গ্রাম বাংলার পূজা

বাংলাদেশে কীভাবে দূর্গাপুজো শুরু হল? ওপার বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস

বাঙালিদের সবচেয়ে বড়ো উৎসব হল দূর্গাপূজা। দূর্গাপুজোর কথা মাথায় আসলেই সবার প্রথমে কলকাতার কথাই মনে পড়ে। মহালয়ার দিন থেকে শুরু করে একদম দশমী পর্যন্ত কলকাতা জমজমাট থাকে। 

 এ তো গেলো এপার বাংলার কথা। তবে ওপার বাংলায় অর্থাৎ বাংলাদেশে কীভাবে এই দূর্গাপুজো শুরু হল, তা নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত রয়েছে।

 বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা এবং সেখানেই অবস্থিত ঢাকেশ্বরী মন্দির। এই মন্দির বাংলাদেশের জাতীয় মন্দির হিসেবে পরিচিত।

লোকমুখে শোনা যায় প্রায় আটশো বছর আগে থেকেই ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শ্রী শ্রী ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পূজিত হন মা দূর্গা। এছাড়াও শ্রীহট্টের রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁওয়ে পূজিত হন লালবর্ণের দেবী। এই পুজো প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো। গোটা উপমহাদেশে এখানেই একমাত্র রক্তবর্ণা দূর্গা। এবছরের পুজোয় সেসব প্রাচীন মন্দিরে প্রস্তুতি তুঙ্গে।

৮০০ বছরের পুরোনো ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস কি? কিভাবে শুরু হয়েছিল এই পুজো?

শুরু থেকেই ঢাকেশ্বরী মন্দিরটি দূর্গা প্রতিমার স্থায়ী মন্দির। প্রথম দিকে এখানে ছিল অষ্টভূজার প্রতিমা। পরবর্তীকালে স্থাপন করা হয় দশভূজার দূর্গা প্রতিমা। ঢাকা ও তার আশেপাশের অঞ্চলগুলিতে এখনও বেশ কিছু দূর্গাপুজোর প্রাচীন ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। ১৮৩০ সালের পুরোনো ঢাকার সূত্রাপুর অঞ্চলে বসবাসকারী ব্যবসায়ী নন্দলাল বাবুর মৈসুন্ডির বাড়িতে ঢাকার সবচেয়ে বড়ো দূর্গাপুজোর আয়োজন করা হয়েছিল। ১৮৫৭ সালে সিপাই বিপ্লবের সময় বিক্রমপুর পরগনার ভাগ্যকূল জমিদার বাড়ির রাজা ব্রাদার্স স্টেটে এবং সাটুরিয়া থানার বালিহাটির জমিদার বাড়ির দূর্গাপুজোর আয়োজন করা হয়।

সেসময়ে সিদ্ধেশ্বরী জমিদার বাড়ি ও বিক্রমপুর হাউসেও জাঁকজমকপূর্ণ দূর্গাপুজোর আয়োজন করা হয়েছিল। ১৯২২-২৩ সালে ঢাকার আরমানিটোলায় জমিদার শ্রীনাথ রায়ের বাড়ির পুজোও বেশ বিখ্যাত ছিল।  মনে করা হয় ঢাকেশ্বরী মন্দিরের জন্যই এই জায়গার নাম ঢাকা হয়েছে। 

ঢাকেশ্বরী মন্দির ছাড়াও রয়েছে সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি, রামকৃষ্ণ মিশন, রমনা কালীবাড়ি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, কলাবাগান, উত্তরা এবং বনানীর পুজোয় মিশেছে আধুনিকতার রঙ। তবে এইখানে জাত-পাতে কোনোরকম ভেদাভেদ করা হয় না। পুজো মণ্ডপগুলিতে হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবধর্মের লোকজন আনন্দে সামিল হয় । এই স্থান যেন সমস্ত মানুষের মিলনস্থলে পরিনত হয়েছে।

অনেকের  মতে, ১৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের উত্তরের জনপদ জেলা রাজশাহীতে প্রথম দূর্গাপুজোর শুরু হয়। তাহিরপুরের মহারাজ কংস নারায়ণ প্রথম দূর্গাপুজোর প্রবর্তন করেন। রাজা কংস নারায়ণ ছিলেন বাংলার বারো ভূঁইঞার এক ভূঁইঞা। সেসময় রাজা কংস নারায়ণ প্রভূত ভূ-সম্পত্তির অধিকারী হন। তখনকার রাজাদের মাঝে নিজের সামাজিক প্রতিপত্তি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে তিনি এই পুজো শুরু করেন। সে সময়ের হিসেবে প্রায় আট লক্ষ টাকা ব্যয় করেছিলেন।

ওই একই বছর বসন্তকালে রাজশাহীর ভাদুরিয়ার মহারাজ জয় জগৎ নারায়ণ বেশ জাঁকজমকভাবে বাসন্তী পুজোর আয়োজন করেছিলেন। তিনি কংস নারায়ণকে টেক্কা দেওয়ার জন্য সেই পুজোয় প্রায় নয় লক্ষ টাকা খরচ করেন। আঠারো শতকে দেশের দক্ষিণের জেলা সাতক্ষীরার কলারোয়া থানার মঠবাড়িয়ার নবরত্ন মন্দিরে দূর্গাপুজো হতো বলে বিভিন্নজনের লেখায় পাওয়া যায়।

বিংশ শতকের শুরুর দিকে বাংলাদেশে দূর্গাপুজো সমাজের বিত্তশালী এবং অভিজাত হিন্দু পরিবারদের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। গত শতাব্দীর শেষের দিকে এবং এই শতাব্দীর শুরুর দিকে দূর্গাপুজো তার সার্বজনীনতার রূপ পায়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর এককভাবে সম্পূর্ণ দায়িত্ব সহকারে দূর্গা পুজো করাটা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে ওঠে। এইসময় অভিজাত এবং বিত্তশালী হিন্দুদেরও প্রভাব-প্রতিপত্তি কমতে শুরু করে। ফলে সারা বাংলাদেশে এককভাবে দূর্গাপুজো থেকে প্রথমে বারোয়ারি এবং তারপরে সার্বজনীন পুজোর চল শুরু হয়। সার্বজনীন পুজোর চল শুরু হওয়ার পর থেকেই দূর্গোৎসব বাঙালির জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। সার্বজনীন দূর্গা পুজো প্রচলন হওয়ার পর থেকেই সর্বস্তরের মানুষের কাছে পুজোর আকর্ষণ বৃদ্ধি পেতে থাকে।

শ্রীহট্টের মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁওয়ে উপমহাদেশের একমাত্র লাল বর্ণের দুর্গা দেবী পূজিত হয়ে থাকেন। এই পুজো প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো। লাল রঙের মা দূর্গাকে দেখার জন্য দেশ ও দেশের বাইরে থেকে অনেক দর্শনার্থী এখানে ছুটে আসে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *