয়টি পরমানু চুল্লীর চুক্তি হয়েছে। এর প্রধান কারন হচ্ছে পরমানু ফুয়েল। রাশিয়ান পরমানু ফুয়েল সবচেয়ে সস্তা ও উন্নত মানের। যার কারনে ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের মাঝেও যখন আমেরিকা রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তখন আমেরিকান সংস্থা গুলো গোপনে রাশিয়া থেকে পরমানু ফুয়েল কিনছে। ২০২২ সালে ফ্রান্সের সাথেও ভারতের সিভিল পরমানু চুক্তি হয়। কিন্তু আমেরিকার সাথে ২০০৮ সালে চুক্তি হওয়ার পরও এখনও পর্যন্ত ভারতে কোন বড় প্রজেক্ট পায়নি। যার কারনে জি-২০ সম্মেলনে ভারত ছোট পরমানু চুল্লী আমেরিকার থেকে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে সাধারন পরমানু চুল্লীর থেকে এইসব ছোট পরমানু চুল্লী গুলো অনেকটাই আলাদা। ২০১১ সালে জাপানের ফুকোশিমা পরমানু কেন্দ্রে দুর্ঘটনার পর থেকে ভারতেও আওয়াজ উঠতে শুরু করেছিল পরমানু চুল্লী না লাগানোর। তখন থেকেই ভারত সিদ্ধান্ত নেয় ভবিষ্যতে ছোট পরমানু চুল্লী ব্যবহারের। এই মহূর্তে বিশ্বের সতেরোটি দেশ এই ছোট পরমানু চুল্লী প্রযুক্তিতে কাজ করছে।

২০৪০ সালে এই বাজার ৩০০ বিলিয়ন ডলারের হবে। সবচেয়ে আধুনিক ছোট পরমানু চুল্লী প্রযুক্তি আমেরিকারই আছে। সাধারনত পরমানু চুল্লীতে দুই বছর অন্তর ফুয়েল ভরতে হয় কিন্তু ছোট পরমানু চুল্লী গুলোতে পাঁচ থেকে সাত বছর অন্তর ফুয়েল ভরতে হয়। আমেরিকার কাছে এমনও ছোট পরমানু চুল্লী রয়েছে যেখানে ত্রিশ বছর অন্তর ফুয়েল ভরতে হবে। ছোট পরমানু চুল্লী গতানুগতিক পরমানু চুল্লীর তুলনায় সস্তা, সহজে বহনযোগ্য। আমেরিকা, কানাড ও ব্রিটেনে এই ধরনের পরমানু চুল্লীর ইতিমধ্যেই ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে।

পশ্চিমা মিডিয়া ভারতের ব্যাপারে যে প্রচার করছে ভারত রাশিয়াকে ছেড়ে আমেরিকার দিকে ঝুঁকে পড়ছে তা আসলে ভুল, ভারতের রাষ্ট্রনীতি স্বাধীন, তাই ভারত যেমন রাশিয়ার সাথে বানিজ্য করে, ঠিক তেমনি ভারত তার জাতীয় স্বার্থ বজায় রাখতে আমেরিকার সাথেও বানিজ্য করে। ভারত কোন দেশের উপরই পরিপূর্ন নির্ভরশীল নয়। ভারত আমেরিকার থেকে ছোট নিউক্লিয়ার চুল্লী কিনলেও তার ফুয়েল রাশিয়ার থেকেই কিনবে ভারত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *