ডিফেন্স

ভারতবর্ষ থেকে এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয়। ভিয়েতনামের সাথে শুধুই প্রতিরক্ষা চুক্তি নাকী এর পেছনে অন্য কোন কারন আছে?

রাজেশ রায় :— যুদ্ধ হোক কিংবা শান্তি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোন কোন দেশের সাথে কোন দেশের ভাল সম্পর্ক আছে এবং কী কী সেক্টরে সেইসব দেশের সহযোগিতা আছে তার উপর নির্ভর করে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোন দেশের অবস্থান কেমন এবং ভবিষ্যতে দেশটি কী কী সুবিধা পাবে। সম্প্রতি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং ভিয়েতনাম সফরে গিয়েছিলেন যাতে প্রতিরক্ষা সেক্টরে ভারত ও ভিয়েতনামের সম্পর্ক মজবুত হবে। বলা হচ্ছে ভিয়েতনাম ভারত থেকে আকাশ এয়ারডিফেন্স সিস্টেমের আপগ্রেডেড ভার্সন আকাশ এনজি বা নেক্সট জেনারেশন কীনতে চাইছে। এই ডিলের স্ট্রাটেজিক গুরুত্ব কী?? শুধুই কী এটা নিছক একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি যাতে ভারতের কীছু টাকা লাভ হবে নাকী এর পেছনে অন্য কোন কারন আছে?? ২০১৭ সাল থেকেই ভারত ও ভিয়েতনামের মধ্যে এই ব্যাপারে কথা চলছিল কিন্তু মাঝে আলোচনা বন্ধ ছিল কারন ভিয়েতনামের কাছে বিকল্প ছিল যেমন ইসরায়েলের স্পাইডার এয়ারডিফেন্স সিস্টেম। তাহলে হঠাৎ করে কী হল হঠাৎ আবার ভারত ভিয়েতনামের মধ্যে এই চুক্তি হবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে?

ভিয়েতনামের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভিয়েতনামের পাশেই রয়েছে দক্ষিন চীন সাগর যা নিয়ে চীনের সাথে ভিয়েতনামের ঝামেলা আছে এবং ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয় থেকে খুব কাছেই চীন। ভিয়েতনামের সাথে এই চুক্তির দুটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে। প্রথমত এই চুক্তির মাধ্যমে ভারতের প্রতিরক্ষা সেক্টরে গতি আসবে। ভারতের নিজস্ব টেকনোলজি বিক্রির ফলে অন্যান্য দেশও ভারতের টেকনোলজির প্রতি আগ্রহী হবে। দ্বিতীয়ত এই চুক্তি স্ট্রাটেজিকক্যালি ভিয়েতনাম ও ভারতের সম্পর্ক মজবুত করবে। আগেই বলা হয়েছে যে দক্ষিন চীন সাগরে ভিয়েতনামের সাথে চীনের ঝামেলা আছে। এই অঞ্চলে ভিয়েতনামের তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য ওনএনজিসি বিদেশ লিমিটেড বা ওবিএলের সাথে ভিয়েতনামের চুক্তি আছে। এই এলাকায় কীছুদিন আগে চীন ভিয়েতনামের একটি জাহাজকে ডুবিয়ে দিয়েছিল। চীন এই কাজটা করতে পেরেছিল কারন শক্তির বিচারে ভিয়েতনাম চীনের তুলনায় অনেক দুর্বল তাই। এবার ভারতের সহযোগীতায় ভিয়েতনাম শক্তিশালী হলে এই এলাকায় বাধা পাবে চীন। এবার আকাশ মিসাইলের কথায় আসা যাক। ইন্ট্রিগেটেড গাইডেড মিসাইল ডেভলপমেন্ট পোগ্রামের আওতায় পাঁচটি মিসাইল তৈরি করা হয়েছিল যাদের একত্রে পাটনা বলা হয়, পৃথিবী, আকাশ, নাগ, ত্রিশূল ও অগ্নি। আজ আকাশ সিস্টেমের ব্যাপারে বলা হবে। 

আকাশ একটি মিডিয়াম রেঞ্জের সারফেস টু এয়ার মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম। এটি তৈরি করেছে ডিআরডিও কিন্ত মিসাইলের রেডার, লঞ্চিং সিস্টেম, কন্ট্রোল সেন্টার সহ অন্যান্য অংশ তৈরি করেছে ভারত ডায়নামিক লিমিটেড, টাটা পাওয়ার, ভারত ইলেকট্রনিকস লিমিটেড এবং এল এন্ড টি। আকাশ এয়ারডিফেন্স সিস্টেম কে আমেরিকার প্যাট্রিয়ট এয়ারডিফেন্স সিস্টেমের থেকেও নিখুঁত ও সস্তা বলা হয়। প্যাট্রিয়টের সাথে আকাশ সিস্টেমের পার্থক্য হচ্ছে প্রথমত আকাশ সিস্টেম একসাথে অনেকগুলো টার্গেটকে ধ্বংস করতে সক্ষম। একটি আকাশ সিস্টেমের ব্যাটারিতে ৪ টি লঞ্চার থাকে এবং প্রতিটি লঞ্চারে ৩ টি করে আকাশ মিসাইল থাকে অর্থাৎ একটি আকাশ মিসাইল সিস্টেমর ব্যাটারিতে ১২ টি মিসাইল থাকে। একটি ব্যাটারির সাথে একটি রাজেন্দ্র থ্রি ডি রেডার থাকে যা একসাথে ৬৪ টি টার্গেটকে ট্রাক করে এবং ১২ টি টার্গেটকে ধ্বংস করতে সক্ষম। দ্বিতীয়ত হচ্ছে ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম। কোনও মিসাইল যখন ফায়ার করা হয় তখন শত্রু পক্ষ জ্যামারের মাধ্যমে মিসাইলের ইলেকট্রনিক সিস্টেম কে জ্যাম করে দিতে পারে যার জন্য মিসাইল টার্গেটকে আঘাত করতে পারে না। এই কারনে আকাশে ইলেকট্রনিক কাউন্টার মেসার সিস্টেম রয়েছে। তৃতীয়ত হচ্ছে এটি মোবাইল সিস্টেম যার অর্থ কোনও এক বিশেষ জায়গায় না থেকে একে প্রয়োজনে অন্য জায়গা থেকে ব্যবহার করা যেতে পারে। ধরুন লাদাখে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে রসদ পাঠাতে হবে কিন্তু চীন চাইলে সেই কনভয়ে মিসাইল অ্যাটাক করে নষ্ট করে দিতে পারে। এই রকম পরিস্থিতিতে কনভয়ের সাথে আকাশ মিসাইল সিস্টেমকে পাঠানো হয় মিসাইল কে কাউন্টার করতে। বলা হয় আকাশ সিস্টেম ভারত রাশিয়ার কুব এয়ারডিফেন্স সিস্টেমের উপর নির্ভর করে তৈরি করেছে। এখানেও রামজেট ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে। 

রামজেট ইঞ্জিন সাধারনত মিসাইলকে সুপাসনিক মানে শব্দের গতীর আড়াইগুন গতি প্রদান করে। তবে ভারত জানিয়েছে আকাশ সিস্টেমের ৯৬ শতাংশই তাদের নিজেদের তৈরি। ২০১৭ সাল থেকেই ভিয়েতনামের সাথে আকাশ মিসাইল সিস্টেমের ব্যাপারে কথা চলছিল কারন ভিয়েতনাম তাদের সোভিয়েত জামানার এস-১২৫ এবং এস-৭৫ মিসাইল সিস্টেমকে রিপ্লেস করতে চাইছিল। তবে প্রথমে ভিয়েতনাম আকাশ মিসাইল সিস্টেম নিতে রাজি হয়নি কারন আকাশের প্রথম ভার্সনের রেঞ্জ খুব কম ছিল ২৫-৩০ কিলোমিটারের মতন কিন্তু ভিয়েতনামের দরকার ছিল লং রেঞ্জ এয়ারডিফেন্স সিস্টেম। আকাশ সিস্টেমের পাশাপাশি ব্রাহ্মস মিসাইল নিয়েও ভিয়েতনামের সাথে ভারতের আলোচনা চলছে। ইতিমধ্যেই ফিলিপিন্সের সাথে ব্রাহ্মসের চুক্তি হয়েছে ভারতের এবং ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার সাথে হতে পারে। আকাশ মিসাইলের গতি ২.৫ ম্যাক। ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বায়ুসেনা এই মিসাইল ব্যবহার করে, নেভি ব্যবহার করে না। বায়ুসেনা ২০১৪ সালে এবং সেনাবাহিনী ২০১৫ সালে এই মিসাইল সিস্টেম সার্ভিসে আনে। আকাশ মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমের অনেক গুলি ভার্সন আছে। প্রথম যে ভার্সন টা এসেছিল সেনার কথায় তার আপগ্রেড করা হয় নতুন করে যাতে নতুন সিকার লাগানো হয়, এর নাম হয় আকাশ ১ এস, এটি ২০১৯ সালে সার্ভিসে আসে। সিকার মূলত মিসাইলের হিটিং ক্ষমতা কে আরও নিখুঁত করে তোলে। এরপর তৈরি হয় আকাশ প্রাইম যা আকাশ ১ এসের থেকেও আপগ্রেডেড। এতে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সী সিকার যুক্ত করা হয়েছে যা মিসাইলের হিটিং ক্ষমতা কে আরও নিখুঁত তৈরি করেছে।

আকাশ প্রাইম উচ্চ পার্বত্য এলাকা এবং অনেক কম তাপমাত্রায়ও সঠিক ভাবে কাজ করে। এরপর আসছে আকাশ এনজি মিসাইল সিস্টেম, যা আকাশের সবচেয়ে অ্যাডভান্সড ভার্সন। ভিয়েতনাম এই সিস্টেমই কিনবে। ২০১৬ সালে আকাশ এনজি প্রজেক্ট শুরু হয় এতে ৪৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। আকাশ এনজি তে মিসাইলের গতি বাড়ানো হয়েছে  ও রিয়্যাকশন টাইমকে আরও কম করা হয়েছে এবং রেঞ্জ বাড়ানো হয়েছে। রিয়্যাকশন টাইম মিসাইলের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারন ধরুন ভারতের কাছে কোন এক জায়গায় এক ব্যাটারি আকাশ মিসাইল সিস্টেম রয়েছে, এবার এক ব্যাটারি আকাশে ১২ টি মিসাইল থাকে। একবার মিসাইল লঞ্চ করবার পর পুনরায় মিসাইল লঞ্চারে লোড করতে পাঁচ মিনিট সময় লাগবে এ ব্যাপারটা চীন জানতে পেরে যুদ্ধকালীন সময়ে সেখানে ২-৩ মিনিট অন্তর ৩০-৪০ টা মিসাইল অ্যাটাক করল। এবার ভাবুন আকাশ আছে ১২ টা, পুনরায় লোড করতে ৫ মিনিট লাগবে তখন কী হবে? এই জন্য রিয়াকশন টাইম যত কম হবে তত লাভ।

ভিয়েতনাম আকাশ মিসাইল সিস্টেম কীনছে যার একটাই কারন চীন। চীনের অ্যাগ্রেসিভ বিদেশনীতি বরাবরই ছোট দেশ গুলোর মাথা ব্যাথার কারন। ভিয়েতনাম বরাবরই অস্ত্র কীনত রাশিয়ার থেকে। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে রাশিয়া ও চীনের দারুন বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে। রাশিয়া চীনের ব্যাপারে নিউট্রাল থাকে। চীন ও ইউক্রেন ইসুতে রাশিয়াকে সমর্থন করছে। আবার লাওসে দুটি হাইড্রো পাওয়ার প্রজেক্টে রাশিয়া বিনিয়োগ করেছে যাতে ভিয়েতনামের ক্ষতি হচ্ছে, তাই ভিয়েতনাম রাশিয়ার বদলে একটি বিকল্প খুঁজছিল সেই জন্য ভারত সবচেয়ে সেরা বিকল্প, এটাই আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশেষত্ব। তাছাড়া ভিয়েতনাম প্রথমে ভেবেছিল ইসরায়েল থেকে স্পাইডার স্যাম কিনবে কিন্তু ভিয়েতনাম ও ইসরায়েলের মাঝে এই চুক্তির ব্যাপারে যুক্ত থাকা ব্যাক্তিকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রপ্তার করেছে ভিয়েতনাম সেজন্য এখন ভারতই বিকল্প পড়ে আছে ভিয়েতনামের কাছে। এই মহূর্তে আমেরিকা সহ ইউরোপ রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যাস্ত আছে। সেজন্য এশিয়াতে শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে তার সুযোগ নিয়ে তাইওয়ান, ভিয়েতনামের মতন দেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে চীন, সেজন্য ভিয়েতনাম নিজেকে প্রস্তত রাখছে। দক্ষিন চীন সাগরের ম্যাপ দেখলে দেখবেন এর আশেপাশে মোটামুটি তিনটি জোট আছে। চীন, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া হচ্ছে একটি জোট। দক্ষিন কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, তাইওয়ান একটি জোট যা আমেরিকার পক্ষে এবং ব্রুনেই, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম ও ফিলিপিন্স এই দপশ গুলো কোন পক্ষে না গিয়ে তৃতীয় কোন দেশকে খুঁজছে, এক্ষেত্রে ভারত হচ্ছে ভাল বিকল্প। ভারত যদি এইসব দেশ গুলোকে নিয়ে জোট করে দক্ষিন চীন সাগরে চীনকে ব্যাস্ত করতে পারে তাহলে লাদাখের প্রতি চীনের মনোযোগ কমে যাবে কারন চীন দুই দিকে ব্যাস্ত হয়ে পড়বে। ভিয়েতনাম রাশিয়ার পঞ্চম বৃহত্তম এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় রাশিয়ার সবচেয়ে বড় অস্ত্র ক্রেতা কিন্তু এই মহূর্তে রাশিয়ার উপর প্রচুর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাই ভিয়েতনাম ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা সেক্টরে সম্পর্ক উন্নয়ন করছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *