আন্তর্জাতিক রাজনীতি বড় গেম আমেরিকার!
রাজেশ রায়:- আমেরিকা পাকিস্তানকে ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের এফ-১৬ যুদ্ধবিমান আপগ্রেডেশন প্যাকেজ দিচ্ছে। আমেরিকান রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের সরকার এই ঘোষনা করেছে। যার পরেই এই ঘটনা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কারন ভারত বহুদিন ধরেই আমেরিকাকে পাকিস্তানকে কোন মিলিটারি সাহায্য দিতে বারন করে আসছিল কারন পাকিস্তান একটি সন্ত্রাসবাদী দেশ। এর আগে প্রাক্তন আমেরিকান রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে পাকিস্তানকে কোনরকম সামরিক সহায়তা দেওয়া নিষেধ করে দিয়েছিল কিন্ত চার বছর পর জো বাইডেন নতুন করে পাকিস্তানকে সাহায্য করা শুরু করল। এর আগে আরও একজন প্রাক্তন আমেরিকান রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা ২০১১ সালে ৮০০ মিলিয়ন ডলার এবং ২০১৬ সালে ৩০০ মিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা দেওয়া বন্ধ করেছিল পাকিস্তানকে। যদিও আমেরিকাকে জানিয়েছে তারা পাকিস্তানকে এফ-১৬ আপগ্রেডেশন প্যাকেজ দিচ্ছে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং এফ-১৬ গুলোকে সচল রাখতে। তবে পাকিস্তান যে এফ-১৬ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করবেনা বরং তা ভারতের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করবে তা সহজেই অনুমেয়। তাহলে আমেরিকা কেন পাকিস্তানকে এফ-১৬ প্যাকেজ দিল!! ভারতের বিরুদ্ধে তা কতটা চিন্তার বিষয়! এবিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
আমেরিকার পাকিস্তানকে সহায়তা করার পেছনে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বড় খেলা রয়েছে। এই মহূর্তে ইউরোপে সবচেয়ে বড় ভূরাজনৈতিক সংকট চলছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ। পাকিস্তান এখানে ইউক্রেনকে সহায়তা করছে। পাকিস্তান রাশিয়া থেকে তেল, গম কোনও কীছু কেনেইনি বরং আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের অনুরোধে পাকিস্তান তাদের বায়ুসেনার মাধ্যমে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে অস্ত্র পৌঁচাচ্ছে। পাকিস্তানের সঠিক বিদেশনীতি বলতে কিছুই নেই। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ যার জন্য দেওলিয়া হয়ে যাওয়া দেশটি রাশিয়া থেকে কম মূল্যে তেল, গম কেনার বদলে আমেরিকাকে খুশি করতে বেশী দামে তেল, গম অন্য দেশ থেকে কিনছে। পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান চেষ্টা করেছিল রাশিয়া থেকে কম দামে তেল, গম কিনতে তারপরই ইমরান খানকে সরিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয় শাহবাজ শরীফ। বলা হয় আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ এর পেছনে জড়িত। আসলে পাকিস্তানের সরকার চালায় দেশটির সেনাবাহিনী এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আমেরিকা প্রীতি কোন নতুন ব্যাপার নয় সেজন্য ইমরান খান আমেরিকার বিরুদ্ধে কথা বলায় তাকে সরিয়ে শাহবাজ শরীফকে সরকারে আনা হয়েছে। আমেরিকা ভারতকেও রাশিয়ার থেকে কোন কীছু না কিনতে অনেক চাপ দিয়েছিল কিন্তু ভারতের বিদেশনীতি শক্তিশালী হওয়ায় আমেরিকা কীছু করতে পারেনি। আমেরিকা একটি ওয়েপনস করিডর তৈরি করেছে পাকিস্তানে ইউক্রেনে অস্ত্র পরিবহন করার জন্য। তবে রাশিয়ান প্রসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কিন্তু সবদিকেই নজর রাখছে, পাকিস্তানের এই পদক্ষেপের জন্য তাকে সঠিক সময়ে অবশ্যই কড়া মূল্য চোকাতে হবে। এবার আমেরিকার ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের এফ-১৬ প্যাকেজ সম্পর্কে জানা যাক।
পাকিস্তান বায়ুসেনার মেরুদণ্ড বলা হয় এফ-১৬ যুদ্ধবিমানকে। পাকিস্তানের কাছে চীনের তৈরি জেএফ-১৭ যুদ্ধবিমান আছে যাকে পাকিস্তান এফ-১৬ এর রিপ্লেসমেন্ট হিসাবে ভাবছিল। কিন্তু বাস্তবে জেএফ-১৭, এফ-১৬ এর তুলনায় অনেক পিছিয়ে। অস্ত্র বহন ক্ষমতা, প্রযুক্তি, এবং ইন্জিনের দিক দিয়ে এফ-১৬ জেএফ-১৭ এর তুলনায় কয়েকগুন এগিয়ে। ১৯৮৩ সালে পাকিস্তান আমেরিকা থেকে এফ-১৬ কিনেছিল, এখনও পাকিস্তানের বিমানবাহিনীতে ৭৫ টি এফ-১৬ আছে। ১৯৭০-৮০ এর দশকে তৈরি হলেও এফ-১৬ এখনও একটি ঘাতক যুদ্ধবিমান। তবে পাকিস্তানের কাছে যেসব এফ-১৬ রয়েছে সেগুলো খুবই পুরোনো ভার্সন এফ-১৬ সি/ডি এবং এফ -১৬ ব্লক ৫২ ভার্সন। বর্তমানে এফ-১৬ এর আরও উন্নত ভার্সন এফ-১৬ ব্লক ৭০/৭২ তৈরি হয়ে গেছে যা আমেরিকা ভারতকে অফারও করেছিল কিন্তু ভারত না করে দিয়েছে। কারন আমেরিকা তাদের যুদ্ধবিমানে কোন ভারতীয় অস্ত্র যেমন অস্ত্র মার্ক ১/২ এয়ার টু এয়ার মিসাইল, ব্রাহ্মস মিসাইল ইনস্টল করার অনুমতি দেবে না। পাকিস্তান অনেকদিন ধরেই আমেরিকাকে তাদের এফ-১৬ আপগ্রেডেশনের জন্য অনুরোধ করছিল কারন আপগ্রেডেশন ছাড়া এগুলো ভারতের বিরুদ্ধে তেমন কার্যকারি হতনা। যার প্রকৃষ্ট উদাহারন বালাকোট এয়ারস্ট্রাইকের পরে অভিনন্দন বর্তমান তার পুরোনো মিগ-২১ দিয়ে এফ-১৬ শুটডাউন করে। কিন্তু পাকিস্তানের বারবার অনুরোধ সত্বেও আমেরিকা দীর্ঘদিন এই প্যাকেজ দেয়নি আমেরিকাকে। তবে আমেরিকা এবার পাকিস্তানকে এই প্যাকেজ দিয়েছে এবং আমেরিকার লকহিড মার্টিন এগুলো আপগ্রেড করবে। খুব সম্ভবত পাকিস্তানকে কোন পয়সা দিতে হবেনা।
আমেরিকার কথা শুনে ইউক্রেনকে সহায়তা করার জন্য এটা আমেরিকার তরফে পাকিস্তানকে উপহার দেওয়া হচ্ছে। জাকোবাবাদের শাহবাজ এয়ারবেস এবং সারগোধার মুসাফ এয়ারবেসে পাকিস্তান তার এফ-১৬ এর আপগ্রেডেশন করাবে আমেরিকার টেকনিক্যাল টিম দ্বারা। আমেরিকার ডিফেন্স হেডকোয়ার্টার পেন্টাগনের ডিফেন্স সিকিউরিটি কোঅপারেশন এজেন্সি বা ডিএসসিএর কথা অনুযায়ী আমেরিকা পাকিস্তানের এফ-১৬ এর ইঞ্জিন, অ্যাভনিক্স, সেন্সর, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সুট, টার্গেটিং পড, স্পেয়ার পার্টস সহ আরও বেশ কীছু আপগ্রেডেশন করবে। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী চিন্তার বিষয় যেটা হচ্ছে সেটা হল এফ-১৬ এর জন্য নতুন ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সুট বা ইডব্লুউ সুট যা ব্যবহার করে কোন যুদ্ধবিমান তার আশেপাশের যুদ্ধবিমানের রেডারকে জ্যাম করে দেয় যাতে শত্রু তার রেডারে প্রতিপক্ষের যুদ্ধবিমানকে দেখতে না পায়। ভবিষ্যতে যদি ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ হয় তাহলে পাকিস্তান এসব যুদ্ধবিমান ভারতের বিরুদ্ধেই ব্যাবহার করবে কারন কোন সন্ত্রাসবাদী সংস্থা আলকায়েদা, তালিবান কারোরই যুদ্ধবিমান নেই। আসলে এখানে একটি বড় জিওপলিটিক্যাল খেলা চলছে। ভারত দীর্ঘদিন ধরেই রাশিয়াকে সমর্থন করে। ইউক্রেন যুদ্ধেও ভারত রাশিয়ার বিপক্ষে কথা বলে নি, আমেরিকার বাধা সত্বেও ভারত রাশিয়া থেলে তেল, গম সহ প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কিনে চলেছে যার জন্য ভারতকে একটু হুমকী দিতে আমেরিকা এই পদক্ষেপ নিয়েছে।
আমেরিকার একজন বিখ্যাত কুটনীতিবিদ ডোনাল্ড লু এর বক্তব্য আমেরিকা ভারতের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়নি বরং সন্ত্রাসবাদ দমনে পাকিস্তানকে সাহায্য করছে। এর যুক্তি হিসাবে তিনি বলেছেন ২০০৮ সালে পাকিস্তান আলকায়দার বিরুদ্ধে বোম্বিং করেছে এফ-১৬ দিয়ে। সম্প্রতি এই বছরই আফগানিস্তানে তালিবানের বিরুদ্ধে বোম্বিং করেছে পাকিস্তান। তবে আফগানিস্তানে বোম্বিং করে সন্ত্রাসীদের বদলে ৪৭ জন সাধারন মানুষকেই মেরে দেয় পাকিস্তান বায়ুসেনা যার কারনে আফগানিস্তানের মানুষ পাকিস্তানের উপর ক্ষিপ্ত। ডোনাল্ড লু আরও জানিয়েছেন আমেরিকা পাকিস্তানকে নতুন কোন যুদ্ধবিমান ও অস্ত্র দিচ্ছেনা বরং পাকিস্তানের এফ-১৬ গুলোকে সচল রাখার জন্য মেইনটেন্যান্স করে আপগ্রেড করে দিচ্ছে। তবে আমেরিকা যাই বলুকনা কেন অতীতেও এটা দেখা গেছে যখন আমেরিকা বুঝেছে ভারত তাদের এতটা পাত্তা দিচ্ছেনা তখনই তাদের পাকিস্তান প্রেম জেগে উঠেছে। আমেরিকা অতীতে পাকিস্তানকে এফ-১৬ দিয়েছিল এই ভাবেই। ১৯৮০ এর দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার সেনা পাঠিয়েছিল। তখন ঠান্ডা যুদ্ধের কারনে আমেরিকা আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে ব্যাবহার করে। এছাড়া ভারত সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘনিষ্ঠ ছিল যার কারনে আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রোনাল্ত রেগন পাকিস্তানকে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
১৯৭১ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় আমেরিকার এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারকে ভাগিয়ে দেয় ভারত আমেরিকা তা ভোলেনি। রোনাল্ড রেগনের এই সিদ্ধান্তের বিরোধীতা তার দলের সদস্যরাই করেছিল কারন সেসময় পাকিস্তান গোপনে পরমানু বোম্ব তৈরি করছিল যা এফ-১৬ থেকে পাকিস্তান ব্যবহার করতে পারে এমন আশঙ্কা ছিল। কিন্তু রোনাল্ড রেগন কীছু না শুনেই পাকিস্তানকে এফ-১৬ দিয়ে দেয়। পরে ১৯৮৯ সালে খবর পায় আমেরিকা যে পাকিস্তান তাদের অনুমতি না নিয়েই চীনের সাহায্যে এফ-১৬ গুলোকে বিশেষ ভাবে আপগ্রেড করেছে পরমানু বোম্ব বহনের জন্য। পাকিস্তানকে এফ-১৬ আপগ্রেডেশন প্যাকেজ দেবার আরও একটি বড় কারন হচ্ছে আমেরিকা বহুদিন ধরেই ভারতের সাথে বেশ কিছু সামরিক চুক্তি করতে চাইছে যেমন ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য এফ-১৮ যুদ্ধবিমান যা আইএনএস বিক্রান্ত এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে থাকবে, অতিরিক্ত সাবমেরিন হান্টার পি-৮আই বিমান, আরও অ্যাপাচি, চিনুক, রোমিও হেলিকপ্টার এবং প্রিডেটর ড্রোন। এই সমস্ত প্রজেক্ট প্রায় ১২-১৪ বিলিয়ন ডলারের। আসলে আমেরিকার অস্ত্র ব্যাবসাই মূল লক্ষ্য। তবে পাকিস্তানের এই এফ-১৬ আপগ্রেডেশন প্যাকেজ নিয়ে ভারতের এতটাও চিন্তার কারন নেই। প্রথমত পাকিস্তানের এফ-১৬ গুলো খুবই পুরোনো সেই ব্লক ৫২ মডেলের যা ১৯৯০ এর দশকে তৈরি, এগুলোতে খুব বেশী আপগ্রেডেশন সম্ভব নয় আর। কারন প্রত্যেক যুদ্ধবিমানের একটা নির্দিষ্ট জীবনকাল থাকে। এফ-১৬ এর জীবনকাল মোটামুটি ৪০ বছর। পাকিস্তানের এফ-১৬ এর জীবনকাল ইতিমধ্যেই প্রায় ৩৫ বছর হয়ে গেছে, সুতরাং যতই আপগ্রেডেশন করুক আাগমী পাঁচ বছরের মধ্যে এগুলো অবসরে পাঠাতেই হবে। সেই তুলনায় ভারতের কাছে অনেক আধুনিক সুখোই-৩০ এমকেআই, তেজস, রাফায়েল যুদ্ধবিমান আছে। বিশেষ করে রাফায়েলের স্পেক্ট্রা ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম এফ-১৬ এর তুলনায় অনেক উন্নত। ভারতের এস -৪০০ এর মতন শক্তিশালী এয়ারডিফেন্স সিস্টেম রয়েছে। এছাড়াও ভারত তেজস মার্ক ২ ও আমকার মতন পঞ্চম প্রজন্মের শক্তিশালী যুদ্ধবিমান তৈরি করছে সুতরাং ভারতের খুব একটা সমস্যা নেই পাকিস্তানের এফ-১৬ আপগ্রেডেশন প্যাকেজ নিয়ে।