ভারতের গর্ব কোহিনূর হীরে কিভাবে ভারত থেকে ব্রিটেনে পৌঁছাল? কোহিনূর সম্পর্কে প্রচলিত রাজাদের অভিশাপ ও দুর্ভাগ্যের ঘটনা
রাজেশ রায়:—- বিশ্বের অন্যতম বড় এবং বিখ্যাত হীরে হচ্ছে কোহিনূর। যার মূল্য আজও নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। বাবর যখন কোহিনূর কে হাতে নেয় বলে এই হীরের যা মূল্য তাতে গোটা বিশ্বের মানুষকে একদিন খাবার খাওয়ানো যাবে। নাদির শাহ যখন কোহিনূর পায় তখন বলে কোন ব্যাক্তি যদি একটি পাথর নিয়ে চারদিকে ছুঁড়ে দেয় তাহলে যে গ্যাপ তৈরি হবে যতদূর পাথর যাবে ততদূর অবধি, এই পুরো গ্যাপকে যদি সোনা দিয়ে ভর্তি করা হয় তাও কোহিনূরের সমান দামী হবে না। কোহিনূরের সাথে একটি অদ্ভুত ব্যাপার আছে তা হল আজ পর্যন্ত কোহিনূরকে কেউ কেনে নি বা কেনার চেষ্টাও করে নি বরং কোহিনূরকে বারবার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে নাহলে উপহার স্বরূপ দেওয়া হয়েছে। ঐতিহাসিকদের মতে অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টর থেকে নির্গত এই হীরে কাকাতীা সাম্রাজ্য হয়ে খিলজী, মুঘল, পার্সিয়ান, আফগানি, শিখ এবং শেষে ইংরেজদের অধিকারে যায়। ১৮৬ ক্যারেট ওজেনের প্রচুর দামী এই হীরে শতাব্দীর পর শতাব্দী বিভিন্ন সাম্রাজ্যের শাসকরা কোহিনূরকে তাদের বিজয়ের প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু অনেক মূল্যবান জেমস স্টোনের মতন কোহিনূর সম্পর্কেও অনেক অভিশাপ, দুর্ভাগ্যের কথা প্রচলিত আছে যার জন্য কোহিনূরকে ব্রিটিশ রাজ পরিবারের মহিলা সদস্যরা ছাড়া কেউ কোনওদিন ব্যবহার করে নি। আজকে কোহিনূরের এই ইতিহাস এবং কিভাবে কোহিনূর ভারত থেকে ব্রিটেনে পৌঁছাল সেব্যাপারে আলোচনা করা হবে। সাথে এটাও জানব কোহিনূর সম্পর্কে প্রচলিত কীছু অভিশাপ ও দুর্ভাগ্যের ঘটনা।
কোহিনূরের একটি জটিল ইতিহাস আছে। কোহিনূরের উৎস সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মতবিরোধ আছে। কারও দাবি চার শতকে প্রাচীন সংস্কৃত গ্রান্থে কোহিনূরের উল্লেখ আছে যেখানে কোহিনূর কে একটি বড় হীরে বলা হয়েছে আবার বেশীরভাগ ঐতিহাসিক গন বলেন কোহিনূরের উৎস ১১-১৩ শতকে ডেকান প্রদেশেের গোলকুণ্ডা খনিতে, যা সেসময় কাকাতীয় সম্রাজ্যের অধীনে ছিল। বীরাঙ্গলে কাকাতীয়দের এক মন্দিরে এটি রাখা ছিল দেবীর চোখ হিসাবে। বলা হয় প্রথমে কোহিনূরের ওজন ছিল ৭৯৩ ক্যারেট। চোদ্দ শতকের প্রথমে যখন আলাউদ্দীন খলজী দক্ষিন ভারত আক্রমন করে তখন তার সেনাপতি মালিক কফুর বরাঙ্গল থেকে এটি দিল্লি নিয়ে আসে, এভাবে কোহিনূর দিল্লিতে আসে। ১৫২৬ সালে ইব্রাহীম লোদীকে পরাস্ত করে বাবর ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা করে তখন কোহিনূর বাবরের হতে আসে এবং বাবর তার আত্মজীবনী বাবরনামা তে এর উল্লেখ করেছিল যেখানে কোহিনূর কে ডায়মন্ড অফ বাবর বলা হয়েছে। এটাই প্রথম কোন বই যেখানে কোহিনূরের উল্লেখ পাওয়া যায়। বাবরের মৃত্যুর পর তার পুত্র হুমায়ুন এটা পায় এবং হুমায়ুন থেকে শাহজাহান এরা পায়। শহজাহান এটা বিখ্যাত পিকক থ্রোনে লাগিয়েছিল। পিকক থ্রোন এতটাই বিখ্যাত ছিল যে এটা তৈরি করতে সাত বছর সময় লেগেছিল এবং এটি তৈরিতে এত খরচ হয়েছিল যে তা দিয়ে সাতটি তাজমহল তৈরি করা সম্ভব। এরপর ঔরাঙ্গজেবের সময়ে ফ্রেঞ্চ পর্যটক ত্রাভেনিয়ার ভারতে এসে ঔরাঙ্গজেবকে কোহিনূর হীরে দেখাবার অনুরোধ করেন এবং এরপর তিনি কোহিনূরের ছবি আকেন। এই প্রথম কোহিনূরের কোনও ছবি প্রকাশ পায়। ঔরাঙ্গজেব কোহিনূরকে ভালভাবে কাটিং করে সুন্দর দেখানোর জন্য ভেনিসের এক হীরে বিশেষজ্ঞ হটেন্সো বুর্জোয়াকে এর দায়িত্ব দেয়। কিন্তু বুর্জোয়া খুবই বাজে ভাবে এর কাটিং করে এবং কোহিনূরের ওজন ৭৯৩ ক্যারেট থেকে কমে ১৮৬ ক্যারেট হয়ে যায়। বুর্জোয়ার এই কাজে রেগে ঔরাঙ্গজেব বুর্জোয়াকে কোন পারিশ্রমিকই দেয় নি। ঔরাঙ্গজেবের পরই মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা হয়।
মুঘল সম্রাট মহম্মদ শাহ রঙ্গীলার সময়ে নাদির শাহ ১৭৩৯ সালে দিল্লি আক্রমন করে হাজার হাজর লোককে হত্যা করে এবং সমস্ত মুঘল সম্পদ লুট করে, যাতে বিখ্যাত পিকক থ্রোন সহ কোহিনূরের প্রায় জমজ হীরে দারিয়া ই নূর ও ছিল। কিন্তু কোহিনূর তখনও মহম্মদ শাহ রঙ্গিলার কাছেই ছিল, মাথার পাগড়ির মধ্যে এটা লুকিয়ে রাখতেন তিনি। এই খবর নাদির শাহ এক গুপ্তচরের মাধ্যমে খবর পান এবং একটি পরিকল্পনা করেন এটি নেবার। দিল্লি থেকে দেশে ফিরে যাবার আগে নাদির শাহ একটি রাজকীয় ভোজের আয়োজন করে এবং বলে দিল্লির সিংহাসন মহম্মদ শাহকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং তাদের বন্ধুত্বের প্রতীক হিসাবে উভয়ে উভয়ের পাগড়ি বদলাবেন। বাধ্য হয়ে মহম্মদ শাহ তার পাগড়ি নাদির শাহকে দিয়ে দেন। এবং কোহিনূর এভাবে নাদির শাহের কাছে এসে পড়ে। কোহিনূরের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে নাদির শাহই এর নাম কোহিনূর দেয়। পারস্য ভাষায় কোহি শব্দের অর্থ পর্বত এবং নূর মানে আলো, অর্থাৎ কোহিনূর মানে পর্বের আলো।
১৭৪৭ সালে ইরানে নাদির শাহকে হত্যা করা হয় তখন কোহিনূরের মালিকানা আসে নাদির শাহের জেনারেল আহমেদ শাহের হাতে। আহমেদ শাহ আফগানিস্তানে দুরানী রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করে। এই বংশের শাসক শাহ সুজার সময়ে আফগানিস্তানে দুরানীদের ক্ষমতা কমতে থাকে এবং শাহ সুজা ভারতে পাঞ্জাবে পালিয়ে এসে মহারাজা রনজিত সিং এর কাছে আশ্রয় নেন। বদলে রনজিত সিং কে কোহিনূর এবং দরিয়া ই নূর উপহার দেন। কোহিনূর পরবর্তী ২০ বছর মহারাজ রনজিত সিং এর কাছেই ছিল। রনজিত সিং এই হীরে ওড়িশার জগন্নাথ মন্দিরে দেবার কথা ভেবেছিলেন কিন্তু ১৮৩৯ সালে ওনার মৃত্যু হয়। এইসময় পাঞ্জাবে ক্ষমতার দখল কে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ঝামেলা শুরু হয়। চার বছরে পাঞ্জাবে চার জন শাসক আসে শেষ পর্যন্ত পাঞ্জাবের শাসক হয় দিলীপ সিং তখন তার বয়স ছিল ১০ বছর। এই সময় ব্রিটিশরা উত্তর ভারত দখল করে পাঞ্জাবে আসে, ব্রিটিশরা প্রথমেই দিলীপ সিং এর মা জিন্দনকে ১৮৪৯ সালে জেলে ভরে দেয়। ব্রিটিশরা কোহিনূরের ব্যাপারে জানত। ১৮৪৯ সালে লর্ড ডালহৌসির নেতৃত্বে ব্রিটিশ ও দীলিপ সিং এী মধ্যে লাহোর চুক্তি হয় যাতে মহারাজ দিলীপ সিং ইংল্যান্ডের রানীকে কোহিনূর উপহার দিতে বাধ্য হয়। বোম্বে থেকে গোপন জাহজে করে কোহিনূর ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়। জাহাজের ক্রুরাও জানত না কী আছে।
১৮৫০ সালের জুলাই মাসে ইংল্যান্ডের মহারানীকে ভিক্টোরিয়াকে কোহীনুর তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু কোহিনূরের আকৃতি পচ্ছন্দ হয় নি রানি ভিক্টোরিয়ার। মহারানী ভিক্টোরিয়ার স্বামী প্রিন্স অ্যালবার্ট ইংল্যান্ড ও ডাচ হীরে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে এর পুনরায় নতুন কাটিং করান৷ ৪৫০ ঘন্টার পরিশ্রমে কোহিনূরকে ওভাল আকৃতির করা হয়। এতে কোহিনূরের ওজন ১৮৬ ক্যারেট থেকে কমে ১০৫.৬ ক্যারেট করা হয়। এমন করা হয়েছিল কারব রানী ভিক্টোরিয়া একে তার মুকুটে রাখতে চেয়েছিল। চিত্রশিল্পী ফ্রান্জ জেভিয়ার উইন্টারহল্টারের আকা ছবিতে রানী ভিক্টোরিয়াকে কোহিনূর যুক্ত মুকুটে দেখা যায়, যেই মুকুট আগে রানী অ্যাডেলেডের ছিল। এরপর ১৯০২ সালে রানী আলেকজেন্দ্রিয়া থেকে শুরু করে রানী মেরী এবং ১৯৩৭ সালে মনারানী এলিজাবেথই শেষ কোনও ইংল্যান্ডের রানী যিনি কোহিনূররের মুকুট পড়েন। রানী এলিজাবেথের এই মুকুটে কোহিনূরের পাশাপাশি রানী ভিক্টোরিয়াকে দেওয়া তুরস্কের সুলতানের একটি ১৭ ক্যারেটের হীরেও ছিল কিন্তু কোহিনূর কাছে এটি কিছুই ছিল না। এরপর টাওয়ার অফ লন্ডনের জুয়েল হাউসে কোহিনূর রাখা হয়।
অন্যান্য অনেক মূল্যবান পাথরের মোতো কোহিনূরকে নিয়েও অনেক অভিশাপ, দুর্ভাগ্যের কাহিনী আছে। ১৩ শতকে এক প্রাচীন বইয়ে বলা হয়েছে যে এই হীরে পড়বে সে পৃথিবী বিজয় করবে কিন্তু এর সাথে হীরের অভিশাপ তার লাগবে। শুধু মহিলা এবং দেবতারাই একে ধারন করতে পারবে। ইংল্যান্ডের এক পত্রিকা কোহিনূরকে মাউন্টেন অফ ডার্কনেস বলে উল্লেখ করেছে। হোপ ডায়মন্ড:– দি লিজেন্ডারি হিস্ট্রি অফ এ কার্স ডায়মন্ড বইয়ের লেখক রিচার্ড কুরিনের বক্তব্য কোহিনূর কে সব সময় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং বাধ্য করা হয়েছে উপহার দিতে যার জন্য এই হীরে অভিশপ্ত। যে যে শাসক এই হীরে নিজের কাছে রেখেছে তাদেরই পতন হয়েছে। যেমন মুঘল সাম্রাজ্যের পতন, নাদির শাহের পতন, শাহ সুজার ভারতে পালিয়ে আসা, দিলীপ সিং এর ইংরেজদের কাছে বাধ্য হওয়া, এমনকী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন সবই দুর্ভাগ্যের ইঙ্গিত দেয়। তবে সাম্রাজ্যের উত্থান পতন লেগেই থাকে। তবে কোহিনূররের সাথে জড়িত এই কাহিনী এত জোরালো যে ব্রিটিশ রাজপরিবারের মহিলাারা ছাড়া কোনওদিন কোন পুরুষ কোহিনূর ধারন করে নি। কোহিনূরকে ভারতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছিল। প্রথম চেষ্টা করা হয়েছিল ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতার প্রতীক হিসাবে কোহিনূরকে ভারতে ফিরিয়ে আনার। ১৯৭৬ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো কোহিনূরের দাবি করে বলে দিলীপ সিং এর রাজত্বের অনেক অংশ পাকিস্তানের ছিল তাই কোহিনূর পাকিস্তানের। আবার সম্প্রতি তালিবান ও ইরাব নাদির শাহের জন্য কোহিনূর দাবি করেছে। ২০১৫ সালে ভারতের একদল ব্যবসায়ী কোহিনূর ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিল কিন্তু ব্রিটিশ রাজপরিবার রাজি হয়নি।