অফবিট

‘ সেভেন সিস্টার্স স্টেটস ‘। গ্রীষ্মের ছুটিতে ঘুরে আসবেন নাকি?

গ্রীষ্মের দাবদাহ ,সারাদিন অফিসে কাজের চাপের  মধ্যে মন চায় একটু নিরিবিলিতে কিছুটা সময় কাটিয়ে আসতে। এই গরমে তাই পাহাড়ের চেয়ে ভালো ঘোরার জায়গা আর কিছু হয় না । একটু অফ বিট জায়গা যারা খুঁজছেন তাদের জন্য উত্তর-পূর্ব ভারত একেবারে আদর্শ স্থান। গারো খাসির কোলে সবুজ বিস্তর উপত্যকা উত্তর-পূর্ব ভারতের মূল আকর্ষণ। এখানকার ভূপ্রকৃতি এখানকার সংস্কৃতির মতই বৈচিত্র্যপূর্ণ । এখানকার স্থানীয় মানুষদের গভীর আতিথিয়তা, সহজ-সরল পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন এবং বর্ণময় উৎসবগুলো পর্যটকদের কাছে এই অঞ্চলের আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এখনও পর্যন্ত ভারতের অন্যান্য বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র গুলির মত উত্তর-পূর্ব ভারতের এই রাজ্যগুলি অতটা জনপ্রিয়তা লাভ না করলেও ভারতের উত্তর-পূর্ব  অঞ্চলের এই সেভেন সিস্টার্স স্টেটসগুলিকে ভারতের অনাবিষ্কৃত স্বর্গ বলা হয়ে থাকে ।

উত্তর পূর্ব ভারত নিঃসন্দেহে আমাদের প্রিয় গন্তব্য গুলির মধ্যে অন্যতম এবং যখনই ইচ্ছে হয় বারবার ফিরে যেতে পারি এই মেঘের রাজ্যে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে এই রাজ্যগুলির মধ্যে মিল থাকলেও ভূ-প্রকৃতিগত দিয়ে প্রত্যেকটি রাজ্য নিজেদের মত সুন্দর এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ । উত্তর-পূর্ব ভারত ঘুরতে যাওয়ার সঠিক সময় অক্টোবর থেকে মে এর মাঝামাঝি । এ সময় আকাশ যেমন পরিষ্কার থাকে তেমনি বিভিন্ন উৎসবে মেতে ওঠে রাজ্য গুলি।

উত্তর-পূর্ব ভারত অসম, অরুণাচল প্রদেশ, মেঘালয়, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, সিকিম এবং ত্রিপুরা আটটি রাজ্য নিয়ে গঠিত। সেখানে  একদিকে যেমন রয়েছে ঘন বনভূমি তেমনি রয়েছে তুষারাবৃত পর্বত, অসংখ্য হ্রদ, জলপ্রপাত, সবুজে ঘেরা উপত্যকা , এবং বহু প্রাচীন বৌদ্ধ মঠ। 

এই অঞ্চলে ৬৫ মিলিয়ন মানুষ এবং প্রায় ৪০০ টি উপজাতি রয়েছে। জাতিগত বৈচিত্র্যের মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাভাষীরা, চীনের তিব্বত-বর্মী এবং গাঙ্গেয় সমভূমি থেকে ইন্দো-আর্যরা। এখানে সংস্কৃতির ভিন্নতা এতটাই যে একএকটি গ্রামের লোকজন একেক রকম  সংস্কৃতির চর্চা করে ।  তারা বিভিন্ন রীতিনীতি, ঐতিহ্য এবং বিশ্বাস মেনে চললেও একটি জিনিস যা উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষকে এক সুতোয় আবদ্ধ করে তা হল সরলতা।

এখানকার বেশিরভাগ উৎসব গুলো ফসল কাটা এবং নতুন বছরকে কেন্দ্র করে উদযাপিত  হয় ।  এর মধ্যে কিছু জনপ্রিয় উৎসব হল – অসমের বিহু,নাগাল্যান্ডের হর্নবিল উৎসব , মণিপুরে চেরাওবা উৎসব, মিজোরামের চাপচার কুট উৎসব, অরুণাচল প্রদেশে সিয়াং নদী উৎসব , সিকিমে সাগা দাওয়া উৎসব। উৎসব গুলি বিভিন্ন উপজাতির লোকেদের মেল বন্ধনের একটি দুর্দান্ত সুযোগ।

মন থেকে যারা ভ্রমণ প্রেমী। তাদের জীবনে একবার হলেও উত্তর-পূর্ব ভারত ঘুরে আসা উচিত।  প্রতিবেশী দেশ তিব্বত, ভুটান, মায়ানমার ,বাংলাদেশের মাঝে নৈসর্গিক সৌন্দর্য ভরপুর উত্তর-পূর্ব ভারত।

আসুন জেনে নেওয়া যাক উত্তর-পূর্ব ভারতের পর্যটন কেন্দ্র গুলির বিস্তর  বিবরণ

অসম

অসম উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার । অসম ভারতের একমাত্র রাজ্য যা ৬ টি রাজ্যের সঙ্গে  যুক্ত। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত রাজ্যটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। অসম ভারতের বৃহত্তম চা উৎপাদক রাজ্য। চারিদিকের বিস্তৃত চা বাগানে ঘেরা মনোরম পরিবেশ , বিস্তৃত ধানের ক্ষেত মন ভালো করার জন্য যথেষ্ট । দর্শনীয় স্থান গুলির মধ্যে এখানে  রয়েছে কাজিরাঙ্গা ন্যাশনাল পার্ক , রাজধানী গুয়াহাটিতে রয়েছে বিখ্যাত কামাখ্যা মায়ের মন্দির। ৫১সতী পীঠের মধ্যে অন্যতম সতীপীঠ কামাক্ষা মন্দির। অসম যাত্রাটা আপনি গুয়াহাটির এই কামাখ্যা মন্দিরে পুজো দিয়ে শুরু করতে পারেন ।  জুলাই মাসে তিন থেকে চার দিন এই মন্দিরে অম্বুবাচী মেলা হয়।  হাজার হাজার সাধু এবং তান্ত্রিক বহুদূর থেকে এই সময়ে এসে হাজির হয় মন্দিরে। গুয়াহাটিতে আরও রয়েছে দক্ষিণ ভারতীয় স্থাপত্যে তৈরি পূর্ব তিরুপতি বালাজী মন্দির। গুয়াহাটি থেকে মাত্র দুই কিমি দূরেই রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম নদীর দ্বীপে অবস্থিত  উমানন্দ মন্দির। ব্রহ্মপুত্র নদীর মাঝে অবস্থিত এই মন্দির।সেখান থেকে কিছু দূরেই রয়েছে অসম স্টেট জু। গুয়াহাটি থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে পবিডোরা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। এখানেই দেখতে পাবেন বিখ্যাত এক সিং এর রাইনো।

লোকপ্রিয় গোপীনাথ বরদলৈ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর,গুয়াহাটি রেল স্টেশন এবং গুয়াহাটি বাস স্ট্যান্ড  এর মাধ্যমে যে কোন রাজ্য থেকে অসমের রাজধানী গুয়াহাটি আসা যাবে ।

মেঘালয়

মেঘের রাজ্য মেঘালয়। চারিদিকে বিস্তৃত সবুজ পাহাড় আর পৃথিবীর সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল স্থান মৌসিনরাম। মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জির গোটা এলাকাকে মেঘেরা যেনো এক মায়ার চাদরে ঢেকে রয়েছে  সবসময়। যার সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা সত্যিই  মুশকিল। চেরাপুঞ্জিতে রয়েছে  পৃথিবীর সবচেয়ে পরিষ্কার গ্রাম মাওলিনং, এলিফ্যান্ট ফলস, সেভেন সিস্টার্স ফলস , মাওম্বুইন গুহা, লিভিং রুট ব্রিজ। বাংলাদেশ এবং ভারতের সীমান্তে অবস্থিত ডাউকি লেক এ নৌকা ভ্রমণ সারা জীবনেও না ভোলার মতো। কাঁচের মত স্বচ্ছ এই ডাউকি লেকের জল। মেঘালয়ে রয়েছে এমন একটি গ্রাম যেখানে প্রত্যেকের নাম শিসের সুরে । গ্রামটির নাম হুইসলিং ভিলেজ ।

 অরুণাচল প্রদেশ

তাওয়াং উপত্যকা চিরকালের জন্য অরুণাচল প্রদেশ  এমনকি উত্তর-পূর্ব ভারতে ভ্রমণের জন্য সেরা স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০ হাজার ফুট উপরে অবস্থিত তাওয়াং মনেস্ট্রি,বহু উচ্চতম রাস্তা এবং মনোরম হ্রদ  এই অঞ্চলের আকর্ষণ।  জিরো উপত্যকা এবং  এখানকার বিখ্যাত জিরো উৎসব অরুণাচল প্রদেশ ভ্রমণের অন্যতম মুক্ষ আকর্ষণ। এই রাজ্যে রয়েছে  নামদাফা জাতীয় উদ্যান যা একসঙ্গে  বাঘ, চিতাবাঘ, তুষার চিতা এবং মেঘযুক্ত চিতাবাঘের সুরক্ষিত আবাসস্থল। এটি দেশের  তৃতীয় বৃহত্তম পার্ক এবং এটি জীববৈচিত্র্যের জন্য একটি হটস্পট। রয়েছে  সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তেরো হাজার ৭৫০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত সেলা পাস। বেশিরভাগ সময়ই এই হ্রদটি বরফাবৃত থাকে। 

মণিপুর

আক্ষরিক অর্থে ‘ মনির দেশ ‘মনিপুর। এই রাজ্য  যেমন সুন্দর সংস্কৃতি এবং সুন্দর  লোকে ভরপুর তেমনি নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর এই রাজ্য। মণিপুর ভারতের সুইজারল্যান্ড হিসেবেও পরিচিত।  মণিপুরে দেখার মতো অনেক জায়গা রয়েছে। মনিপুরের সেরা পর্যটন কেন্দ্র গুলির মধ্যে অন্যতম সেনাপতি । অঞ্চলটির ৪০ % অংশ  সবুজ আচ্ছাদনে আবৃত । এখানে অবস্থিত গ্রামগুলিতে  সহজ সরল মানুষ এবং তাদের বানানো অসাধারণ খাবার পর্যটকদের কাছে যথেষ্ট জনপ্রিয়  । ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এখানকার খাবারের স্বাদ একেবারে অন্যরকম । লঙ্কা ,গোলমরিচ , ন্যূনতম তেলের ব্যবহারে তাদের বানানো স্বাস্থ্যকর খাবার খুবই জনপ্রিয় । এখানকার  অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হল ইম্ফল। লোকতাক লেক, কাঙলা ফোর্ট, সিরোহি ন্যাশনাল পার্ক, মণিপুর স্টেট মিউজিয়াম, শ্রী গোবিন্দাজি মন্দির হল এখানকার বিখ্যাত ঘোরার  জায়গা । পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া বিষ্ণুপুর এর মতোই মনিপুরেও রয়েছে বিষ্ণুপুর। একবার দেখে মনে হবে যেন পশ্চিমবঙ্গের বিষ্ণুপুরেই চলে এসেছেন আপনি। প্রাচীন মন্দিরের জন্য বিখ্যাত এই স্থান। এখানকার আরাধ্য দেবতা বিষ্ণু।  আরও কয়েকটি সুন্দর জায়গা হল উখরুল , চুরাচাঁদপুর,  চান্দেল । চান্দেল  হল মায়ানমারের প্রবেশদ্বার । 

মিজোরাম

উত্তর-পূর্ব ভারতের সবচেয়ে দক্ষিণের রাজ্য মিজোরাম। নীল পর্বতের দেশ মিজোরাম। ফাঁগুই মিজোরামের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ যা স্বয়ং ঈশ্বরের আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। মিজো পাহাড়ের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে ডাম্পা অভয়ারণ্য। মিজোরামে দর্শনীয় স্থান গুলির মধ্যে আরও রয়েছে সিবুতা লাং, তুলা চাং। লাওয়াং, সোনাই, তুইভাই, কোলোদাইন এবং কর্নফুল্লির মত বেশ কয়েকটি নদী রয়েছে মিজোরামে ।

নাগাল্যান্ড

মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে নাগাল্যান্ড ধীরে ধীরে উত্তর-পূর্ব ভারতের জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র গুলির মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠেছে । নাগাল্যান্ডের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হল কোহিমা যা নাগাল্যান্ডের রাজধানী। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য যেমন  বিখ্যাত তেমনি এখানে রয়েছে ওয়ার সেমেট্রি যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শহীদ সৈনিকদের মৃতদেহ সমাধিত করা হয়েছে। নাগা সংস্কৃতি এবং খাবার-দাবার নিয়ে পালিত হর্নবিল ফেস্টিভাল পালিত হয় কোহিমা থেকে সামান্য দূরত্বে কিসামা গ্রামে। যা নাগাল্যান্ডের পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ। ডিসুকো ভ্যালি নাগাল্যান্ডের ওপর একটি  গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র। পাহাড়প্রেমীরা এখানে ট্রেক করতে ছুটে যায় বরাবর। আরও রয়েছে ইতিহাস, শিল্প এবং হস্ত শিল্পের জন্য বিখ্যাত টুয়েনসাং গ্রাম । নাগা গোষ্ঠীর মত স্থানীয় জীবনযাপন করতে পারেন তুফেমা গ্রামে গিয়ে ।

 ত্রিপুরা

ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা। ত্রিপুরায় প্রচুর দর্শনীয় স্থান রয়েছে। ভ্রমণ প্রেমী মানুষদের কাছে তাই ত্রিপুরা একটি আকর্ষণীয় ভ্রমণ স্থান। আগরতলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বিশাল উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ।  প্রাসাদটির নামকরণ করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আগরতলায় অবস্থিত আরেকটি প্রাসাদ হল কুঞ্জবন প্রাসাদ। আগরতলা শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে রয়েছে সিপাহিজালা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ,বাংলাদেশ সীমান্তে রয়েছে কমলাসাগর লেক। আকর্ষনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য এই লেক ত্রিপুরার  অন্যতম পিকনিক স্পট। ত্রিপুরা সফরে গিয়ে নীরমহল একেবারেই বাদ দেওয়া যায় না।  এই রাজ্যের অন্যতম সুন্দর দর্শনীয় স্থান নীরমহল। নীরমহল এর নৌকা ভ্রমন এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত।  আগরতলা থেকে বেশ কিছু দূরে অবস্থিত জম্পুই পাহাড়। অ্যাডভেঞ্চারের  জন্য ট্রেক করে চরতেই পারেন এই পাহাড়ে সঙ্গে উন্নতমানের কমলালেবু উৎপন্ন হয় এই অঞ্চলে ।

সিকিম

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৩১০ মিটার উপরে নাথুলা পাসে বাইক নিয়ে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সারা জীবন মনে রাখার মতো। এছাড়াও গুরুডংমার লেক, ছাঙ্গু লেক, বাবা মন্দির , সোমগো লেক , লাচেন, লাচুং প্রত্যেকটি স্থানের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য আপনাকে বারবার টেনে নিয়ে যাবে সিকিমে। প্রাচীন বৌদ্ধ মঠ ছড়িয়ে রয়েছে সিকিমের চারিদিকে । সিকিমকে উত্তর-পূর্ব ভারতের সেভেন সিস্টার্স স্টেটস এর একমাত্র ব্রাদার স্টেট  বলা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *