ফিচার আর্টিকেল

বেথুন কলেজের পাশে আজও দেখা মেলে এক চিলতে ইতিহাসের

আমরা এমন অনেকেই আছি যারা বহু যুগ পুরোনো কোন জিনিস যা ইতিহাসের সাথে জড়িত রয়েছে, তা দেখলেই অতীত-আর্তি হয়ে পড়ি। সেটা নিজের জীবনের সাথে জড়িত ইতিহাস হতে পারে অথবা সর্বজনীন ইতিহাসও হতে পারে। যা আজও আপনাকে আমাকে প্রাচীন কোনো এক যুগে নিয়ে যায়  কল্পনার মধ্যে দিয়ে। এইরকম ইতিহাস আবৃত বহু জিনিস আজও কলকাতার আনাচে কানাচে দেখা যায়। যেমন- ভিক্টোরিয়া হল থেকে শুরু করে বিভিন্ন কলেজ, যে সমস্ত কলেজে বেশ নামিদামি লোকজন পড়াশোনা করেছেন, স্কটিশ চার্চ কলেজ,  বেথুন কলেজ  এই সবই অতীতের হাতছানি দেয়। 

তেমনি একটি অতীতের ইতিহাস আবৃত গির্জা হল  ক্রাইস্ট চার্চ। বেথুন কলেজের গা ঘেঁষে রয়েছে এই লাল রঙের গির্জা। এই গির্জা দেখেনি এমন মানুষ বোধ হয় কলকাতায় খুব কম আছে। কলকাতায় যাদের যাতায়াত আছে সে অফিস যাত্রী হোক অথবা স্কুল পড়ুয়া কিংবা কলেজ পড়ুয়া প্রায় সকলেই এই গির্জার সামনে দিয়ে নিত্যদিন রাস্তা পারাপার করেন। বর্তমানে এই গির্জাটির ঠিকানা ১৮২/বি, বিধান সরণী। প্রথমে অবশ্য এই সরণীর নাম বিধান সরণী ছিলনা, কর্নওয়ালিস স্ট্রিট নাম ছিল। আস্তে আস্তে সময়ের পরিবর্তন হয়েছে,  রাস্তার পরিবর্তন হয়েছে, হয়েছে নামের পরিবর্তন  আর আজও এই গির্জাটি সমস্ত পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। 

কিন্তু এই ক্রাইস্ট চার্চ কোন  ইতিহাসের সাক্ষী জানেন? 

শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয় জানাচ্ছেন, ১৮৩৯ সালে বিশপ উইলসন এই গির্জাটি নির্মাণ করেছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি নাগরিকের জন্য। এই বাঙালি নাগরিকের নাম হল কৃষ্ণমোহন। এই তথ্য দ্বারা এটা বোঝা যাচ্ছে যে তিনি কতটা ক্ষমতা সম্পন্ন লোক ছিলেন। ১৮১৩ সালে কলকাতার ঝামাপুকুর অঞ্চলে জন্মেছিলেন কৃষ্ণ মোহন। আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে তার পড়াশোনা শুরু হয় হেয়ার পাঠশালার হাত ধরে। তারপর স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে ১৮২৪ সালে অবৈতনিক ছাত্র হিসেবে তিনি হিন্দু কলেজে প্রবেশ করেন। কিছুদিনের মধ্যেই ডিরোজিওর সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপ করে ওঠে। একসময় কৃষ্ণমোহন ইয়ং বেঙ্গল-এর নেতাও হয়ে উঠলেন। পড়াশোনা, যুক্তিবোধ সমস্ত কিছুতেই তিনি তুখর ছিলেন। সেই সময় হিন্দুদের ধর্মীয় গোঁড়ামিকেও তার প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল।

১৮৩১ সালে পাথুরিয়াঘাটার প্রসন্ন কুমার ঠাকুর ‘রিফরমার’ নামে একটি পত্রিকা বের করলেন। সেটার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সেই বছরই মে মাসে কৃষ্ণমোহন প্রকাশ করলেন ‘Inquirer’ পত্রিকা। হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামিকে সেখানে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছিল। এর আগে ১৮৩০ সালে আলেকজান্ডার ডাফ এদেশে এলে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠপূর্ণ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল কৃষ্ণমোহনের। হিন্দু কলেজের প্রথা ভেঙে সেখানে যাতায়াত শুরু করেন তিনি। ১৮৩২ সালে তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। হিন্দু বাড়ির যে সমস্ত ছেলেরা এই হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেন তাদের সকলের পথ প্রদর্শক কৃষ্ণ মোহনকে বলা যেতেই পারে। স্বাভাবিকভাবেই বাড়ির সকলের বিরুদ্ধে গিয়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার জন্য তাকে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করা হয়। হ্যাঁ, এক ধর্মের খপ্পর ছেড়ে, অন্য ধর্মের খপ্পরেই পড়েছিলেন হয়তো। কিন্তু, তার ভিতরেও একটি প্রতিস্পর্ধার আগুন লুকিয়েছিল।

যে আগুনের ফলেই রাধাকান্ত দেবকে নিজের পত্রিকায় গাধাকান্ত দেব হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। কারণটি অনুমেয় সহজেই। ইংরেজ-তোষামোদ ও হিন্দুধর্মের অন্ধতাকে প্রশ্রয় দিতেন রাধাকান্ত দেব। অনেক পরে হলেও কৃষ্ণমোহনের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন তার স্ত্রী বিন্ধ্যবাসিনী দেবীও। এই ঘটনা সেই সময় কম আলোড়ন সৃষ্টি করেনি। ১৮৩৯ সালে তাঁর ছোটো ভাই কালীমোহনও খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। আর সেই বছরই তৈরি হয় এই ক্রাইস্ট গির্জা। কালীমোহনও এখানেই ছিলেন বেশ কিছুকাল। এখানেই প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের একমাত্র পুত্র জ্ঞানেন্দ্রমোহন খ্রিস্টধর্ম অবলম্বন করেন কৃষ্ণমোহনের কাছে। ফলে সেও ত্যাজ্যপুত্র হয়। কৃষ্ণমোহনের মেয়ে কমলমণির সঙ্গে বিয়ে হয় জ্ঞানেন্দ্রমোহনের। এই ঘটনারও সাক্ষী হয়ে আছে গির্জাটি। 

বর্তমানে ২০২৩ সালে দাঁড়িয়ে এই ঐতিহ্য সম্পন্ন গির্জাটি শুধুমাত্র একটি গির্জা হিসেবেই রয়ে গেছে। এই গির্জার বুকে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঐতিহাসিক ঘটনা প্রায় সকলে ভুলে গেছে বা বোধহয় অনেকেই সেই বিষয়ে অবগত নয়। আসলে ইতিহাস ব্যাপারটা বড়োই মজার এক ব্যাপার সেই সাবেকি কলকাতার মতোন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *