কলকাতার প্রথম মহিলা সিরিয়াল কিলার ত্রৈলোক্যতারিণী দেবী
অপরাধ জগতের ইতিহাসের রয়েছে অনেক সিরিয়াল কিলারের নাম। যাদের ভয়ে মানুষ ত্রস্ত থাকত। যেমন উনিশ শতকের কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার জ্যাক দ্য রিপারের নামে ত্রস্ত ছিল লন্ডন। ঠিক এই রকমই একটি কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার ছিল আমাদের কলকাতার বুকে। গয়নার লোভের একের পর এক খুনের পাশাপাশি সিদ্ধহস্ত ছিল তার অপরাধের তালিকা। তাকে ধরতে গিয়ে অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়েছিল পুলিশকে। তবে শুনলে অবাক হবেন যে এতো কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার এই মেয়েটি ছিলেন গ্রামের সাধারণ একটি মেয়ে। এমনকি তাকে প্রথম সিরিয়াল কিলার বলা হয়। কে ছিলেন এই মেয়েটি এবং এই গ্রামের সাধারণ মেয়েটি কিভাবে হয়ে উঠল একজন সিরিয়াল কিলার?
ত্রৈলোক্যতারিণী দেবীর প্রাথমিক জীবন
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বর্ধমানে এক অজ পাড়াগাঁয়ের সম্ভ্রান্ত কুলীন বংশে জন্মগ্রহন করেছিলেন ত্রৈলোক্যতারিণী দেবী। তার সৌন্দর্যতায় মুগ্ধ ছিল গোটা গ্রাম। তৎকালীন সময়ে মেয়েদের বিবাহের যে বয়স ছিল সেই তুলনায় কিছুটা দেরি হয়ে গিয়েছিল ত্রৈলোক্যর জন্য পাত্র জোগাড় করতে। এরপর ষাটোর্ধ্ব এক প্রৌঢ়ের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। তখন ত্রৈলোক্যের বয়স ছিল তেরো।
বিবাহ হলেও আক্ষরিক অর্থে কোনোদিনই তার স্বামীর সাথে সংসার করা হয়নি ত্রৈলোক্য। ওই প্রৌঢ়ের একাধিক স্ত্রী থাকার কারনে তার বাড়িতে ত্রৈলোক্যতারিণীকে নিয়ে যাননি। অন্যদিকে ত্রৈলোক্যতারিণীও ইচ্ছে ছিল না সতীনদের সঙ্গে সংসার করার। যার জন্য তাকে শ্বশুরবাড়ির বদলে গ্রামের বাড়িতেই দিন কাটতে হয়েছিল। কিছু বছর পর মৃত্যু হয় প্রৌঢ়ের। তারপরই চিরকালের জন্য বন্ধই হয়ে যায় তার জন্য শ্বশুরবাড়ির দরজা। গ্রামে তার এই নিঃসঙ্গ জীবনে এক বৈষ্ণবীর সাথে পরিচয় হয়।
সেই বৈষ্ণবীর মারফত তার সাথে পরিচয় হয় এক যুবকের। এরপর থেকেই তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে শুরু করে। মাঝে মাঝে লোকচক্ষুর আড়ালে ওই বৈষ্ণবীর বাড়িতেই তাদের দেখা হত। তারপর একদিন ওই বৃদ্ধা বৈষ্ণবীর মৃত্যু হয়। এরপর কিছু দিনের মধ্যে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পরে ত্রৈলোক্যতারিণীর গোপন সম্পর্কের কথা। যার ফলে ত্রৈলোক্যতারিণী প্রণয়ীর সাথে গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন।
কিন্তু এই বারও তার কপালে জুটলো না সংসারের সুখ। কারন গ্রাম থেকে সদ্য কলকাতায় পা রাখা এই তরুণীর ঠিকানা হয়েছিল কলকাতার নিষিদ্ধপল্লিতে। আর তাকে সেখানে নিয়েই গিয়েছিলেন তার প্রণয়ী। কিন্তু তখন পর্যন্ত সে এই এলাকার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতেন না। তবে যখন সে বুঝতে পারল তখন তার কাছে ফেরার পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তখন সে বুঝে গিয়েছিল যে তাকে ওই পরিবেশেই থাকতে হবে। এরপর আসতে আসতে সেও সোনাগাছির প্রচলিত রীতিনীতির সাথে অভ্যস্ত হতে থাকল।
ক্রমশ ত্রৈলোক্যতারিণী দেখা দিল মক্ষীরানি হয়ে। এরই মধ্যে এক দিন মৃত্যু হয় তার প্রণয়ীর। তখন পর্যন্ত কোনও অর্থকষ্ট ছিল না তার। এ ভাবেই দেড় দশক কাটল। ঠিক ওই সময় তার সাথে পরিচয় হয় জনৈক কালীবাবুর। পরবর্তীকালে তিনি ছিলেন ত্রৈলোক্যর মূল প্রণয়ী এবং সেই সাথে অপরাধের চক্রী। তবে ভালো সময় বেশী দিন থাকল না। বয়স বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করেছিল ত্রৈলোক্যতারিণী দেবীর। তবে জীবনের এই দুঃসময়ে তার হাত ছাড়েনি কালীবাবু। এরপর ত্রৈলোক্যতারিণী কালীবাবুর স্ত্রীবিয়োগের পর তাদের একমাত্র ছেলেকে লালনপালন করেছিল।
অপরাধের জগতে প্রবেশ
ত্রৈলোক্যতারিণী দেবীর সংসার বড় হলেও অর্থের যোগান সেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল না। যার কারনে অবশেষে ত্রৈলোক্যতারিণী এবং তার প্রণয়ী কালীবাবু পা রেখে ছিল অন্ধকার জগতে। প্রথমে ধনী ঘরের ছেলেদের তারা নেশায় চূড় করে তাদের লুঠপাট করত এবং তার সাথে ব্ল্যাকমেলিং ও নানা রকমের প্রতারণা করত।
শিকার ধরত কালীবাবু এবং ত্রৈলোক্যতারিণী সেই শিকারকে নিজের জালে জড়িয়ে তাদের সর্বনাশ করত। শুধু একটা নয় তাদের মানুষকে লুঠ করার জন্য অনেক পদ্ধতিই অবলম্বন করত। যেমন- ঠিকানা বদলে নিজের সাজানো পাত্রীর সঙ্গে অন্য শহরের বিত্তবান পাত্রের বিবাহ দিত। পাত্রীর সাথে তার সাজানো আত্মীয়স্বজনরা যেত। এরপর সুযোগ বুঝে বাবা-মায়ের কাছে যাওয়ার নাম করে সমস্ত গয়নাপত্র নিয়ে ‘নতুন বউ’ সহ তার ‘পরিজনরা’ পালিয়ে আসত। তারপর খোঁজ করলেও তাদেরকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ছিল কারন তাদের দেওয়ার ঠিকানা থাকত ভুয়ো।
দীর্ঘ দিন অপরাধ করার পরে ধরা না পড়ার কারনে তাদের সাহস বাড়ছিল। এরপর তারা হাত বাড়ায় শিশুকন্যাদের অপহরণের দিকে। শুরু করে কলকাতার রাস্তা থেকে শিশুকন্যাদের অপহরণ করা। ওই সময় কন্যাপণ দেওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল কিছু পরিবারের বিয়েতে। আর সেই রকম পরিবারে ত্রৈলোক্যতারিণী বিয়ে দিত অপহৃত বালিকাদের। তবে পুলিশের তৎপরতায় সেই চক্র বন্ধ হয়ে যায়। তবে পুলিশ খোঁজ পায় না ত্রৈলোক্যতারিণীর। একটি চক্র বন্ধ হলে তারা খুঁজে বার করত নিত্যনতুন চক্র।
এরপর তাদের টার্গেটে চলে এসেছিল এক দেশীয় রাজ-এস্টেটের কর্মচারী যাকে তারা গয়নার লোভে খুন করেছিল। আর এই ঘটনার পরই তারা পুলিশের হাতে ধরা পরে গিয়েছিল এবং এই মামলার রায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার হয়েছিল কালীবাবুকে। তবে প্রমাণের অভাবে ত্রৈলোক্যতারিণী মুক্তি পেয়ে গিয়েছিল। তারপর সে সিদ্ধান্ত নেয় যে সে এই অন্ধকারের পথ থেকে সরে যাবে। অর্থকষ্ট হলেও নতুন জীবন সে শুরু করবে। সেই অনুযায়ী সে তার পালিত সন্তানকে নিয়ে সোনাগাছি ছেড়ে অন্য পাড়ায় থাকতে লাগে। তবে বেশি দিন এই অভাবঅনটনের মধ্য দিয়ে জীবন কাটাতে পারল না ত্রৈলোক্যতারিণী। যার কারনে সেই অতীতের সোনালি দিনের মোহ তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে লাগল।
তবে এবার তার টার্গেট ছিল সোনার গয়নার উপর। সে টার্গেট করত নিষিদ্ধ এলাকায় যাদের অনেক গয়না আছে সেই সমস্ত ধনী বাসিন্দাদের। তিনি প্রথমে তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে মন জয় করতেন। এরপর তাদের মানিকতলার পরিত্যক্ত বাগানবাড়িতে নিয়ে যেত এক গুরুদেবের সাথে দেখা করিয়ে দেওয়ার নাম করে। তবে এই সমস্ত কিছু করার আগে তার ‘শিকারের’ গায়ে গয়না আছে কিনা সেই বিষয়ে সে নিশ্চিত হয়ে নিত।
পুলিশের দাবী অনুসারে ত্রৈলোক্যতারিণীর স্বীকার করেছিল যে, সে গুরুদেবের কাছে নিয়ে যাওয়ার আগে ওই ব্যাক্তিদের বলত বাগানবাড়ির পুকুরে স্নান করে নেওয়ার কথা। তবে তার আগে সমস্ত গয়না খুলিয়ে রেখে দিত নিজের কাছে। তারপর পুকুরে স্নান করার সময় ওই ব্যাক্তিকে জলে ডুবিয়ে মেরে ফেলত। এইভাবে ত্রৈলোক্যতারিণী তিন বছরে পাঁচ জনকে মেরে লুঠ করেছিল তাঁদের সমস্ত গয়না। একের পর এক দেহ ওই পুকুর থেকে উদ্ধার করা হলেও কেউ ধরতে পারেনি ত্রৈলোক্যকে।
যেভাবে পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন ত্রৈলোক্যতারিণী দেবী
বহুবার অপরাধ করার পর পার পেয়ে গেলেও ষষ্ঠ বার আর সেটা হল না। কারন অপরাধের সময় ওই পরিত্যক্ত বাগানবাড়িতে এক জন ঢুকে পড়েছিল। যার ফলে ত্রৈলোক্য ধরা পড়ে গিয়েছিল এবং বেঁচে গিয়েছিল তার ষষ্ঠ শিকার। তবে এইবারেও প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল সে। শাস্তির হাত থেকে রেহাই পেলেও সোনাগাছির পুরনো পাড়ায় পড়শিদের বিশ্বাস সে ফিরে পায় না। যার কারনে সে সেখান ছেড়ে তার পালিত ছেলে হরিকে নিয়ে উঠেছিল চিৎপুরের পাঁচু ধোপানি লেনের এক বাড়িতে। সরাসরি সেই এলাকা নিষিদ্ধ না হলেও ওই বাড়ির বাসিন্দারা দেহব্যবসার সঙ্গেই জড়িত ছিল।
সেখানে থাকতে থাকতেই কয়েক বছরের মধ্যে আবার তার মধ্যে জাগ্রত হল রক্তের নেশা। এবার তার টার্গেটে ছিল ওই বাড়িরই আর এক ভাড়াটে তরুণী। মূলত তার গয়না লুঠ করাই ছিল তার আসল লক্ষ্য। এরপর শুরু করে ছক কষা। আর তার এই ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত ছিল আর এক ভাড়াটে। এরপর দু’জনে মিলে ওই তরুণীকে খাবারে মাদকদ্রব্য মিশিয়ে অচৈতন্য করে। এরপর শ্বাসরোধ করে তাকে খুন করে।
এই ঘটনার তদন্তভার দেওয়া হয়েছিল ওখানকার এক নেটিভ ডিটেকটিভ পুলিশ প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়কে। এর আগেও প্রমাণের অভাবে ত্রৈলোক্যকে হাতের কাছে পেয়েও তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়। তবে এই পাঁচু ধোপানির গলির হত্যাকাণ্ডে সে যাতে পালাতে না পারে তার জন্য একটি পরিকল্পনা করেছিলেন প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়।
এই ঘটনার জন্য প্রথমে ত্রৈলোক্যতারিণীকে গ্রেফতার করা হলেও প্রিয়নাথ তাকে মুক্তি দিয়েছিলেন। এরপর ত্রৈলোক্যতারিণীর পালিত ছেলে হরিকে গ্রেফতার করেছিলেন এবং রাজসাক্ষী করেছিলেন এই ষড়যন্ত্রে ত্রৈলোক্যতারিণীর সাথে জড়িত থাকা ওই ভাড়াটেকে। ঘটনাটিকে এমনভাবে সাজিয়েছিলেন যে, যাতে মনে হয় যে এই খুনটা হরিই করেছে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ীই সবাই সাক্ষ্যী দেন যে, এই ঘটনায় সাথে যে হরিই জড়িত তা নিয়ে তারা নিশ্চিত।অবশেষে প্রিয়নাথের পাতা ফাঁদের পা দিতে বাধ্য হয়েছিল ত্রৈলোক্যতারিণী। ছেলেকে বাঁচানোর জন্য স্বীকার করে নিয়েছিলেন তার অপরাধ। এরপর ওই তরুণীকে খুন করার পর তার থেকে যে সমস্ত গয়না লুঠ করেছিল সেই সমস্ত গয়না নিজের ঘরের লুকোনো জায়গা থেকে বের করে দিয়েছিলেন। এই ঘটনার জন্য তার শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল তাকে। এখানেই সমাপ্ত হয়েছিল তার জীবনের অধ্যায়। কলকাতার পুলিশের নথি অনুযায়ী মনে করার হয় যে সেই ছিলেন প্রথম সিরিয়াল কিলার। দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় তার পত্রিকা ‘দারোগার দপ্তর’ এ লিখেছিলেন তার বিচিত্র জীবনের কথা ।