ডিফেন্স

আন্তর্জাতিক আঙিনায় আবারও কি যুদ্ধের পূর্বাভাস? পশ্চিম সাহারাকে কেন্দ্র করে ঝামেলা শুরু আলজেরিয়া ও স্পেনের

রাজেশ রায়:—  আফ্রিকার একটি ছোট দেশ হচ্ছে পশ্চিম সাহারা যার সাথে দীর্ঘদিন ধরে বিবাদ চলছে মরক্কোর। এই বিবাদের কারনে আলজেরিয়া ও স্পেন নিজেদের মধ্যে সমস্ত ধরনের বানিজ্য বন্ধ রেখেছে। আলজেরিয়া ও স্পেনের মধ্যে বিগত ২০ বছর ধরে ভাল সম্পর্ক রয়েছে। অনেক সেক্টরে দুই দেশ একসাথে কাজ করে। আলজেরিয়া স্পেনের এনার্জির অন্যতম বড় উৎস। আলজেরিয়া স্পেনে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করে। কিন্তু পশ্চিম সাহারাকে কেন্দ্র করে এই দুই দেশ এখন নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক কেন খারাপ করছে সেই বিষয়ে আলোচনা করা হবে।

পশ্চিম সাহারা আফ্রিকার উত্তর পশ্চিম উপকূলে একটি বিতর্কিত অঞ্চল। যার ২০ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রন করে সারাওয়ি আরব ডেমোক্রেটিক পার্টি বা এসএডিআর এবং বাকী ৮০ শতাংশ এলাকা দখল করে রেখেছে মরক্কো। যদি ম্যাপে পশ্চিম সাহারার অবস্থান দেখা যায় দেখা যাবে পশ্চিম সাহারার উত্তর পূর্ব দিকে রয়েছে মরোক্ক, পূর্ব দিকে রয়েছে আলজেরিয়া এবং দক্ষিন পূর্ব দিকে রয়েছে মৌরিতানিয়া। মরক্কো পশ্চিম সাহারার ভূমি নিজেদের বলে দাবি করে, এর আগে মৌরিতানায়াও তাই করত। অন্যদিকে আলজেরিয়া পশ্চিম সাহারা কে সমর্থন করে। স্পেনও এখানে যুক্ত আছে। প্রথমে একটু ইতিহাস জানা যাক। একটা ইউরোপীয়ান সাম্রাজ্যবাদ এশিয়া ছাড়িয়ে আফ্রিকাতেও ছড়িয়ে পড়ে। আফ্রিকার দেশ গুলোকে ইউরোপের বিভিন্ন শক্তি যেমন ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, ইটালি দখল করে নেয়। এই পশ্চিম সাহারা ছিল স্পেনের দখলে। এই জন্য এখানে স্পেনও যুক্ত আছে। তবে আফ্রিকার একটি দেশ হচ্ছে ইথিওপিয়া যা কোনওদিন কোনও দেশের অধীনে আসেনি তেমন। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ইটালির মুসোলিনী ইথিওপিয়া কিছু সময়ের জন্য দখল করেছিল কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইথিওপিয়া মুক্ত হয়ে যায়। ১৯৭৫ অবধি পশ্চিম সাহারা স্পেনের অধীনে ছিল। এবার হয়ত অনেকেই ভাববেন ১৯৪৫ এর দিকে তো জাতিসংঘ তৈরি হয়ে গেছিল, তখনও পরাধীনতা ছিল! দেখুন পশ্চিম সাহারাকে জাতিসংঘের নন সেল্ফ গভর্নিং জায়গার তালিকায় রাখা হয়েছিল কারন পশ্চিম সাহারাতে স্বাধীনতা আন্দোলন তেমন হয়নি। কিন্ত ১৯৫৭ সালে মরক্কো পশ্চিম সাহারাকে নিজেদের ভূমি বলে দাবি করে। 

১৯৬৫ সালে জাতিসংঘ স্পেনকে আদেশ দেওয়া হয় পশ্চিম সাহারাকে স্বাধীন করে দেবার জন্য। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৫ সালে স্পেন পশ্চিম সাহারা থেকে চলে যায়। তবে ইতিহাস সাক্ষী আছে, যেকোনও ঔপনিবেশিক শক্তি নিজের উপনিবেশ ছাড়বার আগে সেই জায়গার পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে দিয়েছে। স্পেনও তার ব্যাতিক্রম নয়। স্পেন পশ্চিম সাহারাকে স্বাধীনতা না দিয়ে সেখানকার দায়িত্ব মরোক্ক ও মৌরিতানায়া উভয়ের হাতেই দিয়ে চলে যায়, এভাবেই বিতর্ক তৈরি হয়। এবার পশ্চিম সাহারা কে নিয়ে লড়াই শুরু হয় মরোক্ক, মৌরিতানায়র মধ্যে। পশ্চিম সাহারার সাধারন মানুষ একটি জোট গঠন করে যার নাম পলিসারিও ফ্রন্ট তারাও মরোক্ক ও মৌরিতানায়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। এরা নিজেদের মধ্যে সারাওয়ি আরব ডেমোক্রেটিক পার্টি নামে একটি দল গঠন করে। ১৯৭৬ সালে আলজেরিয়ার টিন্ডফে পশ্চিম সাহারার জন্য একটি সরকার গঠন করে। কিন্তু যুদ্ধে প্রথম থেকেই মরোক্ক এগিয়ে ছিল। ১৯৭৯ সাল আসতে আসতে মৌরিতানায়া যুদ্ধ থেকে সরে যায় এবং মরোক্ক ৮০ শতাংশ পশ্চিম সাহারা দখল করে নেয়। জাতিসংঘ চাইছে পশ্চিম সাহারাতে সাধারন মানুষদের নিয়ে নিরপেক্ষ ভোট হোক কিন্তু ১৯৭৫ সাল থেকে আজও তা সম্ভব হয় নি, এখানে আজও লড়াই চলছে। 

২০০৭ সালে মরক্কো সরকার প্রস্তাব দেয় পলিজারিও ফ্রন্টের অধীনে তারা পশ্চিম সাহারাকে কীছুটা স্বায়ত্তশাসন দেবে কিন্তু পলিজারিও ফ্রন্ট এই প্রস্তাব অস্বীকার করে কারন তারা পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করছিল। আসলে মরক্কো পশ্চিম সহারার ৮০ শতাংশ জায়গা দখল করেছিল যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ ও ছিল সেজন্য পলিজারিও ফ্রন্ট পূর্ন স্বাধীনতা চাইছিল। এবার আপনাদের মনে হতে পারে এই পুরো লড়াইয়ে আলজেরিয়ার কী ভূমিকা। দেখুন আলজেরিয়া ও মরোক্কের মধ্যে ঝামেলা পশ্চিম সাহারা তৈরির আগে থেকে চলছিল। ১৯৬২ সালে সীমান্ত নিয়ে আলজেরিয়া ও মরোক্কের মধ্যে যুদ্ধও হয়। আলজেরিয়া এর আগেও অনেক বিপ্লবী কাজকে সমর্থন করেছিল যা মরোক্ক পচ্ছন্দ করে না। এই মহূর্তে পশ্চিম সাহারার প্রায় ১,৭৩,০০০ মানুষ ও প্রচুর পলিসারিও ফ্রন্টের নেতা আলজেরিয়াতে আশ্রয় নিয়ে আছে। কিছুদিন আগে মরক্কোর একটি গোষ্ঠীর হামলায় বেশ কীছু আলজেরিয়ার মানুষ মারা যায়। এই ঝামেলার জেড়ে ১৯৯৪ সাল থেকে মরক্কো ও আলজেরিয়ার সীমান্ত বন্ধ আছে। এই মাসেই আলজেরিয়া জানায় তারা স্পেনের সাথে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করছে৷ ২০০২ সালে স্পেন ও আলজেরিয়ার মধ্যে শিক্ষা, রাজনীতি, প্রতিরক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতার জন্য চুক্তি হয় যা ২০ বছর পর এমাসে ভেঙ্গে যায়। আলজেরিয়া জানায় স্পেন এখন মরক্কো কে সমর্থন করছে। কিছুদিন আগে মরক্কো জানায় ২০০৭ সালে তাদের নেওয়া স্বায়ত্তশাসনের সিদ্ধান্ত কে সমর্থন করছে স্পেন, পরে স্পেনের বিদেশমন্ত্রক মরক্কের এই বক্তব্যকে সমর্থন করে। এবার তাহলে মনে হতে পারে স্পেন কেন আলজেরিয়ার বদলে মরক্কোকে সমর্থন করছে? দেখুন সাধারনত কোন দেশ যে দেশকে স্বাধীনতা দিয়েছে তারা সাধারনত সেই দেশের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকে। 

স্পেন ও প্রথমের দিকে জাতিসংঘে পশ্চিম সাহারায় নিরপেক্ষ ভোটের প্রস্তাবকে সমর্থন করত কিন্তু পরে আলজেরিয়াকে সমর্থন করা শুরু করে৷ কিন্তু গত দুই বছরে করোনা মহামারীর সময় একটা খবর প্রকাশিত হয় যে পলিসারিও ফ্রন্টের একজন লিডার ব্রাহিম ঘালি করোনার চিকিৎসা করাচ্ছে স্পেনে। এই খবর জানার পরই মরক্কো কুটনৈতিক চাপ দিতে থাকে স্পেনকে। দীর্ঘদিন ধরে স্পেনের সিউটা দ্বীপ কে বিবাদ আছে মরক্কো ও আলজেরিয়ার। মরক্কো এই দ্বীপের কাছে নিজেদের সীমান্ত খুলে দেয় ফলে উত্তর আফ্রিকা থেকে প্রায় ১০,০০০ অভিবাসী এসে পৌঁছায় সিউটা দ্বীপে ফলে যথেষ্ট চাপ পড়ে স্থানীয় প্রশাসনের উপর। ফলে এক প্রকার মরক্কোর চাপে বাধ্য হয়ে স্পেন তাদের সমর্থন করতে শুরু করে। এর ফলে আলজেরিয়া স্পেনের সাথে প্রথমেই বানিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। আলজেরিয়া প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দেশ। প্রাকৃতিক গ্যাসের বিপুল সম্ভার আছে এখানে। এজন্য আলজেরিয়াকে শক্তির উৎস বলা হয়। আলজেরিয়া থেকে দুটি পাইপ লাইনের মাধ্যমে গ্যাস যায় মরোক্ক এবং স্পেনে। আলজেরিয়া মরেক্কোকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে এবং স্পেন কে জানিয়েছে তারা যদি মরক্কো কে গ্যাস দেয় তাহলে স্পেন কে গ্যাস দেওয়া বন্ধ করে দেবে। ইতিমধ্যে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে রাশিয়া ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে যার জন্য ইউরোপে গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে। এই অবস্থায় আলজেরিয়া স্পেনকেও গ্যাস বন্ধ করে দিলে স্পেনও সংকটে পড়বে। ১৯৭৫ থেকে এখনও অবধি জাতিসংঘে ৪৭ টি মিটিং এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা সংস্থায় ৬৯ টি মিটিং করা হয়েছে তাও কোন সমাধান বেরোয় নি। পশ্চিম সহারায় জাতিসংঘের একটি বিশেষ মিশনও চলছে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তাও কোনও লাভ হয় নি এখনও পর্যন্ত। এখন দেখার বিষয় আলজেরিয়া স্পেনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয় কীনা!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *