স্বামী বিবেকানন্দ ও ভগিনী নিবেদিতার বহু স্মৃতি আগলে রেখেছে বহু শতক ধরে এই বাগানবাড়ি
মানুষের শখের বসে অনেক কিছুই করে থাকেন। কারোর শখ থাকে পোষ্য পোষার, কারোর বা গাড়ির কালেকশন রাখার, কারোর সব থাকে বাগান তৈরির। তেমনি একটি বাগান বাড়ির উদাহরণ হল নীলাম্বর মুখার্জির বাগান বাড়ি। এটি শুধুমাত্র একটি বাগানবাড়ি নয় বরং এই বাগানবাড়িটি সাক্ষী হাজারো পুণ্য স্মৃতির। বেলুড় মঠ থেকে কিছু মিনিটের দূরত্বে এই বাগান বাড়িটি অবস্থিত। শ্রীরামকৃষ্ণের দেহরক্ষার পর শ্রীমা সারদাদেবী ও স্বামীজির বহু বিখ্যাত ঘটনার সাক্ষী এই ভদ্রাসন।
এই বাগান বাড়িটির মাঝখানে রয়েছে সুরধনী। ২ তীরে রয়েছে দুটি ইতিহাস আবৃত রামকৃষ্ণ সংঘ। পূর্বে রয়েছে কাশীপুর উদ্যানবাটি। পশ্চিম কূলে বেলুড় মঠের অল্প দূরে নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাগানবাড়ি। এই বাগান বাড়ির মধ্যে একটি বাড়ি শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের শেষ ২৪৮ দিনের আশ্রয়স্থল। আবার অন্যটি রামকৃষ্ণোত্তর কালে বেশ কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার ধারক ও বাহক।
গঙ্গার তীরে অবস্থিত নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাগান বাড়িটি মা সারদা দেবী, স্বামী বিবেকানন্দ ও ভগিনী নিবেদিতার বহু স্মৃতি আগলে রয়েছে বহু শতক ধরে।
এই বাড়িতে বাস করে শ্রীমা আনন্দ পেয়েছেন বলে স্বামীজি বেলুড়ে শ্রীমায়ের জন্য একটি স্থান করার সঙ্কল্প করেছিলেন। এই বাগানবাড়ি এক কালে ছিল রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের অস্থায়ী শিবির। স্বামীজির স্বপ্নের বেলুড় মঠ নির্মাণকালে এই বাগানবাড়িতে রামকৃষ্ণ মঠ ছিল সাড়ে দশ মাস (১৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৮ – ২ জানুয়ারি ১৮৯৯)। সেই সময়সীমার মধ্যেই নির্ধারিত হয়েছিল ভবিষ্যৎ বেলুড় মঠের গতিপ্রকৃতি।
নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাগানবাড়িটি দোতালা। এই বাড়িটির আদি মালিক ছিলেন একজন ইংরেজ। নীলাম্বর মুখোপাধ্যায় ছিলেন সে যুগের বিশিষ্ট আইনজীবী। থাকতেন কলকাতার বিডন স্ট্রিটে। ঊনবিংশ শতকের সত্তরের দশকে নীলাম্বর মুখোপাধ্যায় ওই বাড়ির মৌরসিপাট্টা লাভ করেন। তিনি যে সময়ে বেলুড়ের বাগানবাড়ির মৌরসিপাট্টা লাভ করেন, সে সময়ে বাড়ি সংলগ্ন জমির পরিমাণ ছিল খুবই কম। তাই তিনি লালাবাবু সায়র রোডের উত্তরাংশে রাজেন্দ্রচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের থেকে ১ বিঘা ১৫ কাঠা ৪ ছটাক জমি কেনেন। স্বামী বিবেকানন্দের মেজ ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত সেই সময়কার বাগানবাড়ি সম্পর্কে লিখেছেন, “তখন বাড়িখানি একতলা, শুধু সিঁড়ি দিয়া ছাদে উঠিবার স্থানটিতে একখানি ছোট ঘর এবং নীচেতে কয়েকটিমাত্র ঘর ছিল।… স্থানটি গঙ্গার ধারে, সামান্য ঘাসওয়ালা উঠান, পেছনে কিছু কলাগাছ ও সুপারিগাছ ছিল।… স্থানটি অতি নিরিবিলি ও সুরম্য।” পরবর্তী কালে কস্তুরীমঞ্জরী দাসী নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে বাগানবাড়িটি কিনে নেন। কস্তুরীমঞ্জরীর পুত্রসন্তান ছিল না। তাঁর মৃত্যুর পর বাড়ির মালিক হন তাঁর দৌহিত্র বিষ্ণুপ্রসাদ রায়। বিষ্ণুপ্রসাদ রায়ই বর্তমান বাগানবাড়ির রূপকার।
রামকৃষ্ণ মঠ স্থানান্তরিত হওয়ার আগেও শ্রীমা সারদা দেবী এই বাগানবাড়িতে এসে বেশ কয়েক বার থেকেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের দেহত্যাগের পর শ্রীমা সারদা দেবীর খুবই কষ্টে দিন কাটতো কামারপুকুরের বাড়িতে। তবে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের আদেশ ছিল মা সারদা দেবী যাতে ওই বাড়িতেই থাকেন, শাক বোনেন এবং শাক-ভাত খান। শ্রীরামকৃষ্ণের আদেশ মত শ্রী মা সারদা দেবী নিজের হাতে শাক বুনতেন, ছেঁড়া শাড়ি গিট দিয়ে পড়তেন কিন্তু নিজের অভাবের কথা কাউকে জানতে দেননি।
১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহী শিষ্য বলরাম বসুর গৃহিণী কৃষ্ণভাবিনী দেবী ও তাঁর শাশুড়ি মাতঙ্গিনী দেবী কামারপুকুরে গিয়ে মায়ের দুরবস্থা দেখার পর, কলকাতায় ফিরে ভক্তমহলে সমস্ত ঘটনা প্রকাশ করেন। তারপর থেকে ভক্তেরা উদ্যোগী হয়ে শ্রীমাকে মাঝে মাঝে কলকাতায় এনে রাখতেন। তখনও বাগবাজারে মায়ের নিজের বাড়ি গড়ে ওঠেনি। হাওড়া ও কলকাতার বিভিন্ন স্থানে বাড়ি ভাড়া করে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করা হতো।
সেই সূত্রেই সেই বছর নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাগান বাড়ির একাংশ শ্রীমা সারদা দেবীর জন্য ভাড়া নেওয়া হয়। সম্ভবত মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে শ্রীমা বাগানবাড়িতে প্রথম পদার্পণ করেছিলেন। ছিলেন প্রায় ছ’মাস। দোতলার উত্তর-পূর্ব দিকের ঘরটিতে তিনি থাকতেন । তাঁর সঙ্গে থাকতেন শ্রীমায়ের দুই সঙ্গিনী যোগীন-মা ও গোলাপ-মা। এই বাড়িতে শ্রীমা সারদা দেবী সব মিলিয়ে মোট দেড় বছর মত ছিলেন। সে সময়ে তাঁর থাকা-খাওয়ার খরচ বহন করতেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ। পরবর্তী কালে শ্রীমা ভক্তদের বাড়িটি সম্পর্কে বলেছিলেন, “আহা! বেলুড়েও কেমন ছিলুম। কি শান্ত জায়গাটি, ধ্যান লেগেই থাকত। তাই ওখানে একটি স্থান করতে নরেন ইচ্ছা করেছিল।”