ডি আর ডি ও এর অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ড্রোন ঘাতক ইউএসিভি প্রজেক্ট চীনের ঘুম ওড়াতে চলেছে
রাজেশ রায়:– সমতা ও শক্তিতে অটুট সম্পর্ক রয়েছে এবং প্রতিরক্ষা ক্ষেতে শক্তি অর্জন সবচেয়ে জরুরী আসবে, তবেই শক্তিশালী প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্কে সমতা আসে। ভারতের ভবিষ্যতের যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট ডিআরডিও এর ঘাতক যা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। ঘাতক মূলত একটি কমব্যাট ড্রোন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং সম্প্রতি টুইট করে জানিয়েছেন ঘাতক ড্রোনের টেকনোলজি ডেমনস্ট্রেটরের সফল ফ্লাইট টেস্ট হয়েছে। কর্নাটকের চিত্রদুর্গের এরোনটিক্যাল টেস্ট রেঞ্জ বা এটিআর থেকে এর পরীক্ষা করা হয়েছে। আগেই বলা হয়েছে যে এটি কমব্যাট ড্রোন তবে এটি অটোনোমাস।
ড্রোন সাধারনত দুই প্রকার, শুধুমাত্র সারভিলেন্সের জন্য যে ড্রোন ব্যবহার করা হয় তাকে বলে ইউএভি বা আনম্যানড এরিয়াল ভ্যেইকেল এবং যখন ড্রোন বোম্ব বা মিসাইল বহন করে নিয়ে যায় তাকে ইউএসিভি বা আনম্যানড এরিয়াল কমব্যাট ভ্যেইকেল বলা হয়। ইউএসিভি হচ্ছে সবচেয়ে জটিল প্রযুক্তি। একে অটোনোমাস বলা হচ্ছে কারন সাধারন ড্রোনকে বিশেষ কোন কম্যান্ড সেন্টার থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় কিন্তু ঘাতকে এমন একটি বিশেষ আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স বা কৃত্রিম ব্রেন দেওয়া হয়েছে যে এটি বিশেষ পরিস্থিতিতে নিজের মিশন নিজেই সম্পন্ন করতে পারবে। এই ঘাতক পুরোপুরি ফ্লাইং উইং মানে যেকোনো বিমানের দুই পাশে দুটো ডানা থাকে এবং মাঝখানে প্রধান বডি থাকে। কিন্তু ঘাতকের ডিজাইন এমনই যে এটা পুরো ডানার মতো এবং এই ডানায় জায়গায় সেন্সর সহ বিভিন্ন অংশ যুক্ত করা হয়েছে যার জন্য একে ফ্লাইং উইং বলা হয়। অন্যান্য বিভিন্ন দেশের সাধারন কমব্যাট ড্রোনের থেকে ঘাতকের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে যে ঘাতক পরবর্তী প্রজন্মের ড্রোন যাতে স্টেলথ বৈশিষ্ট্য থাকবে। এবার স্টেলথ বৈশিষ্ট্যের শর্তই হচ্ছে ইন্টারন্যাল ওয়েপনস বে অর্থাৎ ঘাতকের মূল বডির নীচে কোন অস্ত্র থাকবে না, বরং ড্রোনের ভিতর বিশেষ জায়গায় রাখা থাকবে। বাইরে অস্ত্র থাকলে ড্রোনের গতি কমে যায় এবং রেডারে শনাক্ত হবার সম্ভবনা থাকে।
প্রজেক্ট ঘাতককে আউরা নামেও ডাকা হয় যার অর্থ অটোনোমাস আনম্যানড রিসার্চ এয়ারক্রাফট। এটি তৈরি করছে এডিই এবং এর ডিজাইন করেছে এডিএ। এখানে এডিই এবং এডিএ দুটি সংস্থা সম্পূর্ণ আলাদ। এডিএ বা এরোনটিক্যাল ডেভলপমেন্ট এজেন্সি ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অধীনে থাকা একটি সংস্থা এবং এডিই বা এরোনটিক্যাল ডেভলপমেন্ট এজেন্সি হচ্ছে ডিআরডিওর অধীনস্থ একটি সংস্থা। কিছুদিন আগে যে মডেলের টেস্ট হল তা মূলত পরীক্ষা মূলক ছোট ভার্সন। আসল প্রোটোটাইপের টেস্ট হবে ২০২৫ এ। এই প্রজেক্ট শুরু করা হয়েছিল ভারতীয় বায়ুসেনার কথা মাথায় রেখে, তবে এখন ভারতীয় নেভিও ভবিষ্যতে এটি ব্যবহার করবে, হয়ত ভারতীয় সেনাবাহিনীও কিনবে। ঘাতক মিসাইল, বোম্ব, প্রিশিসন বোম্ব এবং অ্যান্টি ট্যাঙ্ক গাইডেড মিসাইল বহন করতে পারবে। প্রিশিসন বোম্ব একটি বিশেষ ধরনের স্মার্ট বোম্ব যার টার্গেটকে আঘাত করার ক্ষমতা অন্য সাধারন বোম্বের থেকে ৮০ শতাংশ বেশী। যেমন বালাকোটে এয়ার স্ট্রাইকের সময় ভারতীয় বায়ুসেনার মিরাজ-২০০০ ইসরায়েলের স্পাইস ২০০০ বোম্ব ব্যবহার করে, এটি প্রিশিসন বোম্ব। একটি যুদ্ধ বিমানের থেকে ড্রোন ব্যবহারের অনেক সুবিধা। কারন ড্রোনে পাইলট থাকে না ফলে জীবনের ঝুঁকি থাকে না। ড্রোনের ওজন যুদ্ধবিমানের থেকে অনেক কম হয় ফলে ফুয়েল কম লাগে এবং এর গতি অনেক বেশী হয়। সবচেয়ে বড় কথা একটি যুদ্ধবিমানের থেকে ড্রোনের খরচ অনেক কম। ভবিষ্যতে পঞ্চম প্রজন্মের হাইব্রিড ওয়ারফেয়ার মূলত ড্রোন নির্ভর হতে চলেছে।
ঘাতক ড্রোনের আগে নাম ছিল আউরা, পরে নাম রাখা হয় ঘাতক। ঘাতক প্রজেক্ট অত্যন্ত গোপন এর অনেক বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করা হয়নি, যতটুকু জানা গেছে সে সম্পর্কেই জানানো হচ্ছে। ২০১৫ সালে তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী স্বর্গীয় মোনোহর পারিকর জানিয়েছিলেন ঘাতক ড্রোনে ইঞ্জিন হিসেবে ব্যবহার করা হবে কাবেরী আফটার বার্নিং টার্বোফ্যান ইঞ্জিন যা ৫২ কিলো নিউটন থ্রাস্ট উৎপন্ন করতে সক্ষম। আগেই বলা হয়েছে যে প্রজেক্ট আউরা থেকে ঘাতক নাম দেওয়া হয়েছে। ২০০৯ সালে এই প্রজেক্ট আউরা শুরু হয় যার জন্য প্রাথমিকভাবে ১২৫ মিলিয়ন টাকা বাজেট দেওয়া যা ২০২০ সালের হিসাবে প্রায় ৩.৫ মিলিয়ন ডলার। ২০০৯ সালে ভারত সরকার একটি রিসার্চে দেখল বিশ্বের সমস্ত শক্তিশালী দেশেরই ইউএসিভি রয়েছে। আমেরিকার তো আছেই এবং ভারতের প্রধান শত্রু চীন ও ইউসিভি তৈরি করছে, তখন এই প্রজেক্ট শুরু করা হয়। আউরা পোগ্রামের লক্ষ্য ছিল নিজস্ব ড্রোন তৈরি, ২০১৩ সালে এই প্রজেক্ট সম্পন্ন হয়ে যায়। এরপর এডিএ এই প্রজেক্টের উপর নির্ভর করে ভারতীয় বায়ুসেনার ভবিষ্যতের কমব্যাট ড্রোন প্রজেক্ট শুরু করে তখন এর নাম হয় ঘাতক।
২০১৬ সালে ঘাতক ও হ্যাল আমকা প্রজেক্টের জন্য প্রাথমিকভাবে ৩৭ মিলিয়ন ডলারের একটি ফান্ডিং দেওয়া হয়। প্রথমে বায়ুসেনার জন্য এই প্রজেক্ট শুরু করা হলেও ভারতীয় নেভি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ও ল্যান্ডিং প্ল্যাটফর্ম ডক থেকে এই ড্রোন ব্যাবহারের জন্য এই প্রজেক্টে উৎসাহ দেখায়। ঘাতকের পূর্ণ প্রোটোটাইপ তৈরির আগে এর একটি ছোট ভার্সন তৈরি করা শুরু হয় ২০২০ সালে যার নাম সুইফট বা স্টেলথ উইং ফ্লাইং টেস্টবেড। এর লক্ষ্য ঘাতকের কীছু টেকনোলজি ও ফ্লাইট টেস্ট পরীক্ষা করা। ২০২১ সালেই গ্রাউন্ড ট্রায়াল শুরু হয় সুইফটের এবং গত ১ জুলাই এর প্রথম উড়ান সম্পন্ন হয় কর্নাটকের চিত্রদুর্গের এটিআর থেকে। সুইফটকে দেখতে আমলে নর্থ্রুপ গ্রুম্যানের তৈরি বিখ্যাত বি-২ স্পিরিট বোম্বারের মতন। চার মিটার লম্বা ও ১ টন ওজনের এই সুইফটে রাশিয়ার এনপিও সটরুন ইন্জিন ব্যবহার করা হয়েছে। এই ঘাতক ড্রোনের কন্ট্রোল সিস্টেম ও ডাটা লিংক প্যাকেজ তৈরি করছে এডিএ এবং দেরাদুন বেসড ডিফেন্স ইলেকট্রনিক্স অ্যাপ্লিকেশন ল্যাবরেটরি বা ডিল। আসলে কোন কম্যান্ড সেন্টার থেকে ড্রোনকে নিয়ন্ত্রন করা এবং ড্রোনের নিজস্ব অটোনোমাস ক্ষমতার জন্য বিশেষ ডাটা লিংক দরকার যার সাহায্যে অন্যান্য যুদ্ধবিমানকেও এই লিংকের সাহায্যে যুক্ত করা সম্ভব হবে। অত্যন্ত জটিল এই ডাটা লিংক সিস্টেম ডিল তৈরি করছে।
ডিআরডিও এর মুখ্য নিয়ন্ত্রক ও রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেক্টরের নিয়ন্ত্রক ডঃ প্রহ্লাদা জানিয়েছেন মূল ঘাতক ড্রোনের ওজন ১৫ টনের একটু কম হবে এবং এটি মাটি থেকে ৩০,০০০ ফুট বা ৯,১৪৪ মিটার উচ্চতায় উড়তে সক্ষম হবে। ঘাতক রেল লঞ্চিং মিসাইল হিসাবেও ব্যবহৃত হবে। এখন সিস্টেম সম্পর্কে ভারতের কোন ওয়েবসাইটে তেমন কিছু বলা নেই। আমেরিকার বিখ্যাত প্রতিরক্ষা সংস্থা ডারপা তাদের ওয়েবসাইটে এই সিস্টেম সম্পর্কে আলোচনা করেছে। ডারপা দুধরনের রেল লঞ্চিং মিসাইল সিস্টেম সম্পর্কে বলেছে। প্রথমত যদি ধরা যাক ১০০০ কিলোমিটার দূরে শত্রুর কোন টার্গেট কে ধ্বংস করতে হবে কিন্তু আমাদের কাছে আছে ৫০০ কিলোমিটার রেঞ্জের মিসাইল। তাহলে কী আবার ১০০০ কিলোমিটার রেঞ্জের মিসাইল তৈরি করতে হবে? ডারপা বলছে এক্ষেত্রে ইউএসিভি করে মিসাইলকে মোটামুটি ৬০০ কিলোমিটার বহন করে নিয়ে গিয়ে ফায়ার করতে হবে। কোন স্টেলথ ড্রোনে ইন্টারন্যাল ওয়েপনস বে থাকে কিন্তু চাইলে বাইরেও মিসাইল ইনস্টল করা যায়, মোট কথা শত্রুর রেডার রেঞ্জের বাইরে থাকলে বাইরে মিসাইল ইন্সটল করে নিয়ে গেলে কোন সমস্যা হবে না। ঘাতকেও বাইরে মিসাইল ইন্সটল করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত ডারপা বলছে যদি টার্গেটের রেঞ্জ খুব বেশী হয় ধরা যাক ২০০০ কিলোমিটার। মিসাইলের রেঞ্জ ৫০০ কিলোমিটার এবং ধরা যাক ইউএসিভির রেঞ্জ ১০০০ কিলোমিটার তাহলে ইউএসিভি করে মিসাইল বয়ে নিয়ে গেলেও ৫০০ কিলোমিটার কম পড়ছে, এক্ষেত্রে কোন যুদ্ধবিমানে ইউএসিভি সহ মিসাইলকে বহন করে নিয়ে গিয়ে মিসাইল লঞ্চ করা হয়। এভাবে রেল লঞ্চিং মিসাইল কাজ করে।