অফবিট

পৃথিবীর সবথেকে বড় যুদ্ধজাহাজ যেভাবে ডুবিয়ে দিয়েছিল

সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের, ইউরোপে জার্মানির একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপন হয়েছে। একমাত্র ব্রিটেন ছাড়া ইউরোপের সব দেশেই জার্মান আধিপত্য বিস্তার হয়েছে। অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানির বিজয় রথ ছুটেই চলেছে। 

১৯৩৯ সালে শুরু হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাত্র তিন বছরের মধ্যেই ইউরোপে জার্মানির প্রভুত্ব স্থাপন হয়ে গেছে। ব্রিটেনকে তখনও পর্যন্ত জার্মানি পরাজিত করতে পারেনি তার প্রধান কারন ব্রিটেনের ভৌগোলিক অবস্থান। ইউরোপীয়ন দেশ হওয়া সত্বেও ব্রিটেন ইউরোপের মূল ভূখন্ড থেকে দূরে অবস্থিত একটি দ্বীপ রাষ্ট্র, যার কারনে বহু বছর ধরেই প্রাকৃতিক ভাবেই ব্রিটেন নিরাপদ দেশ। ব্রিটেনের নৌবাহিনী বরাবরই বিশ্বের প্রথম তিনটি শক্তিশালী নৌবাহিনীর মধ্যে একটি। হিটলার খুব ভালো করেই জানতো ব্রিটেনকে পরাজিত করতে গেলে তাদের নৌযুদ্ধে পরাস্ত করতে হবে কিন্ত ইউরোপের মূল ভূখন্ড এবং ব্রিটেনের মাঝে অবস্থিত ইংলিশ চ্যানেলে শক্তিশালী ব্রিটিশ নৌবহরকে হারানো যথেষ্ট সমস্যার। সেকারনে অ্যাডলফ হিটলার সেসময় জার্মান ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগকে নির্দেশ দেয় বিশাল আয়তনের যুদ্ধ জাহাজ তৈরি করতে যা ব্রিটিশ নৌবাহিনীকে পরাস্ত করতে পারে। সেকারনে জার্মানির ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ সেসময় তৈরি করে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও বড় যুদ্ধ জাহাজ বিসমার্ক। দৈর্ঘ্যে প্রায় টাইটানিকের সমতুল্য ছিল বিসমার্ক এবং প্রস্থে টাইটানিকের থেকেও বেশী ছিল বিসমার্ক। টাইটানিকের থেকেও ওজন অনেক বেশী ছিল বিসমার্কের, কারন বিসমার্কে অনেক অস্ত্র সজ্জিত ছিল। বিসমার্কের আর্মার সিস্টেম বা কবজ ছিল সেসময়ে সমস্ত যুদ্ধ জাহাজের থেকেও শক্তিশালী। এমনই এক আধুনিক শক্তিশালী যুদ্ধ জাহাজ তৈরি করেছিল সেসময় জার্মানি। অস্ত্র প্রযুক্তিতে জার্মানি সবসময়ই এগিয়ে ছিল বাকিদের থেকে সেসময়।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউ বোট বা সাবমেরিনের পাশাপাশি বিসমার্ক যুদ্ধ জাহাজ ছিল ক্রিগসমেরিনের সবচেয়ে শক্তিশালি হাতিয়ার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান নাজি নৌবাহিনীকে ক্রিগসমেরিন বলা হত, জার্মান ভাষায় যার অর্থ যুদ্ধের নৌবাহিনী। ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জার্মান নৌবাহিনীকে ক্রিগসমেরুন বলা হত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান স্থলসেনাকে হির এবং জার্মান বায়ুসেনাকে লুফতওয়াফে বলা হত। জার্মান চ্যান্সেলর ওটো ভন বিসমার্কের নাম অনুযায়ী এই যুদ্ধ জাহাজের নাম বিসমার্ক রাখা হয়। ১৯৩৬ সালের হ্যামবার্গ শহরের ব্লোহাম ও ভস শহরে বিসমার্ক তৈরির কাজ শুরু হয় এবং আগস্ট, ১৯৪০ সালে জার্মান নৌবাহিনীতে এটি যুক্ত করা হয়। ২৪১.৬ মিটার লম্বা বিসমার্ক যুদ্ধ জাহাজের ডিসপ্লেসমেন্ট ছিল ৫০,৩০০ টন। যা আধুনিক ছয়টি ডেস্ট্রয়ারের সমান। বিসমার্ক জাহাজের গতি ছিল ৩০.০১ কিলোনট বা ৫৫.৫৮ কিলোমিটার প্রতিঘন্টা। ১০৩ জন অফিসার সহ ২,০৬৫ জন সেনা থাকতে পারতো এই বিসমার্কে। বিসমার্কের প্রথম মিশন ছিল আটলান্টিক মহাসাগরে ব্রিটেনকে সহায়তা করতে যেসব জাহাজ যাচ্ছে তাদের আক্রমন করা যাতে ব্রিটেনকে কেউ সহায়তা করতে না পারে। বিসমার্কের শ্রেনীর আরও একটি জাহাজ প্রিনজ ইউগেন এই দুই জাহাজকে আটলান্টিক মহাসাগরে পাঠানো হয়। ব্রিটেন অনেক আগে থেকেই জানতো জার্মানি বিসমার্ক তৈরি করছে। ব্রিটেন বুঝে গিয়েছিল যদি বিসমার্ককে না ধ্বংস করা হয় তাহলে বিসমার্ক তাদের নৌবাহিনীকে ধ্বংস করে দেবে। সেজন্য ব্রিটেন যখনই খবর পায় বিসমার্ক তার প্রথম মিশনে বেরিয়ে পড়েছে তখন ব্রিটেন তাদের নৌবাহিনীর সবচেয়ে শক্তিশালী দুটি যুদ্ধ জাহাজ এইচএম এস প্রিন্স অফ ওয়েলস এবং এইচএমএস হুডকে পাঠায়। এইচএমএস হুড ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধ জাহাজ ছিল এবং অনেক সফল মিশন সম্পন্ন করেছিল, সেজন্য ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে বিশ্বাস করা হত এইচএমএস হুডকে কোন যুদ্ধ জাহাজ হারাতে পারবেনা। সামুদ্রিক লড়াইয়ে একটি প্রসিদ্ধ নীতি হচ্ছে স্যালভো। সামুদ্রিক যুদ্ধ স্থল ও আকাশ যুদ্ধের থেকে অনেকটাই ভিন্ন ধরনের। দুটি জাহাজের মধ্যে সামুদ্রিক যুদ্ধে একটি জাহাজ ও অন্য একটি জাহাজের মধ্যে দূরত্ব কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত হয়ে যায়, অনেক সময় কুড়ি কিলোমিটার পর্যন্ত হয়ে যায়৷ তার উপর সামুদ্রিক ঢেউয়ের কারনে জাহাজ স্থির নয়, এরকম অবস্থায় এত দূরে থাকা শত্রুকে সঠিক ভাবে আঘাত করা খুবই সমস্যার, যার জন্য যুদ্ধ জাহাজে একসাথে অনেক গান ফায়ার করা হয়, একেই স্যালভো বলা হয়। এইচএমএস হুড এবং বিসমার্কের মধ্যে যখন লড়াই শুরু হয় তখন উভয়ের মধ্যে দূরত্ব ছিল ২৬ কিলোমিটার! উভয় যুদ্ধ জাহাজের সাথেই আরও একটি করে যুদ্ধ জাহাজ ছিল। এই চারটি জাহাজের যুদ্ধ যখন শুরু হয় প্রথম এইচএমএস হুড প্রথম স্যালভো ফায়ার করে যা বিসমার্কের কোন ক্ষতিই করতে পারেনি। উভয় যুদ্ধ জাহাজের মধ্যে নয় মিনিট যুদ্ধ হয় যাতে এইচএমএস হুড ডুবে যায়। এইচএমএস হুড অনেক স্যালভো ফায়ার করলেও বিসমার্কের আর্মার এতটা শক্তিশালী ছিল বিসমার্ক ডুবে যায়নি। তবে প্রথম যুদ্ধের পর বিসমার্ক পরবর্তী যুদ্ধের অবস্থায় ছিলনা যার কারনে বিসমার্কের ক্যাপ্টেন জাহাজকে ফ্রান্সে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে রক্ষণাবেক্ষনের জন্য, সেসময় ফ্রান্স জার্মানির অধীনে ছিল। এইচএমএস প্রিন্স অফ ওয়েলস কোনও রকমে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এইচএমএস হুডের ডুবের যাবার খবরে পুরো ব্রিটিশ নৌবাহিনী স্তব্ধ হয়ে যায় কারন এইচএমএস হুড ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধ জাহাজ ছিল। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল সেনাদের মোনোবল বৃদ্ধির জন্য ৬০ টি যুদ্ধ জাহাজ পাঠায় আটলান্টিক মহাসাগরে যার লক্ষ্য ছিল যে করেই হোক বিসমার্ককে খুঁজে বের করে ডোবাতে হবে। একটি ব্রিটিশ জাহাজ এইচএমএস আর্ক রয়্যাল বিসমার্ককে খুঁজে পায় এবং তার পিছু নেয় কিন্তু বিসমার্কের গতি এত বেশী ছিল যে তাকে আটকানো অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। যার কারনে এই ব্রিটিশ এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার পনেরো থেকে কুড়িটি যুদ্ধ বিমান পাঠায় বিসমার্কে টর্পেডো হামলার জন্য। কিন্তু এর জবাব ছিল বিসমার্কের কাছে, বিসমার্কে অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গান ছিল। তবে এখানে ব্রিটিশ পাইলটরা চালাকি করে সমুদ্রের একদম নিচু দিয়ে উড়তে শুরু করে যাতে বিসমার্কের অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গান তাদের ফায়ার করতে না পারে। এভাবে ব্রিটিশ যুদ্ধ বিমানের টর্পেডো হামলায় বিসমার্ক এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে বিসমার্ক আর সামনে এগোনোর ক্ষমতা থাকেনা শুধু একই জায়গায় গোল গোল ঘুরতে থাকে। কিছুক্ষনের মধ্যেই সেখানে তিনটি ব্রিটিশ যুদ্ধ জাহাজ উপস্থিত হয় এবং তারা একসাথে বিসমার্কে আক্রমন করতে থাকে। প্রায় ৯০ মিনিট ধরে ব্যাপক ফায়ারিং এর পর অবশেষে বিসমার্ক ডুবে যায়। ব্রিটিশ যুদ্ধ জাহাজের নাবিকরাও অবাক হয়ে গিয়েছিল এত হেভি ফায়ারিং এর পরেও বিসমার্ক ডুবছেনা বলে। বলা হয় বিসমার্কের নাবিকরাই বিসমার্ককে ভেতর থেকে ক্ষতিগ্রস্ত করে দিয়েছিল যাতে ব্রিটিশরা বিসমার্কের ব্যাপারে কোন তথ্য জানতে না পারে। বিসমার্ক যখন ডুবতে শুরু করে তখন বিসমার্কে থাকা সেনারা জলে ঝাঁপ দিতে শুরু করে। ব্রিটিশ যুদ্ধ জাহাজ উদ্ধার কার্য শুরু করে। তবে সেদিন বিসমার্কের সেনাদের সদস্য খুব খারাপই ছিল ১১০ জন নাজি সেনাকে উদ্ধারের পর একজন ব্রিটিশ নেভি অফিসার হঠাৎ কিছুটা দূরে একটি পেরিস্কোপ দেখতে পায় যার অর্থ জার্মান সাবমেরিন কাছাকাছি আসছে। যার কারনে ওই তিনটি ব্রিটিশ যুদ্ধ জাহাজ আর কাউকে না উদ্ধার করেই ফিরে যায়। বিসমার্কে থাকা ২,২২১ জনের মধ্যে মাত্র ১১০ জনকে উদ্ধার করা হয় বাকিরা সবাই মারা যায় জলেই। আজও আটলান্টিক মহাসাগরের গভীরে বিসমার্কের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। বিসমার্কের ধ্বংসাবশেষ সর্বপ্রথম খুঁজে পায় রবার্ট ব্যালার্ড ১৯৮৯ সালের ৮ জুন, এই ব্যক্তিই টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষও আবিষ্কার করে। সমুদ্রের ১৫,৭১৯ ফুট গভীরতায় বিসমার্ককে পাওয়া যায়। ২০০২ সালে ডিসকভারি চ্যানেলে বিসমার্কের ব্যাপারে এবং তার ধ্বংসাবশেষের ব্যাপারে ছবি তৈরি করা হয়। এই ছবি তৈরি করেছে টাইটানিক সিনেমার জেমস ক্যামেরুন যিনি নিজে খুব কাছ থেকে বিসমার্কের ধ্বংসাবশেষ দেখেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *