আমেরিকা দ্বারা আল কায়েদা লিডার আয়মান আল জাওহারিকে হত্যা এবং আল কায়েদা তৈরির ইতিহাস
আমেরিকা বিশ্বের অন্যতম কুখ্যাত জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদার নেতা আয়মান আল জাওহারিকে হত্যা করল আমেরিকা। আজ থেকে এগারো বছর আগেও আলকায়েদার লিডার ওসামা বিন লাদেনকেও আমেরিকা হত্যা করেছিল। আমেরিকান রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন ঘোষনা করেছে তারা ড্রোন স্ট্রাইকে আফগানিস্তানের কাবুলে আয়মান আল জাওহারিকে হত্যা করেছে এবং এর মাধ্যমে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জঙ্গি হামলায় নিহত হওয়া ২৯৭৭ জন মানুষের পরিবারকে সুবিচার করা হয়েছে। তবে কীভাবে মারা হয়েছে, পুরো অপারেশন সম্পর্কে এখনও তেমন কীছু জানায়নি আমেরিকা। এই যে জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদার কথা বলা হচ্ছে জানেনকী এই সংগঠন কীভাবে তৈরি হয় কিংবা এই সংগঠন বিভিন্ন সন্ত্রাসী কাজ কর্মের মাধ্যমে বিশ্ব রাজনীতি পরিবর্তন করে দেয়? এবিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। সাথে এটাও আলোচনা করা হবে আফগানিস্তানের বুকে তৈরি হওয়া এই কুখ্যাত জঙ্গি সংগঠন ও আমেরিকার মধ্যে ঝামেলার ইতিহাস সম্পর্কে এবং এর ফলে জিও পলিটিক্সে পরিবর্তন সম্পর্কে।
প্রথমেই জানা যাক আল-কায়েদার ইতিহাস সম্পর্কে। আল কয়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেনের জন্ম সৌদি আরবের এক বিখ্যাত ধনী পরিবারে যার বাবা একটি বিশাল কনস্ট্রাকশন সংস্থার মালিক ছিল। সৌদি আরবের রাজ পরিবারের সাথেও সম্পর্ক ছিল লাদেনের বাবার। অর্থাৎ ওসামা বিন লাদেন এমন পরিবারের ছেলে ছিল যার সুখ, সুবিধা কোনও কীছুরই অভাব ছিল না। কিন্তু প্রথম থেকেই লাদেনর মুসলিম বিশ্বে চলা রাজনৈতিক ঝামেলাতে বেশী আগ্রহ ছিল। ৯/১১ এর আগে ওসামা বিন লাদেন এবং আল কায়েদাকে খুব কম লোকেই চিনত। আল কায়েদার উত্থান লুকিয়ে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চলা শীতল যুদ্ধের সময়ই। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমন করে এবং ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত আফগান যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট সরকারকে সমর্থন করেছিল। এই সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে স্থানীয় আফগান যুবকরা একটি ধর্মযুদ্ধ বা জিহাদ ঘোষনা করে। এদের আফগান মুজাহুদ্দিন বলা হত। ওসামা বিন লাদেন এবং আমেরিকা এদের অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য করত। পরে একজন প্যালেস্টাইনি সুন্নি ইসলামিক শিক্ষক আবদুল্লাহ আজামের সাথে যৌথভাবে একটি অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করে।
১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাবার পর আল কায়েদা তৈরি হয় ভবিষ্যতের জিহাদের জন্য। এই বছরই আবদুল্লাহ আজামের মৃত্যু হয় ফলে ওসামা বিন লাদেন এই সংগঠনের নেতা হয়ে ওঠে। সৌদি আরব, ইসরায়েল এবং মিশরের সরকারকে আমেরিকার সমর্থনের বিরোধীতা করে লাদেন। প্যালেস্টাইন প্রেমী লাদেন প্যালেস্টাইনের ঝামেলার জন্য আমেরিকা ও ইসরায়েলকে দায়ী মনে করত। ১৯৯১ সালে পার্সিয়ান গল্ফ যুদ্ধ, সোমালিয়ায় অপারেশন রিসটোর হোপ এবং সৌদি আরবে আমেরিকার উপস্থিতির কারনেও আমেরিকার উপর ক্ষোভ ছিল আল-কায়েদার। আল-কায়েদার প্রধান লক্ষ হয়ে দাঁড়ায় আমেরিকা, ইহুদি এবং তাদের বন্ধুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা। এরজন্য আল কায়েদা মধ্য প্রাচ্য, এশিয়া, আফ্রিকা জুড়ে ছোট ছোট সন্ত্রাসী হামলা শুরু করে যাতে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। তবে নিজেদের গুরুত্ব বাড়াতে আল কায়েদা ছোট ছোট আক্রমন বাদ দিয়ে ৯/১১ এর মতন বড় আক্রমন করে আমেরিকায় যাতে ৩০০০ লোক মারা যায়। গোটা বিশ্ব স্তব্ধ হয়ে যায় এই ঘটনায়। এই প্রথম আমেরিকার মতন সুপার পাওয়ারের উপর এরকম সন্ত্রাসবাদী আক্রমন হয়। এরপরই বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমেরিকার লড়াই শুরু হয় যা বিশ্বের জিওপলিটিক্সকে নতুন দিকে পরিচালিত করে।
ওসামা বিন লাদেনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল আমেরিকায় আক্রমন করা। সিআইএ এর অ্যাবটাবাদ পেপারে বলা হয়েছে লাদেনের আধুনিক আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে কোন জ্ঞান ছিলনা। দি বিন লাদেন পেপারস বইয়ে লেখা হয়েছে লাদেন কোনদিন কল্পনাও করেনি আমেরিকা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে দেবে। লাদেন ভেবেছিল তার এই আক্রমনের ফলে ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতন আমেরিকার সাধারন মানুষ প্রতিবাদ করবে যার ফলে আমেরিকা মুসলিম দেশগুলোতে নিজেদের প্রভাব খাটাবেনা। কিন্তু হল পুরো উল্টো আমেরিকার সাধারন মানুষ আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে সমর্থন করে। যার ফলে ২০০১ সালের অক্টোবরে আমেরিকা আফগানিস্তান আক্রমন করে। আফগানিস্তানে তখন তালিবান নামে একটি জঙ্গি সংগঠন রাজত্ব করছিল। তালিবান ১৯৯৬ সাল থেকে আল কায়েদাকে আফগানিস্তানে নিরাপত্তা দিচ্ছিল। আমেরিকান সেনা তালিবানকে আফগানিস্তানের শাসন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আল কায়েদার বিভিন্ন ক্যাম্পে আক্রমন শুরু করে। এই পুরো ঘটনার জন্য একদম প্রস্তত ছিলনা ওসামা বিন লাদেন। আল কায়েদার বেশীরভাগ জঙ্গি পাকিস্তান ও ইরানে পালিয়ে যায় ভয়ে। ৯/১১ এর আক্রমন লাদেনের জন্য তখন দুঃস্বপ্নে পরিনত হয়েছিল। বর্তমান আমেরিকান রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন বলেন আমেরিকা ২০০১ সালে আফগানিস্তান আক্রমন করেছিল আল কায়েদাকে শেষ করতে কিন্তু অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞ বলেন আমেরিকার শুধু আল কায়েদাকে আক্রমন মূল লক্ষ ছিলনা। আমেরিকা মধ্য প্রাচ্যে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে চাইছিল, ৯/১১ এর আক্রমন আমেরিকাকে আফগানিস্তান আক্রমনের সুযোগ করে দেয়। নাহলে তালিবানকে পরাস্ত করার পর আমেরিকা খুব সহজেই আল কায়েদাকে শেষ করে দিতে পারত কিন্তু তা না করে ২০০৩ সালে ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে জন বিধ্বংসী অস্ত্র রাখার অভিযোগে আক্রমন করে আমেরিকা। পরে জানা যায় সাদ্দাম হোসেনের কাছে এমন কোন অস্ত্র ছিলই না!!
আমেরিকার এই ইরাক আক্রমন আল কায়েদার পুনর্গঠনে বড় ভূমিকা রাখে। ইরাকে আল কায়েদার একটি নতুন সংগঠন তৈরি হয় যার দায়িত্বে ছিল আবু মুসাব আল জারকাওয়ি। এর পরেও ২০১১ সালে ওবামা প্রশাসনের সময়ে আমেরিকা আবার লিবিয়া আক্রমন করে। আমেরিকার এই একের পর এক যুদ্ধ এবং ওসামা বিন লাদেনের ভুল চিন্তাভাবনার পুরো মধ্য প্রাচ্য অশান্ত হয়ে পড়ে। আমেরিকা ভেবেছিল তারা তাদের এডভান্সড মিলিটারি ফোর্সের দ্বারা সরকার পরিবর্তন করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে কিন্তু জঙ্গি সংগঠন গুলো আমেরিকার আক্রমনের ঘটনাকে বিদেশী আক্রমন বলে সাধারন স্থানীয় মানুষদের ভুল বুঝিয়ে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ করে তোলে, চারিদিকে অরাজকতা শুরু হয়। ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তানে বিভিন্ন উগ্রবাদী সংগঠন তৈরি হয়। মধ্য প্রাচ্যে এই অশান্তির আগুন উত্তর আফ্রিকাতেও পৌঁছে যায়। আমেরিকা সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি বাসার আল আসাদের বিরুদ্ধেও ছায়া যুদ্ধ শুরু করে। এই বাসার আল আসাদলে আবার রাশিয়া সমর্থন করে। সুতরাং সিরিয়াতে এই সময় আইএসআইএস নামে একটি আরও কুখ্যাত জঙ্গি সংগঠন তৈরি হয় যাদের সাথে আল কায়েদার নেতাদের একটি সম্পর্ক ছিল। এর ফলে বিশ্ব রাজনীতিতে বিশাল পরিবর্তন আসে।
মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ দেশ গুলোতে আমেরিকান বিরোধী মোনোভাব তৈরি হতে থাকে এবং আমেরিকা সহ পশ্চিমা দেশ গুলোতে মুসলিম বিরোধী মোনোভাব তৈরি হতে শুরু করে। এর ফলে ইউরোপের আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে ২০০৮ সাল থেকে দক্ষিন পন্থী রাজনৈতিক দল গুলো ক্ষমতায় আসতে শুরু করে। লিবিয়া, ইরাক, সিরিয়াতে এই অস্থিরতার ফলে স্থানীয় জনগনকে কড়া মূল্য চোকাতে হয়। ২০০১-১৫ এর দিকে এসব দেশ গুলো থেকে লোক কাতারে কাতারে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আসতে শুরু করে। গোটা ইউরোপ জুড়ে শরনার্থী সমস্যা ভয়ানক আকার নেয় এবং এর সুযোগ নিয়ে আইএসআইএস ইউরোপের কিছু জায়গায় হামলা করে। এতে ইউরোপে দক্ষিন পন্থী রাজনৈতিক দল গুলো আরও শক্তিশালী হয়। ১৯৯১ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায় এবং ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হয় তখন বিখ্যাত দার্শনিক ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা তার বই দি এন্ড অফ হিস্ট্রি এন্ড দি লাস্টম্যানে লেখেন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথে সাথে বিশ্বে শুধুমাত্র একটিই সুপার পাওয়ার রয়ে গেল তা হচ্ছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। এদিকে মধ্য প্রাচ্যে আমেরিকার ব্যাস্ত থাকার সুযোগে চীন নিজেকে শক্তিশালী করে তোলে। যতক্ষন আমেরিকা এটা বুঝতে পারে ততক্ষনে চীন বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিশালী অর্থনৈতিল দেশে পরিনত হয়েছে। তবে ২০০১ সালে আফগানিস্তানে আমেরিকা আল-কায়েদার বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষনা করছিল তাতে যথেষ্ট সাফল্য পেয়েছে আমেরিকা। অপারেশন নেপচুন স্ফিয়ারের মাধ্যমে পাকিস্তানের অ্যাবটাবাদে লুকিয়ে থাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী আল কায়েদার লিডার ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করে আমেরিকা। আমেরিকার ভয়েই আল কায়েদা ভেঙে এই সংগঠনের সদস্যরা বিভিন্ন অন্য সংগঠনে যোগ দেয়।
আগেই বলেছি গত ৩০ জুলাই আমেরিকা আয়মান আল জাওহারিকে যে হত্যা করেছে। এর মাধ্যমে আরও একবার আল কায়েদার উত্থানকে আটকে দিল আমেরিকা। এই আল জাওহারি আল কয়েদার প্রধান লিডার ছিল। ১৯৯৫ এর দিকে ভারত আমেরিকাকে বারবার বলছিল আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে আল কায়েদা সক্রিয় হচ্ছে কিন্তু আমেরিকা শোনে নি। আমেরিকা ভেবেছিল তারা এত দূরে থাকে তাদের আর কী ক্ষতি হবে। কিন্তু টুইন টাওয়ারে আক্রমনের পর আমেরিকার ভুল ভাঙে। এই আয়মান আল জাওহারি আল কায়েদার গঠনের সময় থেকে যুক্ত এই সংগঠনে। ১৯৯৬ সালের পর তানজানিয়ার এমব্যাসিতে আক্রমন, কেনিয়ার এমব্যাসিতে আক্রমন এসবের পেছনে আল জাওহারিই ছিল। মিশরের সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মানো আয়মান আল জাওহারি পেশায় ডাক্তার ছিল। সৌদি আরবে তার সাথে ওসামা বিন লাদেনের পরিচয় এবং তখন থেকেই আল কায়েদা গঠন শুরু হয়। লাদেনের মৃত্যুর পর পুরো আল কায়েদার পুনর্গঠন আল জাওহারিই করছিল। তালিবান ও আইএসআইএসের তুলনায় পিছিয়ে পড়া আল কায়েদাকে ২০১৮-১৯ থেকে শক্তিশালী করছিল আল জাওহারিই। সুতরাং তাকে মেরে আমেরিকার বিশাল বড় কৃতিত্ব, বলতে গেলে এক কথায় আল কায়েদার মেরুদন্ড ভেঙে দিল আমেরিকা।