ফিচার আর্টিকেল

ভারতবর্ষের কাগজ শিল্পের ইতিহাস কি?

১৫৪০ সালে চিত্রকর মীর সৈয়দ আলী তার একটি মিনিয়েচারে কাগজ তৈরির পদ্ধতিকে বিষয়বস্তু করেছেন। আসলে একটি মাদ্রাসার ভেতরে এখানে কোরান পড়া ও তা লেখার সাথে সাথে পাথর পালিশ করার যন্ত্র দিয়ে কাগজ পালিশ করা হচ্ছে, তাও দেখা গেছে। মুঘল যুগে এই ধরনের পালিশ করার যন্ত্র আরো কিছু ছবিতে দেখতে পাওয়া যায়।

সপ্তদশ শতকে কাগজের কারখানা উত্তরে কাশ্মীর ও পাঞ্জাব থেকে পূর্বে বিহার হয়ে বাংলা পর্যন্ত এবং গুজরাত এমনকি দক্ষিণের দৌলতাবাদ অবধি ছড়িয়ে পরে। আলেকজান্ডার সতেরিয়া তার ভ্রমণ কাহিনীতে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন মুঘল যুগের সময় থেকেই ‘কাগজী’ পদবীর মুসলমানদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এরা দিল্লী ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ঐতিহাসিক রডন এখানে অন্য একটি কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, ‘কাগজী’দের কতটা সামাজিক মর্যাদা ছিল, তা বলা কঠিন।

কাগজ তৈরির বিস্তারিত বিবরণ দেশীয় রচনায় প্রথম পাওয়া যায় শাহজাহানের শাসনকালের লেখা বায়াজ-ই-খুশবুই তে। লেখক কাগজ তৈরি, তাতে রঙ করা – এই সবের প্রযুক্তি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তার বলা পদ্ধতি অনুযায়ী চার মন শন বা লিনেনের কাপড়ের সাথে ২০ সের সাজ্জি (সোডিয়াম বাই কার্বনেট) একটি হৌজ বা চৌবাচ্চায় মেশানো হত। তারপর তা কয়েকদিন ধরে নিয়মিতভাবে কাঠের ঢেঁকিতে নরম করা হত, তারপরে নুন ও ভাত মেশানো হত। এবার তা পচানোর জন্য বেশ কিছুক্ষণ রেখে দেওয়া হত। মণ্ডটা প্রয়োজন মতো নরম হলে তা হৌজ থেকে তুলে এনে জল মেশানো হতো ও আগুনে ফোটানো হত। যতক্ষণ তা পরিমাণ মত ঘন না হচ্ছে, ততক্ষণ ক্রমাগত নাড়িয়ে যেতে হত। তারপর তা ঠাণ্ডা করে কাঠের ব্লকে ঢেলে কাগজের আকৃতি দেওয়া হতো। একটি কাঠের চৌকো বাক্সে ঐ মিশ্রণ ঢেলে আরেকটি একই মাপের কাঠের ঢাকনা রেখে তার উপরে চাপান দেওয়া হত, যাতে অপ্রয়োজনীয় জল বেরিয়ে যায়। এবার রোদে শুকিয়ে পালিশ করা হত।

১৬৭৫ সালে জন ফ্রাইয়ারের রচনায় মহারাষ্ট্রের কল্যাণ অঞ্চলের একটি মসজিদের ঠিক কাছেই কাগজ উৎপাদনের সম্বন্ধে উল্লেখ রয়েছে। তিনি বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন যে, কিভাবে ‘মোল্লা’রা নিজস্ব পদ্ধতিতে কাগজ তৈরি করে। আর সে যুগে খোলা জায়গায় কাগজ বানালে তা যে গুণমান কমিয়ে দিতো তার একটা উদাহরণ দেওয়া যায়। মিরাট-ই-আহমদির লেখক আলি মুহম্মদ খান উল্লেখ করেছেন যেহেতু আহমেদাবাদ মরুভূমির খুব কাছাকাছি তাই মণ্ডতে স্বাভাবিকভাবেই বেশি পরিমাণ বালি থাকে। কাগজ শুকোনো বা পালিশ করার সময় এই বালির দানাগুলি বেড়িয়ে আসে। ফলে কাগজের মান ভালো হয় না।

১৭৭৪ সালে কাগজ তৈরির অপর যে পদ্ধতি দেখা যায়, তাতে ঢেঁকি দিয়ে মণ্ড তৈরি না করে তার জায়গায় একটি হাতুড়ির মতো যন্ত্র ব্যবহার করা হত আর ভাতের লেই ঠিক কাগজ শুকানোর আগে দেওয়া হত।

যন্ত্রশক্তিকে কাজে লাগিয়ে স্বয়ংক্রিয় কাঠের ঢেঁকি দিয়ে কাগজের জন্য মণ্ড তৈরির যন্ত্র দেখতে পাওয়া যায় ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে আঁকা একটি কাশ্মীরী ছবিতে। এই ছবিটির ডান দিকে এই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে মণ্ড তৈরি হচ্ছে আর বাঁদিকে দু’জন কর্মচারী কোমরে কাপড় বেঁধে তাতে মণ্ড থেকে অপ্রয়োজনীয় ‘জম’ বের করে দিচ্ছে। নিচে মণ্ড জ্বাল দেওয়া, ছাঁচে ঢালা, চাপান দেওয়া, শুকানো,পালিশ করা ইত্যাদির ছবি রয়েছে।

উত্তর প্রদেশের কল্পি, জয়পুরের সঙ্গনির, জৌনপুরের জাফরাবাদ, দৌলতাবাদের কাছে কাগজীওয়াড়া ও মুম্বাইয়ের ইরান্দলে বেশ কিছু কাগজ তৈরির চৌবাচ্চা দেখা যায়। এই চৌবাচ্চাগুলিকে পাথরের টুকরো বা ইট দিয়ে তৈরি করা হত। লক্ষণীয় যে, যেখানে মণ্ডটি গ্যাজানোর জন্যে রাখা হতো সেই চৌবাচ্চাটি সাধারণত গোল আকৃতির। আর কাগজের ছাঁচটি আয়তাকার। আন্দাজ করা যেতে পারে এই প্রযুক্তি এক অঞ্চলের কারিগর থেকে আরেক অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। 

কি কি ধরণের কাগজ উৎপন্ন হত? সে বিষয়ে অবশ্য পরিষ্কার ধারণা করা একটু অসুবিধাজনক। যেমন, আকবর ও জাহাঙ্গীরের সময়ের একজন বিখ্যাত অভিজাত আব্দুর রহিম খান-ই-খানান; তিনি কাগজ-ই-আক্স নামে এক ধরনের কাগজ তৈরির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। এই কাগজ-ই-আক্স (আয়নার মত কাগজ) সম্ভবত বর্তমান ট্রেসিং পেপারের মত। এছাড়াও তিনি কাগজ-ই-আব্রু নামের আর এক ধরণের কাগজ তৈরির সাথেও যুক্ত ছিলেন। এই কাগজটি সম্ভবত খুবই তেলতেলে ও চকচকে। তবে বর্তমানের কোন কাগজের কাছাকাছি তা নির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন। 

ইউরোপ ও ভারতের কাগজের মানের পার্থক্য হয়েছিল মূলত কাপড়ের জাল ব্যবহারের জন্য। গুটেনবার্গের ছাপানো বাইবেলে পার্চমেন্ট ছাড়াও যে অংশটি কাগজ ছিল তার গুণমান অত্যন্ত উন্নত।

ইউরোপের তুলনায় ভারতের কাগজের মান যে অত্যন্ত খারাপ তা ইউরোপীয়দের লেখায় বারবার উঠে এসেছে। ১৬৩০ সালে সুরাটের কুঠিয়াল ইংল্যান্ডে জানাচ্ছেন যে ভারতীয় কাগজ জাবেদা-খাতার জন্য একেবারের উপযুক্ত নয়। 

১৬৩৪ সালে মাসুলিপট্টনমের ইংরেজ প্রশাসক জানাচ্ছেন যে ইংল্যান্ড থেকে কাগজ না পাঠালে তা প্রায় তিন গুণ বেশি দাম দিয়ে বিদেশী বণিকদের কাছ থেকে কিনতে হবে। ১৬৬৬ সালে চার্ডিন উল্লেখ করছেন যে, ইরানি কাগজের মান অনেকটাই ভারতের মতো, বাদামী রঙের, নোংরা দেখতে, জীর্ণ এবং খুবই নরম ও ভঙ্গুর। এই কাগজের স্থায়িত্বও তাই কম। তবে ইউরোপীয়রাই যে কেবল তাদের কাগজের প্রশংসা করতো তাই নয়, জাহাঙ্গীরের প্রশংসা ও প্রচুর পরিমাণ কাগজ আমদানি লক্ষ্য করা যায়। 

তবে ইউরোপীয় কাগজ ব্যবহারের একটা সমস্যাও ছিল। যে কাগজে ওয়াটারমার্ক ছিল, সেই কাগজে ছবি আঁকা আছে বলে ধরে নেওয়া হয় ও তা ইসলাম বিরোধী; এই প্রচারও ছিল জোরদার। এই ধরনের কাগজকে ‘কাগজ-ই-বুটি’ বলে উল্লেখ করা হতো। 

ইউরোপের কাগজের প্রশংসা থাকলেও সেই প্রযুক্তি, পদ্ধতি ও উপাদান ব্যবহার করে মুঘল যুগে ভারতীয় উদ্যোগে কাগজ তৈরির চেষ্টা হয়নি কখনোই। তবে প্রথম ভারতীয় উদ্যোগে ইউরোপের মানের কাগজ তৈরি শুরু করেন সম্ভবত টিপু সুলতান। তিনি ইউরোপীয়দের মতো কাগজ, ঘড়ি, কাঁটাচামচ প্রভৃতি বিভিন্ন জিনিস ভারতে ব্যবহারের প্রবক্তা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *